আহমেদ জামিল : গত ১৩ ডিসেম্বর দৈনিক ইনকিলাবে ‘শিক্ষা বাণিজ্যে বৈধতা’ শিরোনামে প্রকাশিত এক সংবাদ প্রতিবেদনে বলা হয়, “কোচিং ব্যবসা ও নোট-গাইড বইয়ের বিরুদ্ধে অনেক আগে থেকেই যুদ্ধে নেমেছেন শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ। এই ব্যবসায় ব্যবসায়ীরা বছরে ৩২ হাজার কোটি টাকা আয় করছে বলে জরিপ চালিয়ে তথ্যও তুলে এনেছেন। জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বারবার উচ্চারণও করেছেন তিনি। প্রস্তাবিত শিক্ষা আইনের খসড়ায় কোচিং ও নোট-গাইড বইয়ের সাথে জড়িতদের জেল-জরিমানার বিধান রেখে ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ...কিন্তু চূড়ান্ত খসড়ায় আনুষ্ঠানিকভাবে বৈধতা দেয়া হয়েছে শিক্ষা বাণিজ্যের। জেল-জরিমানার বিষয়টি তুলে দিয়ে সহায়ক বা অনুশীলন বই প্রকাশের ক্ষেত্রে অনুমোদন নেয়ার বিষয়টিও বাদ দেয়া হয়েছে। কোচিং ও প্রাইভেট টিউশনির বিরুদ্ধে আগের সেই কঠোর অবস্থান থেকে সরে এসে ‘ছায়া শিক্ষা’ হিসেবে কৌশলে এই বৈধতা দেয়ার প্রক্রিয়া চলেছে।”
শিক্ষা ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা ও সুষ্ঠু শিক্ষা ব্যবস্থা বাস্তবায়নের বিষয়ে যারা আশাবাদী ছিলেন তারা দৈনিক ইনকিলাবের এই সংবাদ প্রতিবেদন পড়ে যে হতাশ হবেন তাতে কোনই সন্দেহ নেই। ‘ছায়া শিক্ষা’ ব্যবস্থা যদি সত্যি বাস্তবায়িত হয় তাহলে শিক্ষা ক্ষেত্রে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন শিক্ষাবিদদের অনেকেই। এ যাবৎকাল কাগজ-কলমে কোচিং ও গাইড বই নিষিদ্ধ থাকলেও এবং এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী কঠোর অবস্থানের কথা বারংবার ব্যক্ত করলেও বাস্তবে কোচিং ও গাইড বইয়ের রমরমা বাণিজ্য ও দৌরাত্ম্য বহাল রয়েছে। আর তথাকথিত ‘ছায়া শিক্ষা’র খসড়া বাস্তবায়িত হলে কোচিং, নোট ও গাইড বই ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য যে আরো বেড়ে যাবে তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। এ ক্ষেত্রে কোনো আইনি নিষেধাজ্ঞা বা ন্যূনতম নিয়ন্ত্রণ না থাকলে মূলধারার শিক্ষা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
কোচিং এবং নোট ও গাইড বই ইস্যুতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এই পিছু হটার ক্ষেত্রে কাজ করেছে বিতর্কিত সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি। প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত চালু রয়েছে এই সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি। এই সৃজনশীল শিক্ষা ব্যবস্থা বা পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শিক্ষকদের জন্যও সৃষ্টি করেছে কঠিন পরিস্থিতির। কোনো পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়া, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সামর্থ্য মূল্যায়ন না করে শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ছাড়া এবং গোটা দেশের তৃণমূল স্তরের শিক্ষার্থীদের মেধা ও ধারণক্ষমতার বাস্তব দিকগুলো বিবেচনায় না এনে অনেকটা তড়িঘড়ি করে যুগোপযোগী শিক্ষা পদ্ধতি চালুর নামে এই সৃজনশীল শিক্ষা ব্যবস্থা বা পদ্ধতি চালু করা হয়। ফলে দেখে যায়, বিতর্কিত সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতির নেতিবাচক দিক ও কুফলগুলো অচিরেই প্রকাশ পেতে থাকে। শুরুতে বলা হয়েছিল, কোচিং ও গাইডবইনির্ভরতা কমানোর জন্য এই সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি। বাস্তবে বিপরীতটিই ঘটেছে।
সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি চালু হওয়ার পর কোচিং ও নোট-গাইডবইনির্ভরতা বেড়ে গেছে বহুগুণ। সেই সাথে শ্রেণী কক্ষে শিক্ষকরা পূর্বের মতো স্বাভাবিকভাবে পাঠদান করতে পারছেন না। ক্লাসের নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবইয়ের মৌলিক বিষয়ের সাথে সৃজনশীল পদ্ধতিতে পাঠদানে হিমশিম খাচ্ছেন। অন্যদিকে শিক্ষার্থীরাও কোনো বিষয়েই পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান অর্জন করতে পারছে না। সৃজনশীল পদ্ধতিতে তারাও হিমশিম খাচ্ছে। যে কারণে শিক্ষার্থীদের বড় অংশ কোচিং সেন্টারগুলোর শরণাপন্ন হওয়ার সাথে সাথে গাইড বইনির্ভর হয়ে পড়ছে। শিক্ষকদের একটি বড় অংশও এই গাইড বইনির্ভর হয়ে পড়েছেন। শিক্ষকদের কারো কারো এই গাইড বইনির্ভরতা শ্রেণী কক্ষে শুধু পাঠদানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই প্রশ্নপত্র প্রণয়নের ক্ষেত্রেও তা পরিলক্ষিত হচ্ছে। সৃজনশীল প্রশ্নপত্র প্রণয়নের জন্য শুধু প্রশিক্ষণই যথেষ্ট নয়, লেখনী ক্ষমতা ও দক্ষতারও প্রয়োজন রয়েছে। যা আমাদের শিক্ষকদের বড় অংশের মধ্যে নেই।
গত ২২ নভেম্বর দৈনিক ইত্তেফাকে ‘শিক্ষক নিজেই বোঝেন না সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি’ শিরোনামে এক সংবাদ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, “সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি প্রণয়নের ৬ বছর পেরিয়ে গেলেও অধিকাংশ শিক্ষক সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতিই বোঝেন না। এ কারণে এসব শিক্ষক নোট-গাইড থেকে প্রশ্ন করেন। আবার কোনো কোনো শিক্ষক অন্য স্কুলের প্রশ্ন ধার নেন। ... সরকারি হিসাবে সারাদেশে এ সংখ্যা (এ ধরনের শিক্ষক) ৪৫ ভাগ। আর শিক্ষক নেতাদের হিসাবে এ সংখ্যা ৮০ ভাগ।” অন্যদিকে ‘রিসার্চ ফর অ্যাডভান্সমেন্ট অব কমপ্লিট এডুকেশন’ শীর্ষক এক জরিপ রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছিল, মোট শিক্ষার্থীদের এক-চতুর্থাংশই পরীক্ষার প্রশ্ন বুঝতে অক্ষম এবং তাদের কাছে কঠিন মনে হয় বিশেষত গণিত ও ইংরেজির মতো বিষয়। এই জরিপ রিপোর্টে আরো বলা হয়, শিক্ষার্থীদের ৯২ শতাংশই গাইড বইনির্ভর। তাদের দুই-তৃতীয়াংশ সৃজনশীল পদ্ধতি বোঝার জন্য গৃহ শিক্ষকের সাহায্য নিচ্ছে।
এই গবেষণা জরিপ রিপোর্টে আরো উল্লেখ করা হয়, শিক্ষকদের ৪৫ শতাংশ সৃজনশীল পদ্ধতি বোঝেন, তাদের ৪২ শতাংশ অল্প অল্প বুঝতে পারেন। বাকি ১৩ শতাংশ এই পদ্ধতি বুঝতেই পারেননি। আবার যারা বুঝতে সক্ষম সেসব শিক্ষকের অর্ধেক পড়ানোর জন্য গাইড বইয়ের দারস্থ হয়ে থাকেন। যা হোক, এই সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি বা ব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রকৃত জ্ঞান অর্জনের পথে শুধু প্রতিবন্ধকতাই সৃষ্টি করেনি, সেই সাথে তাদের জন্য কঠিন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। সৃজনশীল প্রশ্নের জ্ঞানমূলক ও অনুধাবনমূলক অংশ পাঠ্য বইয়ের সাথে সম্পর্কিত হওয়ার কারণে পরীক্ষার্থীরা এই দুই অংশের প্রশ্নোত্তর সহজে প্রদান করতে পারলেও, প্রয়োগমূলক ও উচ্চতর দক্ষতামূলক প্রশ্নের উত্তর বহুলাংশে আনসিন তথা পাঠ্যবই বহির্ভূত হওয়ার কারণে শিক্ষার্থী তথা পরীক্ষার্থীদের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।
প্রয়োগ ও উচ্চতর দক্ষতামূলক প্রশ্নসমূহের উত্তরদানের জন্য পাঠ্যবই বহির্ভূত জ্ঞান এবং উদ্দীপকের সাথে সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তরদানে মেধা, দক্ষতা ও লেখনী ক্ষমতা থাকা দরকার- আমাদের শিক্ষার্থীদের বড় অংশের মধ্যে তা নেই। যে কারণে তাদের মধ্যে বাড়ছে কোচিংনির্ভরতা। আর শিক্ষার্থীদের বড় অংশের এই অসহায়ত্বের সুযোগ নিচ্ছেন ব্যবসায়ীমনা এক শ্রেণীর শিক্ষক। ব্যবসায়ীমনা এসব শিক্ষক শ্রেণীকক্ষে শিক্ষার্থীদের আন্তরিকতার সাথে যথাযথভাবে পাঠদানে অনাগ্রহী। তারা শিক্ষার্থীদের তাদের কাছে প্রাইভেট পড়তে এবং সংশ্লিষ্ট কোচিং সেন্টারে যেতে উৎসাহিত করেন। এসব শিক্ষক নামধারী মুনাফাখোররা শিক্ষকতার পেশার নীতি-আদর্শ জলাঞ্জলি দিয়ে চেম্বারের আদলে খুলছেন কোচিং সেন্টার। নিরুপায় শিক্ষার্থীরা এসব কোচিং সেন্টারে প্রতি মাসে ব্যয় করছে ৩ থেকে ১৫ হাজার টাকা।
এ ধরনের ব্যয়ভার বহন করা অধিকাংশ শিক্ষার্থীর অভিভাবকদের জন্যও ভীষণ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এই সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতির কাছে জিম্মি শুধু শিক্ষার্থীরাই নয়, অভিভাবকরাও। প্রসঙ্গের সূত্র ধরে বলা হচ্ছে, পাসের হার বেশি দেখিয়ে সরকার তার সাফল্যের আরেকটি নজির হিসেবে দেখানোর জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা নিয়ন্ত্রণকারী সরকারি অফিসগুলো থেকে পরীক্ষকদের প্রতি এ মর্মে অলিখিত নির্দেশ দেয়া হয়েছে- যেসব পরীক্ষার্থী প্রয়োগ ও উচ্চতর দক্ষতামূলক প্রশ্নের পুরোটা উত্তর ভুল লিখেও অন্তত একটি বাক্য সঠিক লিখলে তাদের পাস করিয়ে দিতে। অন্যদিকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনার্স ও পাস কোর্সের ইনকোর্স পরীক্ষায় কোনো পরীক্ষার্থী ফেল করলে কিংবা অংশ না নিলেও তাকে পাস করিয়ে দেয়ার অলিখিত নির্দেশ রয়েছে।
তাই বলা চলে, প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা নীতি-আদর্শবান ও কর্তব্যপরায়ণ শিক্ষকদের জন্য নৈতিক মূল্যবোধ, ন্যায়বোধ, সততা এবং আদর্শ বজায় রাখা কঠিন করে তুলেছে। এত পাসের হার ও মেধার ছড়াছড়ির পরও শিক্ষার মান মোটেই বাড়েনি। বরং অনেক বেশি কমে গেছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল এবং প্রকৌশল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে জিপিএ ফাইভ পাওয়া শিক্ষার্থীদের ভর্তি পরীক্ষায় ব্যাপক হারে অকৃতকার্য হওয়ার চিত্রের মাঝে প্রমাণ মিলে সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি শিক্ষার মান কতখানি কমিয়ে দিয়েছে। সৃজনশীলতার নামে শিক্ষা ব্যবস্থায় সৃষ্টি করা হয়েছে নৈরাজ্য। বৈশ্বিক পরিম-ল তো দূরে থাক দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের শিক্ষার মান এখন সবার নিচে।
বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের (ডব্লিউএফ) তথ্য বলছে, উচ্চ শিক্ষা থেকে প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার গুণগতমানে বাংলাদেশ বিশ্বের সর্ব নি¤েœ থাকা দেশগুলোর অন্যতম। পাকিস্তান ও নেপালের থেকেও পিছিয়ে আছে বাংলাদেশের শিক্ষার মান। তাই বলা চলে, সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতির ব্যর্থতা ঢাকতেই ‘ছায়া শিক্ষা’ ব্যবস্থার নামে কোচিং, প্রাইভেট টিউশনি, নোট ও গাইড বইয়ের আইনি বৈধতা দেয়া হচ্ছে। এতে করে শিক্ষার মান বৃদ্ধির কোনোই সম্ভাবনা নেই। বরং এতে ব্যবসায়ীমনা মুনাফালোভী একশ্রেণীর শিক্ষকের দৌরাত্ম্য আরো বেড়ে যাবে। তারা শ্রেণী কক্ষে শিক্ষার্থীদের আন্তরিকতার সাথে পাঠদানে আরো অনীহা প্রদর্শন করবেন। যার ফলে শিক্ষার অপ্রচলিত খাতে ব্যয় আরো বৃদ্ধি পাবে। শিক্ষা বাণিজ্যে বৈধতাদান করার উদ্যোগের মাঝে বর্তমান সরকারের আরো অনেক কিছুর মতো স্ববিরোধী আচরণের প্রকাশ ঘটেছে। তাছাড়া, সৃজনশীলের মতো ‘ছায়া শিক্ষা’কেও এক ধরনের ‘শিক্ষা প্রতারণা’ বলা যেতে পারে।
য় লেখক : কলামিস্ট
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন