দেশে অব্যাহত ডলার সঙ্কট আর বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার প্রভাবে আমদানি-রফতানি কমছে। তাতে ভাটা পড়েছে চট্টগ্রাম বন্দরকেন্দ্রিক সার্বিক অর্থনৈতিক কর্মকাÐে। জাহাজের অপেক্ষায় ফাঁকা থাকছে দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দরের জেটি। অথচ মাসখানেক আগেও জাহাজ ভেড়ানোর জন্য জেটি বরাদ্দ পেতে শিপিং ব্যবসায়ীরা বন্দরে দৌড়ঝাঁপ করতেন। আমদানি কমে যাওয়ায় কাস্টমস হাউসের রাজস্ব আহরণ কমে যাচ্ছে। বন্দরে কর্মরত শ্রমিকেরাও আগের মতো কাজ পাচ্ছেন না।
বেসরকারি কন্টেইনার ডিপো, শিপিং লাইনস, লাইটারেজ জাহাজ মালিক-শ্রমিক, জেটি পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ও পরিবহন খাতের আয় কমে যাচ্ছে। পণ্য খালাসের সঙ্গে যুক্ত কাস্টমস এজেন্টদেরও আয় রোজগারে টান পড়ছে। ডলার সঙ্কটে ভোগ্যপণ্য আমদানি কমে যাওয়ায় আসন্ন রমজানে অতিপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের সঙ্কটের আশঙ্কা প্রকট হচ্ছে। মূলধনী যন্ত্রপাতি (ক্যাপিটাল মেশিনারিজ) এবং শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমে যাওয়ায় শিল্পোৎপাদন কমছে। সেই সাথে নতুন বিনিয়োগে স্থবিরতার আশঙ্কা করা হচ্ছে। তাতে কর্মসংস্থান আরো সঙ্কুচিত হবে।
আমদানি-রফতানি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশ থেকে ব্যাপকহারে পুঁজি পাচার, বৈদেশিক রেমিট্যান্স কমে যাওয়া এবং মেগা প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধির ফলে সার্বিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক ধারা সৃষ্টি হয়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়। বিশেষ করে ডলার সঙ্কটের কারণে আমদানি কার্যক্রম থমকে যায়। গেল বছর ঊর্ধ্বমুখী থাকলেও এখন রফতানিতেও ভাটার টান শুরু হয়েছে। শতভাগ রফতানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি মো. ফারুক হাসান রোববার চট্টগ্রামে জানিয়েছেন, অর্ডার কমে যাওয়ায় দেশের কোন তৈরি পোশাক কারখানা এখন পুরোদমে উৎপাদনে নেই।
ডলারের অভাবে আমদানি ঋণপত্র খোলার হার অক্টোবর থেকেই কমতে থাকে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবরে ৪৭৪ কোটি ডলারের পণ্য আমদানির ঋণপত্র খোলা হয়। নভেম্বরে তা কমে দাঁড়ায় ৪০২ কোটি ডলারে। সাধারণত ঋণপত্র খোলার পর এক থেকে দুই মাসে সেই পণ্য আমদানি শুরু হয়। অক্টোবরে ঋণপত্র খোলার হার কমে আসার প্রভাব পড়তে শুরু করে ডিসেম্বর থেকে। এ ধারা জানুয়ারি মাসেও অব্যাহত আছে। সামনের দিনগুলোতে তা আরও প্রকট হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
গত ডিসেম্বরে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পণ্য আমদানি হয়েছে ৭১ লাখ টন। আগের বছরের একই মাসে আমদানি হয়েছিল ৮৬ লাখ টন। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে আমদানি কমেছে প্রায় ১৭ শতাংশ। জানুয়ারি মাস শেষে আমদানি আরও কমতে পারে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। কারণ চলতি মাসে বন্দরের সার্বিক কার্যক্রম দেখে ব্যবসায়ীরা এমন ধারণা করছেন।
বন্দরের কর্মকর্তারা জানান, ডিসেম্বর থেকেই বন্দরে জাহাজ ও কন্টেইনার আসার হার কমতে থাকে। ডিসেম্বরে বন্দরে দুই থেকে তিনটি জেটি খালি ছিল। আর চলতি মাসে প্রায় প্রতিদিনই একাধিক জেটি খালি পড়ে থাকছে। কোন জাহাজ আসলেই বহির্নোঙরে অপেক্ষা না করে সরাসরি জেটিতে ভেড়ার সুযোগ পাচ্ছে। বন্দরে এখন কোন জট নেই। একই চিত্র চট্টগ্রামের ২০টি বেসরকারি ডিপোতেও। ডিপোগুলোতে আগের তুলনায় কর্মব্যস্ততা কমে গেছে।
গতকাল চট্টগ্রাম বন্দরে জেটি ও বহির্নোঙরে ৬২টি জাহাজ ছিল। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, বন্দরের কর্মদক্ষতা বেড়ে যাওয়ায় দ্রæত জাহাজে মালামাল ওঠানামা করা যাচ্ছে। এতে বন্দরে কোন জাহাজকে জেটিতে ভেড়ার জন্য অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে না। কন্টেইনারের সংখ্যা কমলেও বন্দরে খোলা পণ্যের আমদানি স্বাভাবিক রয়েছে বলে জানান তিনি। ডিসেম্বরের তুলনায় চলতি মাসে আমদানি-রফতানি কি পরিমাণ কমেছে তার হিসাব মাস শেষে পাওয়া যাবে বলেও জানান তিনি।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ বলেন, অর্থনৈতিক মন্দার প্রেক্ষিতে সরকার উচ্চবিলাসী এবং অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করছে। আবার ডলার সঙ্কটের কারণে ঋণপত্র খুলতে না পারায় ক্রমাগতভাবে আমদানি কমছে। এ কারণে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ ও কন্টেইনারের সংখ্যা কমছে। তবে ভোগ্যপণ্য এবং জ্বালানী তেল আমদানি স্বাভাবিক রয়েছে। সার্বিকভাবে আমদানি-রফতানি কমে যাওয়ায় শিপিং সেক্টরে আয়-রোজগার কমে গেছে বলেও জানান তিনি।
এদিকে আমদানি কমে যাওয়ায় তার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে চট্টগ্রাম বন্দরের সার্বিক কর্মকাÐে। বন্দর ব্যবহারকারিদের আয়-রোজগারেও ভাটার টান পড়েছে। বন্দরের জেটি পরিচালনাকারী বার্থ অপারেটর প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মককর্তারা জানান, জাহাজ থাকলে শ্রমিকদের কাজ থাকে। জাহাজ আসা কমে যাওয়ায় শ্রমিকেরা বেশিরভাগ সময়ই কর্মহীন হয়ে পড়ছেন। একই অবস্থা পরিবহন সংশ্লিষ্টদের। আমদানি-রফতানি কমে যাওয়ায় কমে গেছে পণ্য পরিবহন। এতে আগের মত কাজ পাচ্ছেন না পরিবহন মালিক ও শ্রমিকেরা। প্রতিদিন বন্দর থেকে গড়ে সাত হাজার ট্রাক পণ্য পরিবহন করে। এই সংখ্যা এখন কমছে। অন্তত ৩০ শতাংশ গাড়ি অলস বসে আছে।
বন্দরে আসা বড় জাহাজ থেকে ছোট জাহাজে পণ্য খালাস করে নদীপথে দেশের বিভিন্ন এলাকায় নেয়া হয়। এ কাজে জড়িত ৩২টি শিপ হ্যান্ডেলিং অপারেটরে কর্মরত আছেন দুই হাজার শ্রমিক। আগে প্রতিটি প্রতিষ্ঠান দুই থেকে তিনটি জাহাজের পণ্য খালাসের কাজ পেত। এখন একটির মতো জাহাজের পণ্য খালাসের কাজ পাচ্ছে। এতে শ্রমিকদের কর্মব্যস্ততা কমে গেছে।
বন্দরে কন্টেইনারের পণ্য ব্যবস্থাপনার ৯০ শতাংশ করে বেসরকারি কন্টেইনার ডিপোগুলো। আবার কন্টেইনারে আমদানি করা পণ্যের এক চতুর্থাংশ বন্দর থেকে সরাসরি ডিপোতে এনে খালাস করা হয়। প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ রয়েছে এই খাতে। ২০টি ডিপোতে শ্রমিক-কর্মী রয়েছেন প্রায় ২০ হাজার। ডিপো মালিকদের সংগঠন বিকডার মহাসচিব রুহুল আমিন সিকদার বলেন, আমদানি-রফতানি কমে যাওয়ায় ডিপোগুলোর সার্বিক কার্যক্রম ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ কমে গেছে। এতে অনেক প্রতিষ্ঠানকে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা এবং ব্যবস্থাপনা ব্যয় মেটাতে দায়-দেনা করতে হচ্ছে। আমদানি কমে যাওয়ায় খালি কন্টেইনারের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। কন্টেইনার পরিবহন কমতে থাকায় ডিপোর ব্যবসায় মন্দা চলছে। বলা যায়, আমরা এখন গভীর সঙ্কটে পড়েছি।
সিএন্ডএফ এজেন্ট এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কাজী মাহমুদ ইমাম বিলু বলেন, ডিসেম্বরের তুলনায় জানুয়ারিতে আমদানি-রফতানি আরও কমেছে। এতে কাস্টমস এজেন্টদের কাজ প্রায় ১০ থেকে ১৫ শতাংশ কমে গেছে। সিএন্ডএফ এজেন্ট প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কর্মীদের বেতন-ভাতা দিতে রীতিমত হিমশিম খাচ্ছে।
আমদানি কমে যাওয়ায় দেশের সবচেয়ে বড় রাজস্ব আদায়কারী প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের রাজস্ব আহরণে ভাটা পড়েছে। চলতি মাসের ২২ দিনে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ৩৭ শতাংশ এবং আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৪ শতাংশ কম রাজস্ব আদায় হয়েছে। ২২ জানুয়ারি পর্যন্ত ৩৩ হাজার ১০৩ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আট হাজার ৭৬ কোটি টাকা কম। আমদানির যে নেতিবাচক ধারা তা অব্যাহত থাকলে বছর শেষে ৭৪ হাজার ২০৬ কোটি টাকা রাজস্ব আহরণ অসম্ভব হয়ে পড়বে বলে মনে করেন কাস্টম হাউসের কর্মকর্তারা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন