বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আদিগন্ত

মানবতাবাদী কবি আল্লামা ইকবাল

| প্রকাশের সময় : ২৩ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ইবরাহিম রহমান
ওঠো-দুনিয়ার গরীব ভুখারে জাগিয়ে দাও।
ধনিকের দ্বারে ত্রাসের কাঁপন লাগিয়ে দাও ॥
কিষান-মজুর পায় না যে মাঠে শ্রমের ফল
সে মাঠের সব শস্যে আগুন লাগিয়ে দাও॥
একজন সাধারণ পাঠকের ধারণা হবে কবিতার উপরোক্ত চারটি লাইন হয়তো সুকান্ত বা নজরুলের কবিতা থেকে উদ্ধৃত। বাস্তবে এই চারটি লাইন যে মহাকবি ইকবালের কবিতা থেকে উদ্ধৃত তা ইকবালকে নিয়ে পড়া-শোনা গবেষণা না করলে বোঝা যাবে না। ইকবাল যে প্রকৃতই নিপীড়িত মানুষের কবি, গণমানুষের কবি তার কবিতা না পড়লে সেটা বোঝা যায় না।
ইসলামী আদর্শের অমলিন রূপকার এবং স্বদেশ ও স্বজাতির জাগরণের বাণী বাহক ইকবাল মূলত মানবতাবাদী কবি। তাঁর কবিতার আবেদন ও সৃষ্টিশীল বার্তা তাই বিশ্বমানবতার কাছেই। ইকবালের কবিতার এই বিশ্বজনিন আবেদনের জন্য তো বটেই পাশাপাশি মুসলিম জাগরণ ও ইসলামী আদর্শের বাণী বাহক বলেও তাঁর কবিতা ও রচনার চিরন্তন আবেদন বিশ্বব্যাপী প-িত, বুদ্ধিজীবী, বিদ্বজ্জন মহলে এবং সকল শ্রেণীর পাঠক মহলে ব্যাপকতর ও গভীরতম মূর্ছনা নিয়ে উপস্থিত। আশ্চর্যের বিষয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সমাদৃত হলেও বাংলাদেশে ইকবাল যেন অপাঙ্ক্তেয়। ভারতের জাতীয় কবি নোবেল জয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে যে পরিমাণ গুরুত্ব দেওয়া হয় তার পাশাপাশি আল্লামা ইকবালকে নিয়ে সে পরিমাণ আলোচনা দূরে থাক ইকবালের নাম উচ্চারণ করতেও যেন একটি অপরাধ বোধ কাজ করছে। যদিও আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পাশাপাশি আল্লামা ইকবালও এক সময় বাংলা ভাষাভাষী পাঠকের কাছে সমভাবে সমাদৃত ছিল। স্বাধীনতার পর থেকেই ইকবাল যেন আমাদের কাছ থেকে অনেকটাই দূরে সরে গেছেন। অথচ, পাকিস্তানের সাথে ভারতের চরম শত্রুতার সম্পর্কের মধ্যেও আল্লামা ইকবাল ভারতে সমভাবে সমাদৃত।
পাকিস্তানের নাম উচ্চারণ ভারতে একেবারেই অপাঙ্ক্তেয় হলেও আল্লামা ইকবালের ক্ষেত্রে তা মোটেও প্রযোজ্য নয়। ভারতের সুধী সমাজে আল্লামা ইকবাল ব্যাপক আলোচিত ও শ্রদ্ধার পাত্র।
যা হোক বাংলা ভাষাভাষীদের কাছে আল্লামা ইকবাল মোটেও অপরিচিত কোন নাম নয়, নয় আল্লামা ইকবাল কোন অপরিচিত কবি। বিশের দশক থেকেই তাঁর জীবনবাদী ও মানবতাবাদী কবিতা বাংলা ভাষায় অনূদিত হয়ে আসছে। দার্শনিক কালজয়ী তথ্য ও আদর্শ সমৃদ্ধ গ্রন্থ  ‘জবপড়হংঃৎঁপঃরড়হ ড়ভ জবষরমরড়ঁং ঃযড়ঁমযঃ রহ ওংষধস’ ও ‘প্রজ্ঞান চর্চায় ইরান’ বাংলা ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এছাড়াও তাঁর আরও বহু গ্রন্থ বাংলায় অনূদিত হয়েছে। বিশ্ব মানবতাকে ধ্বংসের গভীর আবর্ত থেকে উদ্ধার করার যে আর্তি মহাকবি ইকবালের কবিতায় ফুটে উঠেছে তার অন্তরঙ্গ সুর বাংলার মানসকে আচ্ছন্ন করেছে। বিশেষ করে, বাংলার মুসলিম মানস তাঁর কবিতার মধ্যে আত্ম আবিষ্কারের সন্ধান পেয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় ইকবাল অনূদিত হয়েছেন। মানবতাবাদী কবি হিসেবে তিনি বিশ্বের সর্বত্র সমাদৃত হয়েছেন, হচ্ছেন, হবেন এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আল্লামা ইকবালের ওপর গবেষণা অব্যাহত রয়েছে। তাঁর কবিতা, গজল, মর্সিয়া এবং গান হতাশাগ্রস্ত মানুষের মনে আশা ও আকাক্সক্ষার জন্ম দিয়েছে।
ইতিহাসের এক অশান্ত পরিবেশে ১৮৭৭ খৃষ্টাব্দের ৯ নভেম্বর শুক্রবার ৩ জিলকদ ১২৯৪ হিজরি ফজরের আযানের সময় বর্তমান পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের শিয়ালকোট নগরীতে এক মধ্যবিত্ত সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ইকবাল। একতলা একটি জীর্ণ বাড়ীর যে প্রকোষ্ঠে তার জন্ম তা এখনো পাকিস্তান সরকারের প্রতœতত্ত্ব বিভাগের তত্ত্বাবধানে সংরক্ষিত। দেশ-বিদেশের পর্যটকদের জন্য এটি একটি দর্শনীয় স্থান।
ইকবালের পূর্ব পুরুষগণ কাশ্মীর থেকে হিজরত করে শিয়ালকোটে বসতি স্থাপন করেন। গবেষণায় পাওয়া যায় ইকবালের আদিপিতা ছিলেন বাবা লোল হাজ বা লোল হাজী। স্বয়ং ইকবালই এই তথ্য প্রকাশ করেন। তাঁর পিতার নাম শেখ নূর মুহাম্মদ। তিনি ছিলেন শিয়ালকোটের অন্যতম টুপি ব্যবসায়ী। মধ্যবিত্ত পরিবারের শিশু ইকবাল মাওলানা গুলাম হাসান ও সৈয়দ মীর হাসানের কাছে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। স্কচ মিশন স্কুলের শিক্ষক সৈয়দ মীর হাসান মুসলমানদের মধ্যে আধুনিক শিক্ষা প্রবর্তনে খুব আগ্রহী ছিলেন। পিতা শেখ নূর মুহাম্মদের অনুমতিক্রমে ইকবালকে তিনি স্কচ মিশন স্কুলে ভর্তি করেন। প্রাথমিক স্তর থেকে দশ বৎসর কাল তিনি সৈয়দ মীর হাসানের তত্ত্বাবধানে শিক্ষা গ্রহণ করেন। দূরদৃষ্টি সম্পন্ন সৈয়দ মীর হাসান অভিনব পদ্ধতিতে প্রশিক্ষণ দিয়ে তরুণ ইকবালের মনে ঐকান্তিক পিপাসা জাগিয়ে তোলেন। ১৮৮৮ সালে প্রাথমিক, ১৮৯১ সালে মিডল এবং ১৮৯৩ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় বৃত্তি ও মেডেলসহ উত্তীর্ণ হন। ১৮৯৫ সালে ইকবাল ঐ কলেজ থেকে এফএ পাস করেন এবং একই বৎসর ১৮ বৎসর বয়সে উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশ্যে লাহোর গমন করেন। লাহোর সরকারি কলেজ থেকে ১৮৯৭ সালে ¯œাতক ও ১৮৯৯ সালে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন।
একই বৎসর তিনি লাহোরের ওরিয়েন্টাল কলেজে ইতিহাস ও দর্শন শাস্ত্রে অধ্যাপনার চাকুরী গ্রহণ করেন। ১৯০১ সালে লাহোর সরকারি কলেজে ইংরেজি ও দর্শন শাস্ত্রে সহকারী অধ্যাপক নিযুক্ত হন। ইংরেজি আরবি ও দর্শনে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জনকারী ইকবালের শিক্ষা জীবনে দ্বিতীয় শিক্ষক মীর হাসানের গভীর জ্ঞান এবং কলেজ জীবনে দর্শনের শিক্ষক টমাস আরনল্ড তাঁর জীবনে প্রবল প্রভাব ফেলেছিল। টমাস আরনল্ডের উৎসাহে ১৯০৮ সালে যুক্তরাজ্যের খরহপড়ষহং ষহহ থেকে ব্যারিস্টারি ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি পাশাপাশি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ ডিগ্রি অর্জন করেন। এছাড়াও তিনি জার্মানী থেকে দর্শনে পিএইচডি অর্জন করেন। ১৯১২ সালে এক নতুন ইকবাল স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। তদানীন্তন বিশ্ব পরিস্থিতিতে মুসলিম বিশ্বের অধঃপতনে তিনি চিন্তিত হয়ে পড়েন। মুসলমানদের এই দুঃসময়ে এক ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে লক্ষ করেন যে, তুর্কী সা¤্রাজ্য তখন নামেমাত্র ইসলামী রাষ্ট্র। পূর্ব ইউরোপ থেকে ইসলাম ধীরে ধীরে নির্বাসিত হচ্ছিল। দক্ষিণ রাশিয়ার মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে রুশ স¤্রাট একে একে গ্রাস করছিল। চীনের মুসলমানরা নিজেদের রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা হারিয়ে হতাশ হয়ে পড়ছিল। ব্রিটিশ করায়ত্ব করে নিয়েছিল মিসর। ফ্রান্স মরক্কো দখলের ফন্দি করছিল। ইরানের অবস্থা ছিল মুমূর্ষু। ওলন্দাজ উৎপীড়নে ইন্দোনেশিয়ার মুসলমানরা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারছিল না।
১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবের পর থেকে ভারতীয় মুসলমানদের ভাগ্যেও নেমে এসেছিল চরম দুর্দিন। এমনি নিঃসহায় অবস্থায় ভারতীয় মুসলমানদের আশা-ভরসার উৎস ছিল ওসমানীয় খেলাফত। তুর্কীরাই তখন সীমিত পরিসরে হলেও কিছুটা স্বাধীনতা অক্ষুণœ রাখতে সক্ষম হয়েছিল। তুর্কীদের দিকেও হায়েনার লোলুপ দৃষ্টি পড়েছিল। মুসলমানদের এই শেষ সম্বল তুরস্ককেও তারা গ্রাস করতে থাবা বিস্তার করছিল। ওদিকে ব্রিটিশরা তুর্কীদের বিরুদ্ধে গ্রিসকে লেলিয়ে দেয়। এতে ভারতীয় মুসলমানরা ব্রিটিশের উপর ক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে। সেই যুগসন্ধিক্ষণে যেসব তরুণ মুক্তি আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তাদের সম্মুখভাগে ছিলেন আধুনিক বিশ্বে ইসলামের সময়োপযোগী ব্যাখ্যাকার, ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলনের অগ্র সেনা, মানবতার মুক্তিকামী বিদ্রোহী, কলম যুদ্ধের অকুতোভয় সৈনিক মহাকবি ইকবাল।
ইকবাল তন্দ্রাচ্ছন্ন মুসলিম জাতিকে আমৃত্যু কাব্যের চাবুক মেরে জাগ্রত করার প্রয়াস পান। সে সময়ের প্রেক্ষাপটে এমন কোনো দিক ছিল না, যে বিষয়ে তিনি তার মেধাকে ব্যবহার করেননি। কাশ্মীর, আফগানিস্তান, ফিলিস্তিন, স্পেন, ইন্দোনেশিয়াসহ প্রতিটি রাষ্ট্রের সমস্যা নিয়েই তিনি দিকনির্দেশনা সম্বলিত দরদমাখা কাব্য রচনা করেন। মুসলিম জাতি তাঁর কাব্যে ইতিহাস, ঐতিহ্য ও হৃত গৌরবের কথা স্মরণ করে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে থাকে। তাদের সম্বিৎ ফিরে আসতে শুরু করে।
ইকবাল নিছক কবি বা দার্শনিকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন দূরদর্শী রাজনীতিকও। সবচেয়ে বড় কথা, ইকবাল ছিলেন ব্যতিক্রমধর্মী কবি, ভাবুক ও রাজনীতিক, গতানুগতিকতার সোজাপথ ছেড়ে যে কবি দার্শনিক সম্পূর্ণ এক নতুন পথে এগিয়ে গেছেন, তিনিই হলেন মহাকবি আল্লামা ইকবাল। তিনি কাব্যকে করেছেন জাতি গঠনের হাতিয়ার। এই বিশাল ব্যক্তি উর্দু, ফার্সী ও ইংরেজি ভাষায় মুসলিম উম্মাহকে যে পথের দিশা দিয়ে গেছেন তা সম্পূর্ণ কোরআন, হাদিস, ইসলামের ইতিহাস, ঐতিহ্যের নির্যাস। তার রচনা সমগ্রে মিশে আছে ইসলাম। ইকবাল ‘আট ফর আর্টস সেক’-এ বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি বিশ্বাস করতেন শিল্পে জীবনের জন্য আর সে জন্যই তিনি নির্জীব জাতিকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য কবিতাকে ব্যবহার করেন। তাঁর পদ্য-গদ্য যে কোনো রচনার উদ্দেশ্য ছিল শুধুমাত্র মুসলিম মিল্লাত, মুসলিম জাতির ঐক্য ও সংহতি। তিনি মুসলিম বিশ্বকে একক প্ল্যাটফর্মে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য আমৃত্যু কলমসৈনিক হিসেবে সংস্কার আন্দোলন চালিয়ে গেছেন। ইকবালের প্রত্যাশা ছিল ইসলাম একদিন বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবেই।
আল্লামা ইকবাল একটি যুগের ¯্রষ্টা, একটা নতুন রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা, রূপকার। পাক ভারতীয় মুসলমানদের নিদমহলার মুয়াজ্জিন। তাঁর জ্যোতির্ময়ী বাণী মুসলিম জাহানে এনেছে নবজাগরণ। তিনি তাঁর স্বপ্নের রাষ্ট্রের কথা ব্যক্ত করতে গিয়ে এলাহাবাদে মুসলিম লীগের বার্ষিক সম্মেলনে ভারতে একটি স্বতন্ত্র মুসলিম রাষ্ট্রের দাবি জানিয়ে বলেন, আমি ভারত ও ইসলাম দুয়েরই বৃহত্তর স্বার্থে একটি স্বতন্ত্র মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি জানাচ্ছি।
একজন মহৎ মানবতাবাদী কবি হিসেবে যেমন রয়েছে তাঁর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, তেমনি ইসলামের অতি আধুনিক ব্যাখ্যাদাতা হিসেবেও তিনি সমান গৌরবের অধিকারী, পরাধীনতার শিকলে আটকেপড়া জাতির বুকফাটা কান্না তাঁকে বিচলিত করেছিল। তুরখাম থেকে আরাকান পর্যন্ত তিনি অভিনন্দিত হলেন গণমানুষের কবি হিসেবে। জনতার ভাষায় তিনি কবিতা লিখতেন, জনতার ভাবনা ও বেদনাকে তিনি স্থান দিতেন তাঁর কবিতায়, আর সেই জনতাকে মুক্তির মঞ্জিলে মকসুদে পৌঁছানোর নিরলস প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেন আমৃত্যু। কোরআনুল কারীমের বিশাল প্রাঙ্গণ, হাদীস শরীফ এবং ইসলামের ইতিহাস-ঐতিহ্য ছিল ইকবাল কাব্যের সারবস্তু। ইসলামকে তিনি একটি গতিহীন ধর্মের কতকগুলো সূত্র সর্বস্ব ব্যবস্থাপত্র মনে করতেন না। তাঁর কাছে ইসলাম ছিল এক প্রাণ প্রাচুর্যময় উন্নত জীবনের প্রতীক। তাঁর প্রত্যয় ছিল কোরআনের আদর্শের সুষ্ঠু অনুসরণ ও অনুশীলনই বিপর্যস্ত মুসলিম প্রাণে নয়া জিন্দেগীর তরঙ্গ সৃষ্টি করতে পারে।
ইকবালের রচনা : ইকবালকে উর্দু ভাষার কবি বলা হলেও একই সঙ্গে তিনি উর্দু ও ফার্সী ভাষার কবি। ইকবালের ১১টি কাব্যগ্রন্থের মধ্যে ৮টি ফার্সী ভাষায় ও ৩টি উর্দু ভাষায় লিখিত। তাঁর কবিতা লেখার সময়কাল ১৯০৮ থেকে ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দ। তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘শিকওয়া’ এবং ‘জবাব-ই শিকওয়া’। ১৯১৫ সালে ‘আসরার-ই-খুদী’ এবং ১৯১৮ সালের ‘রমুয-ই বেখুদী’ প্রকাশিত হয়। ১৯৩২ সালে ইকবালের ‘জাবিদনামা’ প্রকাশিত হয়। ফার্সী ভাষায় রচিত এই কাব্যগ্রন্থ কনিষ্ঠপুত্র জাবিদের নামে নামকরণ করেন তিনি।
আল্লামা ইকবালের জীবন ও কাব্যে জালাল উদ্দিন রুমির প্রভাব অত্যাধিক। উল্লেখ্য, ইকবাল কেবলমাত্র কবিতা বা কাব্য লেখকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন অতিউচ্চমানের চিন্তাশীল প্রবন্ধ লেখকও। আল্লামা ইকবালের চিন্তার গভীরতার জন্যেই ইকবালের কবিতা শুধু মুসলমানের জন্য নয়, গোটা বিশ্বমানব সমাজের জন্য হয়ে ওঠে নতুন চিন্তার দিকদর্শন, কেননা তিনি যে সংকট ও সমস্যার কথা চিন্তা করেছিলেন তা শুধু মুসলিম সমাজের নয়, বিশ্বসমাজের সমস্যা। ইকবালের অসংখ্য কাব্য, প্রবন্ধের মধ্যে আসরার-ই-খুদীকে বলা হয় ইকবালের শ্রেষ্ঠ রচনা।
রাজনৈতিক জীবন: ইকবাল ১৯০৮ সালে অষষ ওহফরধ গঁংষরস খবধমঁব-এর ব্রিটিশ কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯১১ সালে পাঞ্জাবে চৎড়ারহপরধষ ঊফঁপধঃরড়হধষ পড়হভবৎবহপব-এর সেক্রেটারি নিযুক্ত হন। ১৯১৯-এর ৩০ ডিসেম্বর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসানের পর মিত্রশক্তি কর্তৃক তুর্কীদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক অবরোধের প্রতিবাদে লাহোরের মুচিগেটে অনুষ্ঠিত জনসভায় ভাষণ দেন ও প্রস্তাব পেশ করেন। ১৯২৬ সালে পাঞ্জাবের লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯২৭-২৮ সালের ৫ মার্চ পাঞ্জাব আইন সভার বাজেট অধিবেশনে ভাষণ দেন। ১৯২৮ সালে ২৩ ফেব্রুয়ারি ভূমি রাজস্বের উপর আয়কর উসুল করার প্রস্তাবের উপর পাঞ্জাব আইন সভায় ভাষণ দেন। ২৯ ডিসেম্বর দিল্লীতে অনুষ্ঠিত অষষ চধৎঃু গঁংষরস ঈড়হভবৎবহপব-এ ভাষণ এবং মুসলমানদের স্বতন্ত্র কার্যক্রম গ্রহণ করার পরামর্শ দেন। ১৯৩০-এর ২ মে প্রথম নির্বাচনের দাবিতে লাহোর মুচিগেটে এক জনসভায় সভাপতিত্ব করেন। ২৯ ডিসেম্বর এলাহাবাদে মুসলিম লীগের ঐতিহাসিক বাৎসরিক সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে উত্তর-পশ্চিম ভারতে একটি স্বতন্ত্র ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক প্রস্তাব পেশ করেন।
বৈবাহিক জীবন: ১৮৯৩ সালে গুজরাটের সিভিল সার্জন খান বাহাদুর আতা মুহম্মদের ১৯ বৎসর বয়স্কা কন্যার সাথে ১৬ বৎসর বয়স্ক ইকবালের বিয়ে হয়। পিতার ইচ্ছায় এই বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। এই স্ত্রীর গর্ভে এক কন্যা ও এক পুত্রের জন্ম হয়। ১৯১৯ সালে এই বিয়ের বিচ্ছেদ ঘটে। ১৯০৯ সালে লাহোরের মুচিগেটের এক কাশ্মীরী পরিবারের সরদার বেগমের সাথে ইকবালের দ্বিতীয় বিয়ে হলেও ১৯১৩ সালে এই স্ত্রীকে গৃহে তুলে আনেন। ১৯২৪ সালে এই স্ত্রীর গর্ভে জাবিদ ইকবাল জন্মগ্রহন করেন। ১৯১২ সালে লুধিয়ানাবাসী নওলাক্ষা পরিবারের কন্যা মোখতার বিবির সাথে ইকবালের তৃতীয় বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। ১৯২৪ সালে সন্তন প্রসবকালে এই স্ত্রী মৃত্যুবরণ করেন।
১৯১০ সালে ইকবালের মাতা ও ১৯৩০ সালে তাঁর পিতা ইন্তেকাল করেন। আল্লামা ইকবালের সুযোগ্যপুত্র বিচারপতি ড. জাবিদ ইকবাল ‘যিন্দা রোদ’ নামে তাঁর উর্দু জীবনীগ্রন্থ ১৯৭৯ সালে প্রকাশ করেন যা সকল মহলে সমাদৃত হয়।
মৃত্যু: ১৯৩৮ সালের ২১ এপ্রিল ভোর ৫টা ১৪ মিনিটে চতুর্দিকে আযান ধ্বনির সময় ৬০ বৎসরের কিছু ঊর্ধ্বে ইন্তেকাল করেন। এ খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে সরকারি অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ ও সকল প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। বহু জানাজার পর হাজার হাজার ভক্ত-অনুরক্তকে কাঁদিয়ে রাত পৌনে দশটার দিকে রাসূল প্রেমে বিভোর ইসলামের পুনরুজ্জীবনের একজন নিরাপস প্রবক্তার লাশ শাহী মসজিদে চত্বরে তাঁবুতে ভরে কবরে রাখা হয়।
য় লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Tarek ২৩ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১:১৯ এএম says : 0
very nice writing
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন