ইনকিলাব রিপোর্ট : সরকারের চলতি মেয়াদের প্রথম দুই বছর ১০টি মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যাপক তোড়জোড় লক্ষ্য করা গেলেও ক্রমেই তা স্তিমিত হয়ে আসছে। হঠাৎ দিক হারিয়েছে বৃহদাকার প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া। দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই সাতটিতেই। যেগুলোতে অগ্রগতি আছে সেগুলোতেও গত বছরের শেষদিকে অদৃশ্য কারণে গতি কমে আসে। এতে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না।
তবে শুধু মেগা প্রকল্পেই গতি কমেনি, গতি কমেছে এসব প্রকল্পে বিদেশি অর্থছাড়েও। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্র জানিয়েছে, বিদেশি অর্থছাড় কমে যাওয়াতেই গতি কমেছে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে।
এদিকে প্রকল্প বাস্তবায়নের ধীরগতি ধাপে ধাপে বাড়াচ্ছে ব্যয়। অর্থ সংকটের পাশাপাশি বড় প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন অদক্ষতার কারণে সময় লাগছে কয়েকগুণ বেশি। এতে প্রকল্পের ব্যয় বাড়ছে ২০০ থেকে ৩০০ শতাংশ পর্যন্ত।
মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার লক্ষ্যে ২ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ৩৬টি বৃহদাকার প্রকল্প হাতে নেয় বর্তমান সরকার। এর মধ্যে রয়েছে ফাস্টট্রাকে থাকা ১০টি প্রকল্পও। এগুলো বাস্তবায়নের সময় ধরা হয় ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সাল। তবে গত ৮ বছরে এসব প্রকল্পের সম্মিলিত কাজ শেষ হয়েছে মাত্র ২০ ভাগ। বাকি ৮ বছরে ৮০ ভাগ কাজ শেষ হওয়া নিয়ে ব্যাপক সংশয়ে রয়েছেন বিশ্লেষকরা। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে বিপুল পরিমাণ অর্থের জন্য সরকারের মূল ভরসার জায়গা হচ্ছে চীন, জাপান ও ভারতের বিনিয়োগ আগ্রহ।
তবে ইআরডি সূত্র জানিয়েছে, গত কয়েক মাসে হঠাৎ করে দেশ তিনটি প্রতিশ্রæত অর্থছাড় কমিয়ে দিয়েছে। এতে এসব অতি বৃহৎ প্রকল্প দূরে থাক, চলমান মেগা প্রকল্পগুলো নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ইআরডি’র হিসাবে, অর্থ-বছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) দেশগুলোর প্রকল্প সহায়তায় অর্থছাড় কমেছে সাড়ে ১৯ শতাংশ। টাকার অংকে এটা ২ হাজার ৮২৪ কোটি টাকা। এতগুলো বৃহদাকার প্রকল্প চলমান থাকাবস্থায় বিদেশি অর্থছাড় বাড়ার পরিবর্তে কেন কমলোÑ এমন প্রশ্নের উত্তর দিতে রাজি হননি অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের কেউ।
বিভিন্ন সমীকরণ মিলিয়ে তাই বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নয়টি মেগা প্রকল্পের মধ্যে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল আর রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজে কিছুটা দৃশ্যমান অগ্রগতি থাকলেও যে গতিতে কাজ চলছে তাতে নির্দিষ্ট সময়ে এসব প্রকল্প সমাপ্ত হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় আছে। আর বাকি ছয় প্রকল্পে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই।
এদিকে ফাস্টট্রাকের দশ প্রকল্পসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ ৩৬টি প্রকল্পে ধীরগতির জন্য ১০টি কারণ চিহ্নিত করেছে ইআরডি। এগুলো হলো : বৈদেশিক পরামর্শক নিয়োগে বিলম্ব, অনাপত্তিপত্র প্রাপ্তিতে দেরি ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সঠিক সময় সমীক্ষা প্রতিবেদন জমা না দেয়া। ক্রয় ও সংগ্রহের ক্ষেত্রে অনুমোদন প্রক্রিয়ায় বিলম্ব। প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে দক্ষ জনবলের অভাব। ভূমি অধিগ্রহণে দীর্ঘসূত্রতা। যথাযথ মনিটরিং এবং মূল্যায়নের অভাব। ক্রয় প্যাকেজের প্রক্রিয়াকরণে পুনঃদরপত্র আহŸান। আইন মন্ত্রণালয় থেকে ভেটিং প্রাপ্তিতে বিলম্ব এবং ঠিকাদারের কাজে শ্লথগতি। তবে নতুন আরেকটি কারণ উল্লেখ করেছেন ইআরডি’র কর্মকর্তারা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা ইনকিলাবকে বলেছেন, সাম্প্রতিক সময়ে বিদেশি প্রকল্প সহায়তার অর্থছাড় কমে যাওয়াতেও বাস্তবায়নের গতি কমে এসেছে।
২০১৮ সালের মধ্যে পদ্মা বহুমুখী সেতু, দোহাজারী-রামু-গুনদুম রেলপথ, পায়রা সমুদ্রবন্দর, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও এলএনজি টার্মিনালের কাজ শতভাগ শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল সরকার। পাশাপাশি মেট্রোরেলের প্রথম ধাপের কাজ ৮০ ভাগ, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ ৮০ ভাগ, পদ্মা রেলসেতু সংযোগ ও মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ ৩০ ভাগ শেষ করার কথা।
তবে এখন পর্যন্ত পদ্মা বহুমুখী সেতুর কাজ সম্পন্ন হয়েছে ৩৯ ভাগ। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ শেষ হয়েছে ৮২ ভাগ। মূল প্রকল্পের কাজ এখনও শুরু করা সম্ভব হয়নি। আর পায়রা সমুদ্র বন্দরের প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ ৩২ ভাগ শেষ হয়েছে। মেট্রোরেলের কাজ ৫ ভাগ, মৈত্রী সুপার থার্মাল (রামপাল) বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ ২ দশমিক ২ ভাগ এবং মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ শেষ হয়েছে মাত্র ১ দশমিক ৩ ভাগ।
এদিকে প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি যতটা ধীর, ব্যয় বৃদ্ধির গতি ততটা বেশি। বার বার ব্যয় সংশোধনের মাধ্যমে চলছে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন।
তিন ধাপে পদ্মা সেতু বাস্তবায়নে ব্যয় বেড়েছে ২৮৩ শতাংশ। ২০০৭ সালের আগস্টে যখন প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয় তখন ব্যয় নির্ধারণ করা হয় ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকা। ২০১১ সালের ১১ জানুয়ারি এই প্রকল্পের ব্যয় দ্বিগুণের বেশি বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হয় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। সর্বশেষ ২০১৬ সালের ৬ জানুয়ারি প্রকল্পের ব্যয় আরও ৮ হাজার ২৮৬শ’ কোটি টাকা বাড়ানো হয়। পদ্মা সেতু প্রকল্পের ব্যয় দাঁড়ায় ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকায়।
এদিকে ধাপে ধাপে ব্যয় বাড়লেও পদ্মা সেতু প্রকল্প সাড়ে তিন বছরে বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র ৩৯ ভাগ। আগামী ১ বছর ৯ মাসের মধ্যে শেষ করতে হবে বাকি ৬১ ভাগ কাজ যা এক প্রকার অসম্ভব বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
পদ্মা সেতুর সর্বশেষ কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় জানায়, জাজিরা প্রান্তে অ্যাপ্রোচ রোডের ৮৪ শতাংশ, মাওয়া প্রান্তে অ্যাপ্রোচ রোড শতভাগ, তিনটি সার্ভিস এরিয়া শতভাগ, মূলসেতু ৩৪ শতাংশ ও নদী শাসন কাজ ২৮ শতাংশ শেষ হয়েছে। প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৩৯ শতাংশের বেশি।
এদিকে ফাস্টট্রাকের অন্তর্ভুক্ত হলেও এখন পর্যন্ত কোনো অগ্রগতি নেই পদ্মাসেতু রেল সংযোগ প্রকল্পে। দক্ষিণ এশিয়ার আন্তঃদেশীয় রেল সংযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে এই প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। ৩৫ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পটি ২০২২ সালের মধ্যে শেষ করার কথা। তবে অর্থায়নের বিষয় চূড়ান্ত না হওয়ায় এখন পর্যন্ত কোনো দৃশ্যমান কাজ শুরু হয়নি প্রকল্পে। চলতি বাজেটে এই প্রকল্পের জন্য ৪ হাজার কোটি টাকার বেশি বরাদ্দ রাখা হলেও এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য কোনো ব্যয় হয়নি।
এদিকে ২২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে গাজীপুর থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল স্থাপনের প্রথম পর্যায় শেষ করার কথা ২০১৯ সালের মধ্যে। তবে জাপান অর্থছাড় সংকুচিত করে দেয়ায় ৫ শতাংশেই আটকে আছে বাস্তবায়ন হার।
পর্যটক ও ব্যবসায়ীদের চাহিদার প্রেক্ষিতে দোহাজারি-রামু-কক্সবাজার গুনদুম রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করা হয় যার ব্যয় ধরা হয়েছে ১৮ হাজার ৩০৪ কোটি টাকা। ২০২২ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন নির্মাণ ২০১৮ সালের মধ্যে শেষ করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তবে এখন পর্যন্ত এক ভাগ কাজও হয়নি প্রকল্পটির।
দেশের মধ্য ও দক্ষিণাঞ্চলের অনগ্রসরতা, আমদানি বৃদ্ধি এবং চট্টগ্রাম বন্দরের ভবিষ্যৎ ধারণ ক্ষমতা বিবেচনায় গ্রহণ করা হয় পায়রা সমুদ্রবন্দর প্রকল্পটি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৩ সালে পটুয়াখালীর কলাপাড়াা উপজেলার রাবনাবাদ চ্যানেলে পায়রা বন্দর নির্মাণ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০১৯ সালের মধ্যে বন্দরের প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ করার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র ৩২ শতাংশ।
কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ী ও ধলঘাটা ইউনিয়নে ৬০০ মেগাওয়াট করে দুটি কেন্দ্রের মাধ্যমে মোট ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে মাতারবাড়ী ১২০০ মেগাওয়াট কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়। অর্থায়ন জটিলতায় থমকে আছে প্রকল্পটি।
এদিকে দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের লক্ষ্যে সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করে সরকার। এ প্রকল্পটিও অর্থায়ন প্রশ্নে থেকে আছে।
এদিকে গ্যাস সংকট নিরসনে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির লক্ষ্যে মহেশখালী উপকূলে দৈনিক ৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহের ক্ষমতাসম্পন্ন এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের প্রকল্প গ্রহণ করে সরকার। ২০১৭ সালে প্রকল্পটি শেষ করার লক্ষ্যমাত্র থাকলেও এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নেই।
এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল কয়েকদিন আগে বলেছেন, অধিকাংশ বড় প্রকল্পে বৈদেশিক ঋণ রয়েছে যা প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব হওয়ার অন্যতম কারণ। বৈদেশিক সহায়তা পেতে আমাদের নানা প্রক্রিয়া পার করতে হয়। বাংলাদেশে দাতা সংস্থার অফিস কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারে না। এগুলোর প্রধান কার্যালয় থেকে সিদ্ধান্ত আসায় দেরি হয়Ñ যা প্রকল্প বাস্তবায়ন দীর্ঘায়িত করছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন