দেশের বাজারে ডলারের সঙ্কট কোনভাবেই কাটছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের নানামুখী উদ্যোগের পরও সঙ্কট আরও চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। এতে আর্থিক খাতের অস্থিরতা অন্য খাতেও ছড়াতে পারে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। ইতিমধ্যেই ডলার সঙ্কটের প্রভাব এবারের হজ পালনকারীদের উপর পড়বে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক খান। ডলার সঙ্কটে বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো যাত্রীদের কাছে টিকিট বিক্রির আয় নিজ নিজ দেশে পাঠাতে পারছেন না। অনেক এয়ারলাইন্স বাংলাদেশ থেকে ফ্লাইট সংখ্যা কমিয়ে দিচ্ছে। ফ্লাইটের সংখ্যা হ্রাস অব্যাহত থাকলে যাত্রী পরিবহণে ভয়াবহ বিপর্যয়ের শঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া ডলারে আমদানি মূল্য পরিশোধ করতে না পারায় চট্টগ্রাম বন্দরে আসা চিনি ও ভোজ্যতেল বোঝাই জাহাজ থেকে পণ্য খালাস করা যাচ্ছে না। ডলারের অভাবে ব্যাংক মূল্য পরিশোধ করতে পারেনি বলেই পণ্য খালাস করা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন আমদানিকারকরা। এদিকে শিল্পের কাঁচামাল, জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ, চাল, সার, ছোলা ভোজ্যতেলসহ জরুরি নিত্যপণ্য আমদানিতে এলসি (ঋণপত্র) খুলতে পারছে না ব্যাংকগুলো। পাশাপাশি অগ্রাধিকার খাতভুক্ত এসব পণ্য আমদানি বন্ধ হলে বা কমে গেলে দাম বৃদ্ধি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। শিল্পের উৎপাদনও বন্ধের উপক্রম হবে। এসব কিছুর প্রভাব পড়বে সাধারণ ভোক্তাদের উপর। এমনিতেই আগে থেকেই নিত্যপণ্যের দাম বাড়তি থাকায় নাভিশ্বাস নিম্ন ও মধ্যবিত্তের পরিবারে।
সূত্র জানায়, ডলার সঙ্কট কাটাতে আমদানি ব্যয় নিয়ন্ত্রণে সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের কড়াকড়ির ফলে কমতে শুরু করে পণ্য আমদানির ঋণপত্র বা এলসি খোলার পরিমাণ। সেই হিসেবে বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের উপর চাপ কমার কথা। কিন্তু কাঙ্খিত স্বাভাবিক অবস্থায় আসেনি ডলারের বাজার; বরং আগের চেয়ে আরও খারাপ অবস্থায় পৌঁছেছে। জরুরি নিত্যপণ্য আমদানিতে ২৬৯ দশমিক ৫৩ মিলিয়ন ডলার চেয়ে সম্প্রতি চিঠি দিয়েছে ১১টি প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ ব্যাংকের পণ্য আমদানির হালনাগাদ তথ্যে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) পণ্য আমদানিতে ঋণপত্র বা এলসি খোলা কমেছে ২৬ দশমিক ৫০ শতাংশ। তবে চাহিদা মেটাতে বিভিন্ন উৎস থেকে ডলার সংগ্রহের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে তারা।
এদিকে ডলার সঙ্কটে টিলেঢালা আমদানি-রফতানি ব্যবস্থায় বন্দর ফাঁকা পড়ে আছে। যদিও ডলার সঙ্কটে আমদানি পণ্যের মূল্য পরিশোধ করতে না পারায় দিনের পর দিন সাগরে ভাসছে পণ্যভর্তি জাহাজ। বর্তমানেও পাঁচটি জাহাজ সাগরে আছে। ১ লাখ ৩৫ হাজার ৪০১ টন তেল ও চিনিবোঝাই এসব জাহাজের কোনোটি ভাসছে ৫৬ দিন ধরে। আমদানিকারকরা ব্যাংকে স্থানীয় টাকায় পণ্যের মূল্য পরিশোধ করে দিয়েছেন। ব্যাংক রফতানিকারককে এ দাম পরিশোধ করবে ডলারে। কিন্তু ডলারের অভাবে ব্যাংক তা পরিশোধ করতে না পারায় বিদেশি রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান জাহাজ থেকে পণ্য খালাসের অনুমতি দিচ্ছে না। আর এই পাঁচটি জাহাজের জন্য প্রতিদিন জরিমানা গুনতে হচ্ছে প্রায় এক লাখ ডলার।
সাগরে এভাবে পণ্য ভাসার খেসারত দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকেও। কারণ, ভোজ্যতেল ও চিনির আমদানিকারকরা বাড়তি টাকা তুলে নিচ্ছেন বাজার থেকে। বাজারে ভোজ্যতেল ও চিনির সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছেন তারা। তাই অস্থির হয়ে উঠেছে এ দুটি পণ্যের বাজার। তিন দিনের ব্যবধানে খুচরা বাজারে এ দুটি পণ্যের দাম কেজিতে বেড়ে গেছে প্রায় ১৫ টাকা। সাগরে থাকা পণ্য দ্রæত খালাস করা না হলে তেল ও চিনির দাম আরও বাড়বে বলে ধারণা করছেন পাইকাররা। আমদানিকারকরা বলছেন, সাগরে পণ্য আটকে থাকলেও তারা বাজারে সরবরাহ ঠিক রেখেছেন। কিন্তু পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, আমদানিকারকরা ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বাজারে এখনই সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছেন। এ জন্য দুটি পণ্যের দাম বাড়ছে প্রতিদিন। খুচরা বাজারে এর প্রভাব পড়েছে আরও বেশি।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক সার ও জ্বালানি তেল আমদানিতে নমনীয় হয়ে রিজার্ভ থেকে ডলার সরবরাহ করলেও সময়মতো পাওনা প্রদাণ করতে না পারায় বিপাকে আছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। কারণ অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানিতে বিদেশ থেকে ভাড়া করা জাহাজ ব্যবহার করে থাকে বিপিসি। এসব জাহাজের ভাড়া পরিশোধ করা হয় মূলত বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) মাধ্যমে। এজন্য এতদিন ডলারে বিএসসির পাওনা পরিশোধ করে এসেছে বিপিসি। কিন্তু ডলারের বর্তমান সঙ্কটপূর্ণ পরিস্থিতিতে সম্প্রতি বিষয়টি নিয়ে আপত্তি তুলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে বিপিসি এখন বিএসসিকে জাহাজের ভাড়ার অর্থ পরিশোধ করছে বাংলাদেশী টাকায়। বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যাংকের মাধ্যমে বিদেশী জাহাজ মালিকদের পাওনা ভাড়া ডলারে সময়মতো পরিশোধ করা নিয়ে বিপত্তিতে পড়েছে বিএসসি।
সঠিক সময়ে জাহাজ ভাড়া পরিশোধে বিলম্ব হলে বিএসসিকে প্রতিদিনের জন্য অতিরিক্ত ক্ষতিপূরণ পরিশোধ করতে হয়। সংস্থাটির আশঙ্কা, বিপুল পরিমাণ আর্থিক লোকসানের সম্মুখীন হতে হবে তাদের। এছাড়া বিদেশী জাহাজ মালিকরাও পরিবহন চুক্তি বাতিলের মতো পদক্ষেপ নিলে তা দেশের জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থাকে বিঘেœর কারণ হয়ে দেখা দেবে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম মনে করেন, ডলারের সঙ্কট আমরা যা দেখছি বাস্তবে তার চেয়ে আরো গভীরতর। প্রকৃত পক্ষে আমাদের ডলার কী পরিমাণ আছে, ব্যাংকগুলো তাদের চাহিদার বিপরীতে কী পরিমাণ পাচ্ছে তা নিয়মিত সপ্তাহভিত্তিতে তদারকি করা দরকার। একই সঙ্গে এখন আমাদের দরকার অর্থনীতিতে ভারসাম্য রেখে প্রয়োজনের অগ্রাধিকার নির্ধারণ, সেভাবে এলসি খুলতে দেয়া।
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি এক আলোচনায় বলেছেন, ডলার সঙ্কটে সাগরে জাহাজ ভাসার বিষয়টি সম্পর্কে তারা অবগত। এ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন বাণিজ্য সচিব। রমজান মাসের পণ্য আমদানিতে যাতে কোনো সঙ্কট না হয়, সে জন্য সব ধরনের চেষ্টা অব্যাহত আছে। রিজার্ভ ঠিক রেখে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চারটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের সঙ্গে কথাও বলেছেন তারা। বিষয়টি সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীও অবগত। এদিকে ডলার সঙ্কট নিয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সভায় গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার গত সোমবার বলেছেন, বর্তমানে ঋণপত্র (এলসি) খোলা নিয়ে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তা আগামী দু-এক মাসের মধ্যে স্বাভাবিক হতে পারে। এর মানে আগামী রমজান মাসের আগে স্বাভাবিক হচ্ছে না ডলার সঙ্কট।
এদিকে আসন্ন রমজানে পণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এলসি খুলতে নির্দেশনা দেয়া হলেও ডলার সঙ্কটে তা পারছে না বেশিরভাগ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে কিনতে চেয়েও মিলছে না। ডলার জোগাড়ে দিশেহারা আমদানিকারকরা ভোগ্যপণ্যের এলসির জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়সহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে ধরনা দিচ্ছেন। জানা গেছে, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যেন ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় না নামে, সে জন্য চাইলেই ডলার দিচ্ছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। শুধু সার, জ্বালানি ও সরকারি খাদ্য আমদানিতে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করা হচ্ছে।
সূত্র মতে, সাগরে আটকে থাকা এসব পণ্য আমদানি করেছে চট্টগ্রামের এস আলম গ্রæপ, ঢাকার মেঘনা গ্রæপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ (এমজিআই) ও দেশবন্ধু গ্রæপ। ডলারের অভাবে ব্যাংক মূল্য পরিশোধ করতে না পারায় কিছু পণ্য খালাস করার পরেই রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান বেঁকে বসে।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, নতুন এলসি খোলা কমলেও আগের দায় নিষ্পত্তির কারণে ডলারে সঙ্কটের চাপ কমছে না। আবার বিনিয়োগ ও চাহিদা বিবেচনায় আমদানি বেশিদিন কমিয়ে রাখা যাবে না। পরিস্থিতি উত্তরণে রফতানি ও রেমিট্যান্স বাড়ানোর ওপর জোর দিতে হবে।
পলিসি রিচার্স ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট-রেমিট্যান্স ব্যালান্স হলেও পেমেন্টে ব্যালেন্স হচ্ছে না। কারণ, এখন আমাদের অনেক পেমেন্টে বাকি পড়ে আছে। অনেক পেমেন্ট পিছিয়ে দেয়া হয়েছে। ডলারের সঙ্কটে শুধু ভোগ্য পণ্য নয়, গ্যাস, কয়লাও আমদানি করা যাচ্ছে না। এক্সপোর্ট বেড়েছে ১০ শতাংশ, রেমিট্যান্স বেড়েছে ২ শতাংশ- এটা তেমন কিছু নয়। আমদানি কমিয়ে আসলে রফতানি বাড়ানো যায় না। এটা ব্যালেন্স করতে হয়।
তিনি বলেন, বাজারে আমদানি করা পণ্যের ঘাটতি শুরু হয়েছে। গমের দাম বেশি, কারণ, ডলার সঙ্কটে গম আমদানি করা যাচ্ছে না। চিনির দাম বেশি, কারণ, চিনি আমদানি করা যাচ্ছে না। এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে দাম আরো বাড়বে। ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে সরকার টাকার সংস্থান বাড়াতে পারবে। কিন্তু ডলার তো বাড়াতে পারবে না। টাকা তো ডলার না।##
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন