শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

মেগা প্রকল্পে ধীরগতি

পিছিয়ে যাচ্ছে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার অর্থনৈতিক করিডোর

| প্রকাশের সময় : ২১ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

রফিকুল ইসলাম সেলিম : চট্টগ্রামে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি চলছে। জনদুর্ভোগের সাথে বাড়ছে প্রকল্পের ব্যয়ও। এতে করে সরকারের ‘ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার’ অর্থনৈতিক করিডোরের মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নও পিছিয়ে যাচ্ছে। নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, উন্নয়ন দেখাতে তড়িঘড়ি করে প্রকল্প গ্রহণের ফলে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এ অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের এক বছরেও নগরীতে ১৯ কিলোমিটার দীর্ঘ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ শুরু হয়নি। প্রকল্পটি অনুমোদনের অপেক্ষায় ঝুলছে পরিকল্পনা কমিশনে। সিটি আউটার রিং রোড প্রকল্পের কাজ শুরু হলেও জমি অধিগ্রহণসহ নানা জটিলতায় কাজ চলছে ধীরলয়ে। কাজ শুরুর পর ফের প্রকল্পে সংশোধন আনা হয়। তাতে ব্যয়ও বেড়েছে ৮শ’ কোটি টাকা। প্রকল্পটির বাস্তবায়নকালও এক বছর বাড়ানো হয়েছে।
একই অবস্থা মুরাদপুর ফ্লাইওভার প্রকল্পেও। পাঁচ কিলোমিটার দীর্ঘ মহানগরীর সবচেয়ে বড় এই ফ্লাইওভারের মূলকাজ আগামী বছরের মধ্যে শেষ হলেও কয়েকটি পয়েন্টে ওঠা-নামার সড়ক নির্মাণকাজ চলবে আরো এক বছর। অক্টোবরে চট্টগ্রামবাসীর বহু প্রতীক্ষিত কর্ণফুলী টানেলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন প্রধানমন্ত্রী ও চীনা প্রেসিডেন্ট। চলতি ডিসেম্বরে কাজ শুরু হওয়ার কথা থাকলেও হয়নি। আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি নাগাদ কাজ শুরুর কথা জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। বিগত ২০১১ সালে দোহাজারী থেকে কক্সবাজারের গুমদুম পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী। এখনও প্রকল্পের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ চলছে।
ক্ষমতায় আসার আগে চট্টগ্রামের উন্নয়নে একগুচ্ছ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন চলছে একের পর এক। গত ৭ বছরে বেশ কয়েকটি প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে। তবে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে চলছে অস্বাভাবিক ধীরগতি। একবার প্রকল্প গ্রহণের পর বারবার সে প্রকল্পে সংযোজন-বিয়োজন চলছে। এতে করে প্রকল্পের ব্যয় বাড়ছে, ধীরগতির কারণে কোনো কোনো প্রকল্প রীতিমতো জনদুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের প্রধান সমুদ্র্র বন্দরভিত্তিক বাণিজ্যিক রাজধানী খ্যাত চট্টগ্রামকে উন্নয়নের মহাসড়কে তুলে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার অর্থনৈতিক করিডোরের মহাপরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। তবে মেগা প্রকল্পের ধীরগতির কারণে সরকারের এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নও পিছিয়ে যাচ্ছে।
মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি প্রসঙ্গে নগর পরিকল্পনাবিদ ও ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট চট্টগ্রামের সাবেক সভাপতি প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার ইনকিলাবকে বলেন, উন্নয়ন দেখাতে তড়িঘড়ি করে প্রকল্প গ্রহণ করার ফলে বাস্তবায়ন করতে গিয়ে অচলাবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। তিনি বলেন, ফ্লাইওভারসহ চট্টগ্রাম মহানগরীতে অনেক প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে যা মাস্টার প্ল্যানে নেই।
এ ধরনের উন্নয়ন দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী খ্যাত বন্দরনগরী চট্টগ্রামের বিকাশের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে বলেও মনে করেন তিনি। একটি মহানগরীর অতীত ইতিহাস ঐতিহ্য, বর্তমান অবস্থা এবং ভবিষ্যৎ বিবেচনা করে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা উচিত বলেও মন্তব্য করে তিনি বলেন, তা না হলে এ ধরনের উন্নয়ন এক সময় নতুন সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে।
গত ৩০ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মহানগরীতে এ যাবৎকালের সবচেয়ে বড় প্রকল্প নগরীর লালখান বাজার থেকে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। তবে এখনো এ প্রকল্পের কাজ শুরু করা যায়নি। প্রকল্প গ্রহণের কিছুদিন পর তাতে আবার পরিবর্তন আনা হয়। পরিবর্তিত প্রকল্পটি এখনো অনুমোদন পায়নি।
প্রকল্প পরিচালক চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান ইনকিলাবকে বলেন, প্রকল্পটি কিছু পরিবর্তন করে অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে জমা দেয়া হয়েছে। অনুমোদন পেলে আগামী মার্চ-এপ্রিলের দিকে কাজ শুরু করা যাবে।
তিনি বলেন, যানজট আর জনদুর্ভোগ কমাতে তিন ধাপে বাস্তবায়ন হবে এই মেগা প্রকল্পটি। দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী মহাবন্দর নগরীর প্রধান সড়কে এই এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা হলে  যোগাযোগের ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন আসবে। মহানগরীর লালখান বাজার থেকে বারিক বিল্ডিং হয়ে কাটগড় এবং কর্ণফুলী শাহ আমানত সেতু থেকে বারিক বিল্ডিং পর্যন্ত হবে এক্সপ্রেসওয়ে। এটি নগরীর প্রধান সড়কে নির্মাণাধীন মুরাদপুর ফ্লাইওভারের সাথে যুক্ত হবে। প্রায় ১৯ কিলোমিটার দীর্ঘ এই এলিভেটেড প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা।
এর মধ্যে এক্সপ্রেসওয়ের নকশাতেও বড় পরিবর্তন আনা হয়েছে। প্রথমে এটি লালখান বাজার থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত করার কথা ছিল। নতুন নকশায় বিমানবন্দরের সাড়ে তিন কিলোমিটার আগেই  থেমে যাবে এক্সপ্রেসওয়ে। এর পরিবর্তে বারিক বিল্ডিং থেকে শাহ আমানত সেতু পর্যন্ত প্রায় ৭ কিলোমিটার অংশ যুক্ত হচ্ছে।
নগরীতে বাস্তবায়নাধীন অপর মেগা প্রকল্প মুরাদপুর ফ্লাইওভারের কাজেও কিছুটা ধীরগতি চলছে। এতে করে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন নগরীর এ অংশের বাসিন্দারা। সড়ক বন্ধ রেখে ফ্লাইওভার নির্মাণকাজ করার ফলে বিশাল এলাকাজুড়ে যানজট স্থায়ী রূপ নিয়েছে। মূল ফ্লাইওভার নির্মাণের কাজ যথাসময়ে শেষ করা গেলেও জিইসি মোড়সহ কয়েকটি পয়েন্টে ফ্লাইওভারে ওঠা-নামা করার জন্য সংযোগ সড়ক নির্মাণকাজ শেষ হতে আরো এক বছরের বেশি সময় লাগবে বলে জানান প্রকৌশলীরা।
৫ কিলোমিটার দীর্ঘ মুরাদপুর ফ্লাইওভারের নির্মাণকাজ আগামী বছরের জুনের মধ্যে শেষ করার কথা। কিন্তু প্রকল্পটি বাস্তবায়ন শুরুর পর এর নকশায় কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়। আর এ কারণে প্রকল্পের ও বাস্তবায়নের সময় দুটোই বেড়ে যায়। প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান জানান, ইতোমধ্যে মূল ফ্লাইওভারের নির্মাণকাজ ৭৫ শতাংশ শেষ হয়েছে। আগামী বছরের মার্চ-এপ্রিলের মধ্যে ফ্লাইওভারের কাজ শেষ হয়ে যাবে। এপ্রিলের মধ্যে এটি যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হবে। তবে ফ্লাইওভারটিতে বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে ওঠা-নামার সড়ক নির্মাণ শেষ হতে আরো এক বছর সময় লেগে যেতে পারে বলে জানান তিনি। বিগত ২০১৪ সালের ১১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৪৬২ কোটি ২৯ লাখ টাকা ব্যয়ে ফ্লাইওভারটির নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন। বর্তমানে এ প্রকল্প ব্যয় ৬৯৬ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের আরেকটি মেগা প্রকল্প ‘চিটাগাং সিটি আউটার রিং রোড’ প্রকল্পের কাজও চলছে ধীরগতিতে। এর মধ্যে প্রকল্পে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়েছে। এ কারণে ব্যয় বাড়ছে ৮০০ কোটি টাকা। প্রথম সংশোধিত প্রকল্প ব্যয় ১ হাজার ৭০০  কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে। গত বছর কাজ শুরু হলেও কাজ চলছে ধীরগতিতে। মাটি ভরাটের কাজ শুরু হয়েছে বিভিন্ন পয়েন্টে। আবার কোনো কোনো এলাকায় এখনও ভূমি অধিগ্রহণ শেষ হয়নি। এর ফলে কাজের গতি বাড়ছে না।
বিষয়টি স্বীকার করে রিং রোড প্রকল্পের পরিচালক, সিডিএর প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস জানান, মাটি ভরাটের কাজ ৬০ ভাগ শেষ হয়েছে। ভূমি অধিগ্রহণ এখনো পুরোপুরি শেষ হয়নি। আর এ কারণে কাজ ধীরে চলছে। কয়েকটি পয়েন্টে ব্লক ও রিটার্নিং ওয়াল নির্মাণের কাজ করায় প্রকল্পে সময় কিছুটা বেশি লাগছে বলে জানান তিনি। তবে তিনি আশাবাদী ভূমি অধিগ্রহণ শেষ হয়ে গেলে নির্ধারিত সময় ২০১৯ সালের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। তিনি জানান, মূল প্রকল্পে ২০১১ সালের জানুয়ারি  থেকে ২০১৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত নির্মাণকাজের সময় নির্ধারণ করা হলেও প্রথম সংশোধিত প্রকল্পে তা বাড়িয়ে করা হয় ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত।
কাজ শুরু হয়নি চট্টগ্রামবাসীর বহু প্রতীক্ষিত কর্ণফুলী টানেলের নির্মাণকাজ। গত ১৪ অক্টোবর চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের ঢাকা সফরের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যৌথভাবে কয়েকটি প্রকল্পের ফলক উন্মোচন করেন, যার মধ্যে কর্ণফুলী টানেলও ছিল। তিন হাজার পাঁচ মিটার দীর্ঘ এ টানেল নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৪৪৬ কোটি ৬৪ লাখ টাকা, যার মধ্যে ৪ হাজার ৭৯৯ কোটি ৪৪ লাখ টাকা দেবে চীনের এক্সিম ব্যাংক।
প্রকল্পের বাকি ৩ হাজার ৬৪৭ কোটি ৬৪ লাখ টাকা সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে দেয়া হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে সেতু কর্তৃপক্ষ। কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পের নির্মাণকাজের পরামর্শক হিসেবে গত মাসে দেশী-বিদেশী ছয় প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দিয়েছে সরকার। এছাড়া কর্ণফুলী টানেল নির্মাণে চীনের সঙ্গে একটি কাঠামো চুক্তিও হয়েছে। এ মেগা প্রকল্পের নির্মাণকাজ ডিসেম্বর নাগাদ শুরু হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে কাজ শুরু করার আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
মহাজোট সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকার অনুযায়ী কর্ণফুলীর তলদেশে টানেল নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী  শেখ হাসিনা। এরই অংশ হিসেবে ২০১৩ সালে টানেলটি নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাই করে সিসিসিসি ও হংকংয়ের ওভিই অরূপ অ্যান্ড পার্টনারস।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন