ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার ২৭তম আসরের স্থায়ী প্যাভিলিয়নে চলছে ২য় আসর। দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা, যোগাযোগ ব্যবস্থার কিছুটা উন্নতি আর বিশাল পরিসর ছাড়া যেন নেই কোন সুবিধা। তাই মেলার ভেতর আর বাহিরে অনিয়মের অন্ত নেই। বাণিজ্য মেলার আসর জমে ওঠেছে সরকারি ছুটির দিনগুলোতে।
ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় প্রায় সব স্টলে অতিরিক্ত অর্থ আদায় থেকে শুরু করে হকারের উৎপাত, মেলার অব্যবস্থাপনাসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ ক্রেতা-দর্শনার্থীদের। এ ছাড়া নামে-বেনামে ও অনুমোদনহীন স্টলসহ নানা অনিয়মে রফতানির সফলতাকে অনেকটাই মøান করে দিচ্ছে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। দেশি পণ্য বিদেশি বলে গ্রাহকের সঙ্গে হর হামেশাই প্রতারণা চলছে। এখানেই শেষ নয়, সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিতেও একাধিক হিসাবের খাতা ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে। গতকাল মেলা প্রাঙ্গণ ঘুরে এমনই চিত্র দেখা যায়।
সরেজমিনে ঘুরে আরো দেখা যায়, বাণিজ্য মেলায় বরাদ্দ দেয়া স্টলগুলো যার নামে বরাদ্দ দেয়া তার নামে সাইনবোর্ড থাকলেও পরিচালনা করছে অন্য পক্ষ। অভিযোগ রয়েছে এসব পক্ষ হাত বদল করে স্টল পাওয়ার। মুল বরাদ্দপ্রাপ্তকে নির্ধারিত অঙ্কে মুনাফা দিয়ে ভিন্ন লোকজন পরিচালনা করছে প্যাভিলিয়ন ও স্টল। এদিকে মেলার নিয়মানুসারে একই নামে একাধিক প্রতিষ্ঠান চলার নিয়ম না থাকলেও মেলায় এমন স্টলের সংখ্যাও একাধিক। তারা নিয়ম বহির্ভূতভাবে ব্যবসা চালাচ্ছেন। এদিকে ফরেন কোটায় বরাদ্দ নেয়া স্টলের ভেতরেও রয়েছে দেশি স্টল। এ ছাড়া দেশি পণ্য বিদেশি নামে বিক্রি করে পকেট কাটা হচ্ছে ক্রেতাদের। ৩৩৩টি স্টলের মাঝে ৩১৮টি বরাদ্দ দেখালেও প্ল্যানের বাইরে রয়েছে বেশ কয়েকটি খাবারের দোকানসহ বেশ কিছু দোকান। এ ছাড়া মেলার ভেতরে ও বাইরে ভাসমান হকার ও ভিক্ষুকের উৎপাত তো রয়েছেই। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে মেলার পরিচালক, রপ্তানী উন্নয়ন ব্যুরোর সচিব ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী বলেন, মেলায় কোন প্রকার অনিয়ম হয়নি। তবে একটি সমিতির নামে কিছু স্টল অতিরিক্ত ছিল। যা এখনো দেয়া সম্ভব হয়নি। এসময় এক্সপোর্ট প্রমোশন ব্যুরো (ইপিবি) সচিব আরো বলেন, মেলার ভেতরে আমি দেখবো কিন্তু বাইরে কি হচ্ছে তা আমার দায়িত্ব নয়।
এদিকে মেলার ভেতরে থাকা খাবার হোটেলের সব রকম খাবারের দাম রাখা হচ্ছে তাদের মনগড়া। শীশেল নামীয় খাবারের হোটেলে মেনু বুক টেবিলে না দিয়ে বয়দের হাতে রাখা হয়, বিলের কাগজ গ্রাহককে প্রথমে দেখালেও কৌশলে ছিড়ে ফেলা হয়। কারণ হিসেবে মেলায় আসায় বাড্ডার বাসিন্দা রেজাউল করিম বলেন, ১৫ টাকার মিনারেল ওয়াটার বোতল মেলার ভেতরে ২৫ টাকা করে রাখা হচ্ছে। পাশেই পুলিশ কন্ট্রোলরুম, ভোক্তা অধিকার ক্যাম্প থাকলেও তারা যেন নির্বিকার। কথা হয় ফুড বাংলোর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মচারীর সঙ্গে। তিনি বলেন, মেলা থেকে স্টল পেতে বড় অঙ্ক খরচ করা হয়েছে। ফলে ওই টাকা ওঠাতে দুরকম রশিদ ব্যবহার করতেছে অন্য সব খাবার হোটেলে। কিন্তু ফুটবাংলো তা করেনি। তবে ক্ষতি পোষাতে মোটা চালের ভাত, ব্রয়লার বা কক মুরগীর ব্যবহার ও মানে কিছুটা ছাড় দিতে হচ্ছে। এভাবে অন্যরাও লোকসান কাটাতে কিছুটা দাম বেশি নিচ্ছে। কিছুই করার নাই। মেলায় বড় করে লেখা ফরেন প্যাভিলিয়ন ও পাকিস্তান প্যাভিলিয়নে দেশি কাপড় রাখার চিত্রও দেখা গেছে মেলায়। যদিও অস্বীকার করেন স্টলে থাকা কর্মচারীরা। কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করে ব্যবসা চলছে বলে জানিয়েছে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দোকানের এক কর্মচারী। এর জন্য তাদের প্রতিদিন মোটা অঙ্কের চাঁদা গুনতে হয়। মেলায় প্রবেশে ক্রেতা দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভীড় দেখা গেছে। মেলায় প্রবেশের সময় বাস থেকে নামলেই হকার আর বিকাশকর্মীদের নানা অফারে কিছুটা বিব্রত হচ্ছে মেলায় আগতরা। তবে বিকাশের দেয়া ৫০% ছাড়ের অফার স্বাচ্ছন্দে নিচ্ছেন অনেকে। আবার মেলার প্রবেশের পর গুলিস্তানের বঙ্গবাজারের মতো কর্মচারীদের হাঁক ডাকে পুরোই ব্যস্ততা মেলা প্রাঙ্গণে। কিন্তু সেখানেও নিম্নমানের পণ্যে আকাশ ছোঁয়া মুল্য শুনে দিশেহারা। অনেকেই হাত ধরে দেখে দেখে দাম শুনে মুখভার করে ফিরে যাচ্ছেন বাসায়।
অন্যদিকে বিদেশি প্যাভিলিয়নে দেশি পণ্য বিদেশি বলে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করা হচ্ছে গ্রাহকের কাছ থেকে। ফরেন প্যাভিলিয়নের কর্মচারী মাহিম ভূঁইয়া বলেন, এসব প্যাভিলিয়নে স্টল পেতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। অতিরিক্ত অর্থ দেয়া ছাড়াও বড় মাপের লবিং থাকতে হয়। বললেই তো আর বাণিজ্য মেলায় স্টল বরাদ্দ পাওয়া যায় না। এ ছাড়া যে পরিমাণে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে তা পরিশোধ করতে হলে ভালো মুনাফা করতে হবে। আর নয়তো লোকসান হবে।
এদিকে মেলা প্রাঙ্গণে খাবারের দোকানে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের পাশাপাশি বিদেশি পণ্যের মোড়কে দেশি পণ্য বিক্রিরও অভিযোগ করছেন মেলায় আগত মধুখালীর বাসিন্দা আরমান হুসেইন। তিনি বলেন, ইরানি স্টল ও ফরেন প্যাভিলিয়নের বেশকিছু স্টলে দেশি পণ্য বিদেশি বলে ক্রেতার কাছ থেকে গলাকাটা দাম রাখা হচ্ছে। ৫ হাজার টাকা মুল্যের শতরঞ্জির দাম হাঁকা হচ্ছে ২০ হাজার টাকা।
এদিকে প্রতিদিনই ভোক্তা অধিদফতরে পড়ছে বিস্তর অভিযোগ। মেলা শুরুর পর থেকে একের পর এক জরিমানা করার পরও থেমে নেই এসব অনিয়ম। এ ছাড়া পণ্য বিক্রিতে প্রতারণা, অনুমোদনহীন ভাসমান স্টল ছাড়াও বেশ কিছু অনিয়ম রোধ করার ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও আইনি জটিলতায় তা পারছে না সংস্থাটি। কারণ এসব অনিয়ম প্রতিকারের ব্যবস্থা নেবে মেলা কর্তৃপক্ষ। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে কর্তৃপক্ষ নীরব ।
গাড়ী পার্কিং ব্যবস্থা নিয়েও অভিযোগ কম নয়। মেলার পার্কিং করে রাখা মোটরসাইকেল থেকে হেলমেট চুরির ঘটনাও ঘটছে। মিরপুর থেকে আসা রুবেল মোল্লা বলেন, গত ১৩ জানুয়ারী মেলার উত্তরপাশে পুলিশের হেফাজতে রাখা বাইক থেকে হেলমেট চুরি হয়ে যায়। এ বিষয়ে শহিদুল নামের গাজীপুর থেকে আসা মেলায় দায়িত্বরত পুলিশের এক এএসআইকে মৌখিক জানালে তিনি কিছুই করার নেই বলে তাড়িয়ে দেন। এছাড়াও পুলিশের নিয়ন্ত্রণে মেলার বাইরে অবৈধ খাবার হোটেল থেকে মাসিক ও দৈনিক হারে চাঁদা নিয়ে সুযোগ করে দেয়ার রয়েছে অভিযোগ।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে মেলার দায়িত্বরত নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আমির খসরু বলেন, মেলা অতীতে যেভাবে পরিচালিত হতো, এখনো তাই হচ্ছে। এখানে পুলিশকে যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তা পালন করছে। কোনো পুলিশ সদস্য বাইরে অতিরিক্ত অবৈধ খাবার স্টল বসানো কাজে জড়িত নয়। পার্কিং টিকেট এটা মেলার সিদ্ধান্তেই পুলিশ পরিচালনা করছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন