রাশিদুল ইসলাম
ছোটবেলায় বাংলা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করার সময় একটি প্যারাগ্রাফ পড়েছি। যা হচ্ছেÑ প্রতিদিন আমাদের বিশ্বে উল্লেখযোগ্য দুটি ঘটনা ঘটে থাকে। একটি হচ্ছে সূর্যোদয়, যা আমাদের চারপাশ আলোকিত করে। আরেকটি হচ্ছে মিডিয়া, যা তাবৎ বিশ্বের খবরাখবর আমাদের সামনে তুলে ধরে। তেমনি এই শতাব্দীতে ইরান দুটি উদাহরণ সৃষ্টি করেছে যা দুনিয়ার ঘটনাপ্রবাহের গতিকে ঘুরিয়ে দিতে পারে।
এর একটি হচ্ছে, দেশটির ওপর ১২ বছরের অর্থনৈতিক অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞা আলোচনার টেবিলে মীমাংসায় কূটনৈতিক ধীশক্তির ব্যবহার করে সফল পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়া এবং আরেকটি হচ্ছে সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়া, আফগানিস্তানসহ মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্কটগুলোকে সামরিক শক্তি ব্যবহারের পরিবর্তে আলোচনার টেবিলে এনে মীমাংসার পথে এগিয়ে নেয়ার একটি সম্ভাবনা সৃষ্টি করা। জাতিসংঘ, পরাশক্তিগুলো এখন ইরানের এ দুটি পথকে অনুসরণ করবে বলেই মনে হচ্ছে। কেন নয়, বরং এ সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে যে, সংঘাতের বিপরীতে শান্তি ও কূটনীতির জয় চাইলে সামরিক শক্তি এখন আর কোনো কাজে আসছে না। হ্যাঁ, আপনি ইরাকে, সিরিয়ায়, লিবিয়া, আফগানিস্তান, পাকিস্তানের মতো দেশগুলোতে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে একদিকে যুদ্ধ শুরু করতে পারেন আবার আল-কায়েদার পর আইএস জঙ্গির মতো নতুন নতুন মিশন শুরু করতে পারেন। ইসলামের নামে এসব জঙ্গি গোষ্ঠীর লোকবলকে লেলিয়ে দেয়া, তাদের হাতে অস্ত্র সরবরাহ কীভাবে হয় তা আজও বিশ্বের মিডিয়ার কাছে এক অজানা রহস্য। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে, বাংলাদেশের মতো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশে সিঙ্গাপুর থেকে প্রবাসী বাংলাদেশীদের জঙ্গি সন্দেহে ফেরত পাঠানো হচ্ছে, কিন্তু তারা কোথা থেকে নাযিল হচ্ছে, বা প্রশিক্ষণ পেয়েছে তা কেউ বলছে না। যদিও বাংলাদেশের পুলিশ বা গোয়েন্দারা তাদের জঙ্গি কর্মকা-ে জড়িত থাকার কোনো হদিস এখনো পায়নি।
গত ১৬ জানুয়ারি ইরানের ওপর থেকে দীর্ঘদিনের অর্থনৈতিক অবরোধ তুলে নেয়ার পর দেশটির নাগরিকরা একটু শ্বাস নেয়ার আগেই নতুন করে ফের ক্ষেপণাস্ত্রের ওপর অবরোধ জুড়ে দেয়া হয়েছে। মোদ্দা কথা হচ্ছে, আমাদের তেল ওদের হাতে থাকবে কেন, ক্ষেপণাস্ত্র শুধু পরাশক্তিগুলোর একতরফা তৈরির অধিকার থাকবে কেন। কারণ, নিরাপত্তা যেন শুধু তাদের জন্যইÑ অন্য কোনো দেশের এখতিয়ার নয়। বিশেষত কোনো মুসলিম দেশের তো নয়ই। আশির দশক থেকে শুনে আসছি, ইরান পারমাণবিক বোমা বানিয়ে ফেলল বলে, ইসরায়েল ক্ষণে ক্ষণে হুঁশিয়ার করছিল ইরানকে আক্রমণ করা উচিত ইত্যাদি। এতদিনে অনেকের হুঁশ হয়েছে এসব বাতচিৎ ছিল প্যালেস্টাইনের ওপর কীভাবে একের পর এক ধ্বংসযজ্ঞ চাপিয়ে দেয়া, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে জবাবদিহি ও স্বচ্ছতার পরিবর্তে রাজতন্ত্রের তকমা যেন এঁটে থাকে তা অক্ষুণœ রাখা। যাতে সস্তায় তেল কিনে বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রি করা যায়। অথচ ইরানের ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী বহু আগেই ঘোষণা করেছেন, ইসলামের নীতি অনুসারে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ, ফসলের ক্ষেত বিনষ্ট ও নিরাপরাধ মানুষকে যুদ্ধে হত্যা করার কোনো বিধি নেই বলে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি কিংবা ব্যবহার সম্পূর্ণ হারাম। তাহলে ইরানের বিরুদ্ধে কেন বারবার পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির মিথ্যা অভিযোগ পরাশক্তি এনেছিল? কারণ, যাতে ইরান সুস্থির থাকতে না পারে। যেমন ইরাক আক্রমণের আগে রাসায়নিক বোমার কথা বলা হলেও আজ পর্যন্ত তার কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।
ইরান সুশাসন নিশ্চিত করেছে বলেই আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের সমুচিত জবাব দেয়া সম্ভব হয়েছে। পরাশক্তিগুলোর চোখ রাঙ্গানি, সামরিক বৈভবকে যুক্তি দিয়ে ইরানের বিদগ্ধ আলোচকরা শুধু সমঝোতায় নিয়ে আসেননি বরং সহযোগিতার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন। এমন কি আলাউদ্দিনের চেরাগ ইরানের হাতে এল যে, দেশটিতে বিভিন্ন খাতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ করতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে শুরু করে চীন, ভারত, লাতিন আমেরিকা, এমনকি খোদ যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগকারী থেকে শুরু করে বহুজাতিক ব্যাংক, ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বিমান তৈরির কোম্পানিগুলো ধেয়ে আসছে। অবরোধের সময় যন্ত্রাংশের অভাবে ইরানের বিমান চলাচল যেখানে অনেকটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল সেখানে দেশটি অন্তত চার শতাধিক বিশালকায় উড়োজাহাজ ক্রয়ের চুক্তি করতে যাচ্ছে, লাখ লাখ ব্যারেল তেল উৎপাদনের দিকে এগুচ্ছে, হাজার হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে রফতানি করছে আর এমনি নানা ধরনের আর্থিক কর্মযজ্ঞে তৎপর হয়ে উঠেছে দেশটি। তাহলে ইরানের ওপর এতদিনের অর্থনৈতিক অবরোধের ফলই বা কি? ইরানের কাছ থেকে তেল গ্যাস না কিনে উৎপাদনশীলতা বিনষ্ট হওয়ায় ইউরোপ কি তাহলে বুঝতে পেরেছে মন্দা কাকে বলে, ইরানের কাছ থেকে যখন পশ্চিমা দেশগুলো তেল কিনতে রাজি হয়নি তখন চীন ও ভারত দেশটি থেকে কি তেল আমদানি করেনি? এখন ইরানের তেল কিংবা গ্যাস ভারত হয়ে বাংলাদেশে পুনরায় রফতানি হলে কি খুব অবাক হবার কিছু থাকবে!
তাহলে পশ্চিমা মিডিয়ার খবর সঠিক ছিল না যে, ইরান পারমাণবিক বোমা বানানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। বুঝুন এবার ইরান আসলে যা করেছে তা হচ্ছে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ নির্মাণ, সুশাসনের চর্চা, রাজতন্ত্রের পথ পরিহার, প্রযুক্তি ও সম্পদ সৃষ্টির কৌশল আয়ত্ব করা ইত্যাদি।
আপনি যদি কারো দিকে বন্ধুত্বের নিদর্শনসহ তাকান তো তার চোখের দিকেই গভীর দৃষ্টি দিন। কাউকে বুকে জড়িয়ে ধরলে তার হৃদয়ের স্পন্দন নিন। কাউকে স্পর্শ করতে চাইলে তাকে অন্তত হেয় কিংবা করুণা করবেন না। ইরানের বিষয়টি বুঝতে চাইলে কীভাবে দেশটি অর্থনৈতিক বিকাশের পরিপূর্ণ সুযোগ সৃষ্টি করল আর পরাশক্তিদের কীভাবে আলোচনার টেবিলে আস্থায় আনল তা আপনাকে দেখতে হবে। মধ্যপ্রাচ্যের চারদিকে যখন যুদ্ধ, তখন শান্তিপূর্ণ কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে যদি ইরান বিজয় এনে এ অঞ্চলে একটা স্থিতি দিতে পারে তাহলে তা বিশ্বকে নিঃসন্দেহে কিছুটা হলেও নিরাপদ করবে। পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত পৃথিবী গড়তে চাইলে এখন ইরানকে অনুকরণ করা প্রয়োজন। জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থার সব শর্ত পূরণ করে ইরান বিশ্বের বিভিন্ন ব্যাংকে আটক থাকা ১০০ বিলিয়ন ডলারের সম্পদও ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছে যা দেশটির অর্থনীতি ও বিনিয়োগকে আরো শক্তিশালী করবে। সম্ভবত পশ্চিমা দেশগুলো বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য এখনো পরিষ্কার বুঝে উঠতে পারছে না ইরানকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা রাখার নীতি আদতেই কোনো কাজ করবে কি না। আদতে ইরানের ওপর অবরোধ কিংবা নিষেধাজ্ঞা তেমন কোনো কাজে আসেনি বরং দেশটিকে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে সাহায্য করেছে। আর এ কাজে ইরানের রাজনীতি, অর্থনীতি, আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের অবদানকে অস্বীকার করা যায় না।
নিষেধাজ্ঞামুক্ত ইরানকে কিছু বিচার-বিবেচনায় পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করা সহজ নয়। ২০০৩ সাল থেকে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের আরোপ করা নিষেধাজ্ঞার অবসান ঘটাতে ইরানের নেতৃত্ব যে কৌশল ধারাবাহিকভাবে নিয়েছে তা আন্তর্জাতিকভাবে দরকষাকষি করেই পরিস্থিতি নিজেদের আয়ত্বে আনতে হয়েছে। ইরান যদি পারমাণবিক বোমা বানাতে চাইত তাহলে কি এ ধরনের ধারাবাহিক পথ পরিক্রমায় পশ্চিমা বিশ্বকে আস্থায় আনা সম্ভব হতো! প্রায় এক যুগ ধরে নিজেদের পক্ষে যুক্তিনির্ভর আলোচনা চালিয়ে গেছেন ইরানের কূটনীতিকরা। এ প্রচেষ্টায় কখনো অগ্রগতি, কখনো স্থবিরতা এলেও হাল ছাড়েননি তারা। ইরান তার পারমাণবিক কর্মসূচি উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে আনার পর এ প্রক্রিয়ার নজরদারি করছে আন্তর্জাতিক পারমাণবিক সংস্থা। চুক্তির আওতায় ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ন্ত্রণে প্রথমটি ছিল ফাইনালাইজেশন ডে, যেদিন জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ চুক্তি অনুমোদন করে, অর্থাৎ ২০ জুলাই। তার ৯০ দিন পরে ছিল অ্যাডাপশন ডে বা গ্রহণ দিবস, যেদিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর আইনসভাগুলোর এই প্রস্তাব গ্রহণের বাধ্যবাধকতা ছিল, দিনটি ছিল ১৮ অক্টোবর। তৃতীয় দিন ছিল ইমপ্লিমেন্টেশন ডে বা বাস্তবায়ন দিবস; বলা হয়, আন্তর্জাতিক পারমাণবিক সংস্থার প্রতিবেদন যেখানে এ বিষয়ে ইরানের পক্ষ থেকে সব শর্ত পালন এবং সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ সম্পন্ন করার ফল জানানো হবে, তারপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হবে। সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ নির্ধারিত ছিল না, কিন্তু বলা হয়েছিল, তা হতে হবে ডিসেম্বর বা জানুয়ারি মাসে। সেই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। চতুর্থ পদক্ষেপ আসবে গ্রহণ দিবস থেকে আট বছর পরে, অর্থাৎ ২০২৩ সালে। একে বলা হয়েছে ট্রানজিশন ডে বা পরিবর্তন দিবস। যেসব পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, যদি আট বছরের আগে তা সম্পন্ন হয়, তবে এই দিন আগেও আসতে পারে। আর সব শেষে টার্মিনেশন ডে বা সমাপ্তিকরণ দিবস আসবে ২০২৫ সালে। এই দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনার তৃতীয়, কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্ব¡পূর্ণ স্তরে ইরান সাফল্য অর্জন করেছে দেশটির রাজনীতিবিদদের প্রজ্ঞায়।
ইরানের অর্থনীতিতে সঙ্কট এড়িয়ে প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি করে কীভাবে বেকারত্ব দূর করতে বিনিয়োগ কৌশল সফল করে তোলা যায় এখন চলছে সেই পর্বের বাস্তবায়ন। একই সঙ্গে আঞ্চলিক রাজনীতিতে অবস্থান শক্তিশালী করে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ইরান গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধির চেষ্টা করে যাচ্ছে। যদিও ইরানের আশপাশে একাধিক সংঘাতের ঘটনা ঘটছে তবুও দেশটির নেতারা সেই দিকটি বিস্মৃত না হয়ে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে সুস্থির আছেন এবং তা হচ্ছে অর্থনীতিতে আরো গতিশীলতা সৃষ্টি করা। অর্থনৈতিক বিবেচনা, বিশেষত ইউরোপে মন্দা কাটানোর পাশাপাশি বিশ্ব অর্থনীতিতে আরও বেশি গতিশীলতা তৈরির জন্য ইরানে বিনিয়োগ ও দেশটির মানুষের কাছে পণ্য পৌঁছাতে অনেক দেশই উন্মুখ হয়ে আছে। পশ্চিমা দেশগুলো চায় বিশ্ববাজারে তেলের মূল্য স্থির থাকুক ইউরোপের অর্থনীতিকে চাঙা করে তুলতে স্বল্পমূল্যে তেলের সরবরাহ নিশ্চিত হোক। এর ফলে রাশিয়ার রফতানি করা তেলের দাম কমে দেশটির ওপর চাপ সৃষ্টি করবে। এ অবস্থায় ইরান আগ্রাসী হওয়ার মতো কোনো সংঘাতে কখনোই জড়াবে না। এভাবে ইরানের ওপর পশ্চিমা দেশগুলোর আস্থা আরো বাড়বে।
এ বিশ্বে বর্তমানে কেউ আইএস জঙ্গিদের পছন্দ করছে না। তালেবানদের শান্তির পথ অনুসরণ করে আলোচনার পথে ফিরে আসা ছাড়া উপায় নেই। ঠিক আঞ্চলিক শক্তি ভারসাম্যের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বিশ্বকে আস্থায় এনে কীভাবে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রায় এগিয়ে যেতে হয় তা দেখিয়েছে ইরান। অবরোধ উঠে যাবার পর অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে প্রেসিডেন্ট রুহানি যখন ইউরোপ সফর করলেন তখন ইরানের পক্ষ থেকে বিনিয়োগকারীদের বলা হয়েছে ইরান হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে নিরাপদ এবং স্থিতিশীল দেশ। রুহানি আশ্বস্ত করে বলেছেন, ‘উগ্রপন্থা মোকাবিলার জন্য অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে একমাত্র উপায়। বেকারত্ব সন্ত্রাসবাদের জন্ম দেয়।’
মধ্যপ্রাচ্যের কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় ইরানের সঙ্গে ১৫টি দেশের স্থল ও জলসীমা রয়েছে। স্বভাবতই নতুন সিল্ক রোড প্রকল্পে ইরান মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরেশিয়ার সঙ্গে চীনের যোগাযোগ বাড়াতে আগামী ছয় বছরে ইরান নতুন সিল্ক রোডে ৬০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে। পাশাপাশি ৫ বছর ধরে সিরিয়া যুদ্ধ চলার পর গত বছর ফেব্রুয়ারিতে আলোচনা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর এ প্রক্রিয়ায় ইরানের সম্পৃক্ততার পর আবারো জাতিসংঘ এ আলোচনা শুরু করেছে। বিশ্বে সিরিয়ার গণিতবিদরা রাতের আকাশ পর্যবেক্ষণে জ্যামিতির ব্যবহার করে প্রথম। গ্রিক সভ্যতার চেয়েও প্রাচীন সভ্যতা ও শহর ব্যবস্থা দামেস্কে গড়ে উঠে। সেই ইরাক ও সিরিয়া ধ্বংস করে পশ্চিমা শক্তি কী পেয়েছে এ প্রশ্নের উত্তর পেতে হয়তো আরো বেশ কয়েক বছর লাগবে, কিন্তু ইতোমধ্যে ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী লরা ফেবিয়াস বলেছেন, ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে শান্তি প্রক্রিয়া ব্যর্থ হলে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেবে ফ্রান্স। আর এ ঘোষণা এসেছে ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির সফরের পরপরই। ফ্রান্সের পাশাপাশি ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আমেরিকা, ইউরোপ ও কয়েকটি আরব দেশের নেতারা ওই শান্তি প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনায় অংশ নেবেন।
উন্নয়ন শুধু ইরানে নয়, তাবৎ বিশ্বেই হচ্ছে। তাহলে ইরানের বিষয়টি সাধারণ নয় কেন? অসাধারণ এজন্য যে, বিপ্লবের পর পুরো বিশ্ব একদিকে আর বলা যায় অন্যদিকে ধারাবাহিক অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও ইরান তা মোকাবেলা করে পুরো বিশ্বকে উন্নয়নের সহযাত্রী হিসেবে পাওয়ার সক্ষমতা অর্জন করেছে। এ অর্জনের ভিত্তি ছিল ন্যায়ের পথে অবিচল থাকা। পরাশক্তির কাছ থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র কিনে বা সস্তায় তেল বিক্রি করে ইরানের রাজনীতিবিদরা বিলাসবহুল জীবন যাপনে না নিজেরা গা ভাসিয়ে দিয়েছেন, না নাগরিকদের সে পথে ধাবিত করেছেন। ইরানের রাজনৈতিক কৌশলে পরাশক্তিগুলোর ক্রীড়নক না হওয়ার অটুট সংকল্প ছিল। অবরোধে সাশ্রয়ী হয়ে ওঠার কৌশল আয়ত্বে নিয়েছে ইরান। এখন দেশটির আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট এমনই যে, তাৎক্ষণিক ভোগ না করে সঞ্চয় করে, ভবিষ্যতে আয় বেশি করা এবং ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য তা সমৃদ্ধ করে তোলা। কিন্তু তার পরের স্তরে ইরানকে বিনিয়োগ নিয়ে যেতে হবে অন্য দেশে। সেই সক্ষমতা অর্জন করে ইরান যদি ক্ষুধামুক্ত বিশ্বের জন্যে অর্থনৈতিক আন্দোলন শুরু করতে পারে তাহলে ইরানের বিপ্লব আরো টেকসই হয়ে উঠবে নিঃসন্দেহে। কিন্তু তার আগে দেখতে হবে ইরানের বিনিয়োগকারীরা তার অর্জিত শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক বিদ্যুৎ কর্মসূচি ছড়িয়ে দিতে পারছে কি না যা সস্তায় জ্বালানি উৎপাদন দেশে দেশে নিশ্চিত করবে নাকি পশ্চিমা ধারায় ফটকা বাজারি বা স্টক মার্কেটের খপ্পরে পড়ে বিনিয়োগকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। ইরানের জন্যে বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত করা সহজ নয়। কারণ, দেশটি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি থেকে সরে এসে ক্ষুধা ও দারিদ্র্য সেই সঙ্গে সন্ত্রাসমুক্ত বিশ্ব গড়ে তোলার কথা বলছে।
ইরানের জন্যে আসল চ্যালেঞ্জ হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি সঞ্চয়কে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগে রূপান্তর করতে পারা। ইরান দীর্ঘমেয়াদি শিক্ষা, দক্ষতা প্রশিক্ষণ ও অবকাঠামো উন্নয়নে যত বেশি বিনিয়োগ করবে স্বল্পমেয়াদি ঋণের প্রবাহও তত বাড়বে। এ ধরনের উদাহরণ পারস্য উপসাগরীয় দেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে প্রভাব ফেলবেই। কারণ, ইরানের শিল্প সক্ষমতা তখন আশপাশের দেশগুলো অনুকরণ করতে শুরু করবে তাদের নিজেদের স্বার্থেই।
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মাদ জাওয়াদ জারিফ সম্প্রতি নিজের টুইটার পাতায় বলেছেন, ‘কূটনীতি হচ্ছে পরিপক্বদের কর্মক্ষেত্র; বলদর্পী নব্য-ধনীদের নয়।’ সত্যিই তাই। তেলের টাকায় আয়েশী জীবন, তরুণ প্রজন্মকে প্রযুক্তি ও পুঁজি ব্যবহারের বাইরে এবং সম্পদ সৃষ্টির কৌশল থেকে দূরে ভোগবাদী জীবনে অন্ধ করে রেখে ক্ষমতাকে সাময়িক পাকাপোক্ত করে রেখে যা কিছু যে করা সম্ভব নয় তা লিবিয়া, ইরাক বা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর দিকে তাকালে পরিষ্কার বোঝা যায়। বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র কিনলেও তা কার্যত কোনো কাজে আসে না। পশ্চিমা শক্তির লেজুড়বৃত্তির মধ্যেও কোনো মুক্তির পথ খুঁজে পাওয়া যায় না। ইরান তা উপলব্ধি করেই এগিয়ে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।
লেখক : সাংবাদিক ও মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন