গোলাম আশরাফ খান উজ্জ্বল
মহান আল্লাহপাক পবিত্র কোরআন শরীফের সূরা হুজরাতের ১৩নং আয়াতে বলেন, ‘হে মানুষ! আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী হতে এবং তোমাদের বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে। যাতে তোমরা একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তিই আল্লাহর নিকট অধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে ব্যক্তি অধিক আল্লাহকে ভয় করে।’ পৃথিবীতে যেমন বিভিন্ন জাতি রয়েছে, তেমনি বিভিন্ন জাতির নিজস্ব ভাষাও রয়েছে। যেমন বাঙালির ভাষা বাংলা, ইংরেজদের ইংরেজি, আরবীয়দের আরবি ভাষা। আমাদের ধর্মগ্রন্থ মহাপবিত্র আল কোরআন। মাতৃভাষার ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে ‘মাতৃভাষা বাংলা’র দাবিতে শহীদ হয়েছে বাংলার মানুষ। যা আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ২১ ফেব্রুয়ারি পালিত হচ্ছে সারা বিশ্বে।
কোরআন আরবি ভাষায় আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ওপর অবতীর্ণ হয়। পবিত্র কোরআন শরীফ আরবি ভাষায় অবতীর্ণ হলেও অন্যান্য ভাষার ব্যাপারেও সম্মান দেখিয়েছে, এর কতগুলো কারণও রয়েছে। মাতৃভাষায় মানুষ সাধারণত যতটুকু কথাবার্তা, ভাবভঙ্গি, আনন্দ, দুঃখ, আবেগ প্রকাশ করতে পারে, অন্য কোনো ভাষায় ততটুকু ভাব-ভাষা প্রকাশ করা মোটেও সম্ভব নয়। মাতৃভাষায় সব নীতিবাক্য যত সহজ এবং সরলভাবে স্মরণ ও করায়ত্ত থাকে অন্য ভাষায় ততটা সম্ভব হয় না। যদি কেউ, কোনো ব্যক্তিকে কোনো বিষয়ে বুঝাতে চায় তা হলে তার মাতৃ ভাষাতেই বুঝালে অতি দ্রুত বুঝতে সক্ষম হবে।
মানুষ যাতে নবী রাসূলদের আদেশ নির্দেশ ও নিষেধ মেনে চলতে পারে এবং নবী রাসূলদের সব নীতিবাক্য যত সহজে বুঝতে পারে সেজন্য প্রত্যেক নবী রাসূলদের মহান আল্লাহপাক তাদের স্বজাতীয় ভাষাভাষী করেই প্রেরণ করেছেন। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনের সূরা ইব্রাহীমের ৪নং আয়াতে ঘোষণা করেন, ‘আমি সব পয়গাম্বরকে তাদের স্বজাতীয় ভাষায় প্রেরণ করেছি। যাতে তাদেরকে সহজ ভাষায় বুঝাতে পারে। অতঃপর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পথভ্রষ্ট করেন এবং যাকে ইচ্ছা সৎ পথ প্রদর্শন করেন। তিনিই মহাপরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়।’ এ আয়াতের ব্যাখ্যা এমন হতে পারে যে, প্রথমত প্রত্যেক নবী রাসূলদের পরিবার, গোত্র বা বংশে এবং সমাজে তাওহীদের বাণী প্রচার করতে হতো। পরিবার-পরিজনকে তাদের ভাষায় এবং তাদের সামাজিকতায় ধর্মীয় জ্ঞান প্রচার করতে হয়।
নবী রাসূল বা পয়গাম্বরদের মাধ্যমে মহান আল্লাহ তার বাণীসমূহ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতেন। তাই হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মাতৃভাষা আরবিতে কোরআন শরীফ, মুসা (আ.)-এর তাওরাত শরীফ-ইব্রানী ভাষায়, দাউদ (আ.)-এর জাবুর শরীফ-ইউনানী ভাষায়, ঈসা (আ.)-এর ইঞ্জিল শরীফ-সুরিয়ানী ভাষায় অবতীর্ণ হয়-(জজবায়ে মারফত পৃষ্ঠা ৪৫, হযরত মাওলানা আবদুর রশীদ ফরাজী)। আমাদের নবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মদ (সা.) আরবে জন্মগ্রহণ করেছেন। মহানবী (সা.)-এর মাতৃভাষা আরবি। সঙ্গত কারণে আল্লাহ কোরআন আরবি ভাষায় অবতীর্ণ করেছেন। যাতে করে আরব জাতিকে প্রথম পর্যায়ে ঈমান, তাওহীদ, তাকওয়া ও ইসলামের বিধানসমূহ সহজভাবে বোঝানো যায়। আর সাধারণ মানুষও আল্লাহর কথা সহজভাবে এবং গুরুত্বসহকারে বুঝতে পারে। মাতৃভাষার গুরুত্ব কতটা বেশি তা সূরা ইউসুফের ২নং আয়াত হতেই অনুধাবন করা যায়। এ ব্যাপারে আল্লাহ মহানবী (সা.)-কে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আমি কোরআনকে আরবি ভাষায় অবতীর্ণ করে সহজ করে দিয়েছি। যাতে তোমরা সহজে বুঝতে পার।’
আমরা দেখতে পাচ্ছি মহান আল্লাহ আরবীয়দের কোরআন বোঝার জন্যই আরবি ভাষায় কোরআন অবতীর্ণ করেছেন। পবিত্র কোরআনের নির্দেশ অনুধাবনের জন্য সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন এবং বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধি করা আমাদের একান্ত প্রয়োজন। বাংলা ভাষার সব লেখক, সাংবাদিকদের উচিত শিশু কিশোরসহ সবার জন্য সহজবোধ্য শব্দ ব্যবহার করা। যাতে কঠিন বিষয়েও অতি সহজে উপস্থাপন করা যায়। সাহিত্য যেন হয় সহজবোধ্য ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের। যাতে কঠিন বিষয়ও অতি সহজে উপস্থাপন করা যায়। কোরআন, হাদিস ও ইসলামী গ্রন্থ সহজ ভাষায় অনুবাদ করা এবং বাংলায় তা সহজ করে দেয়া অনুবাদকদের অতি জরুরি দায়িত্ব। যাতে করে বাংলার মুসলমানরা কোরআন ও হাদিস মাতৃভাষায় সহজে পড়তে পারে। ধর্মীয় অনুশাসনের সব রীতি-নীতি, সব গ্রন্থ বাংলা ভাষায় অনুবাদ হওয়া একান্ত জরুরি। বোখারী শরীফ, তিরমিজী শরীফ, ইবনে মাজা শরীফও নাসায়ী শরীফ বাংলায় অনুবাদ হলে অতি সহজে সাধারণ মানুষ পড়তে ও জানতে পারবে। শামায়েলে তিরমিজী, ইবনে কাসিরের কিতাবসমূহ কুরতুবী গ্রন্থ বাংলা ভাষায় অনুবাদ হলে অবশ্যই আমাদের জন্য ইসলামকে বুঝতে সহজ হবে।
লেখক : সাংবাদিক ও গবেষক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন