জাহাঙ্গীর আলম : কমিউনিকেটিভ পদ্ধতি ইংরেজি শেখার ক্ষেত্রে এদেশে সফল না হলেও ইংরেজিতে ফেল করার বদনামটা হ্রাস করতে পেরেছে যথেষ্ট। এজন্য হয়তো সিলেবাস প্রণেতাগণ তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলবেন। ক্ষতির বিষয় যা আড়ালে থেকে যায় তা হচ্ছে কষ্ট করে ইংরেজি শেখার আগ্রহও হ্রাস পেয়েছে বহুগুণে। কারণ গ্যাপ ফিলিং নামের প্রশ্নগুলোর উত্তর শুধু শব্দ বসানো। আন্দাজে উত্তর দিয়েও কিছু নম্বর পাওয়া যায়। অনুচ্ছেদ থেকে করা প্রশ্নের উত্তর অনুচ্ছেদ দেখেই দেয়া যায়। এভাবে ৫০ ভাগ নম্বর অনায়াসে লাভ করার লোভ অলস বাঙালির দুলালরা সামলাতে পারে না। পাশের সহজ রাস্তা পেয়ে ছাত্রছাত্রীরা ইংরেজি রিডিং শেখার কষ্ট করতেও নারাজ। এহেন ক্ষতিকর মানসিকতার জন্য পাঠ্যক্রম যে অনেকাংশে দায়ী তা অস্বীকার করা কঠিন।
যাহোক, আমাদের মতো অপাঙক্তেয় লোকদের চেচিয়ে গলা ভাঙার পর পাঠ্যক্রম প্রণেতাদের ঘুম ভাঙে। ফলে গ্রামার পূর্ববৎ প্রশ্নে ঠাঁই পায়। তবে এতেও শিক্ষার্থীর আলস্য কাটানোর ব্যবস্থা নেই। শব্দ বসানোর আরামদায়ক পদ্ধতি পরিহার করা হয়নি। বিভিন্ন বিষয়ে সৃজনশীল পদ্ধতি আমদানি করে সিলেবাস প্রণেতারা কৃতিত্ববোধ করলেও ইংরেজি প্রশ্নের গ্রামার অংশে (মাধ্যমিক পর্যায়ে ৪০ নম্বরে) একটি বাক্য লিখে দেয়ার আয়েসটুকুও রাখা হয়নি। রাইটিং টেস্ট আইটেম বলতে পেরাগ্রাফ, রচনা বা গল্প লিখতে যা দেয়া হয় তার প্রায় সবই মুখস্থ।
তারচেয়ে বেশি আপত্তিকর হচ্ছে নিম্ন মাধ্যমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত ইংরেজি পাঠ্যক্রমে কাঠিন্যের স্তর অনুসরণ করা হয়নি। যেমনÑ স্কুল কিংবা মাদরাসায় এসএসসি ও দাখিল স্তরের গ্রামারবিষয়ক প্রশ্ন বেশ জটিল বা কঠিন করা হয়েছে এইচএসসির তুলনায়। উদাহারণস্বরূপ বলা যায়, মাধ্যমিক পর্যায়ে ইংরেজি ২য় পত্রে ভোকাবিউলারি আছে, যা পূরণ করতে হয় ঢ়ধৎঃ ড়ভ ংঢ়ববপয এর সব জাতের শব্দ দিয়ে। সেখানে আর্টিকেলও বাদ নেই। তেমনি ঢ়ৎবভরী ও ংঁভভরী প্রশ্নেও। কিন্তু উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে প্রশ্ন আলাদা করা হয়েছে। যেমন আর্টিকেল ও প্রিপজিশন-এর জন্য আলাদা দুটি প্রশ্ন আছে। গড়ফরভুরহম-এর প্রশ্নে শব্দ পরিবর্তন করতে জায়গামত শব্দটি বসিয়ে নির্দেশ দেওয়া আছে- ঘড়ঁহ বানাতে হবে নাকি অফলবপঃরাব। অথচ ৮ম শ্রেণীর ইংরেজি প্রশ্নেও তেমন সুযোগ নেই। প্রথম ভেবেছিলাম সিলেবাস প্রণেতারা ধরে নিয়েছেন শিক্ষার্থীর মেধার বিকাশ ঘটেছে। অতএব, প্রশ্ন আরেক ধাপ জটিল করা হলো। মাদরাসার ছাত্ররা আরবি ভাষার উপর ২০০ নম্বর অতিরিক্ত পরীক্ষা দেয়। তাদের উপরও ইংরেজির ছড়িটা পুরোদমে না ঘুরালে মহাভারত তেমন কি অশুদ্ধ থেকে যেত? বরং দেখা যাচ্ছে বিগত বছরগুলোতে মাদরাসার ঔ.উ.ঈ পরীক্ষায় ইংরেজি ২য় পত্রে চধংংধমব ঘধৎৎধঃরড়হ দেয়া হয়েছে। কিন্তু স্কুলের ঔ.ঝ.ঈ ইংরেজী ২য় পত্রে ংবহঃবহপব ঘধৎৎধঃরড়হ দেয়া হয়েছে, যা চধংংধমব ঘধৎৎধঃরড়হ এর তুলনায় সহজ এবং উপযুক্ত।
সিলেবাস প্রণেতাদের সাথে পাল্লা দিতে গাইড ব্যবসায়ীরাও কম যায়নি। কঠিন কঠিন অনুচ্ছেদ ও ঠড়পধনঁষধৎু- দিয়ে আকর্ষণ বৃদ্ধির চেষ্টা করছেন। এমনকি তারা যখন ফরমায়েশ অনুসারে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রশ্ন সরবরাহ করে, সেসব প্রশ্নে ভ্রান্তির জটিলতাও থাকে। মাঝে মধ্যে কঠিন প্রশ্ন করার প্রবণতাও লক্ষ করা যায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, মাদরাসার গাইড প্রকাশক একটি প্রকাশনী এবছর দাখিল নির্বাচনী পরীক্ষায় ইংরেজি ২য় পত্রের কথা। যাতে কঠিন আইটেম যোগ করা হয়েছে। ফলে দুর্বল মেধার ছাত্রছাত্রীরা গণহারে ফেল করেছে। উল্লেখ্য যে, কড়া প্রশ্নকারী গাইড থেকে গ্যাপ ফিলিংটি না শুধরেই হুবহু তুলে দিয়েছেন।
গাইড ব্যবসায়ীদের দাপট দিন দিন বেড়েই চলছে। আগে নোটবই নামে একটি সহায়ক বই ছিল। কিন্তু বর্তমানে গাইড প্রকাশকরা প্রথমে নোটবই বের করে ইংরেজি ঃবীঃ-এর। তারপর গ্রামারসহ কিছু মডেল প্রশ্নসহ বেশ বড় একখানা বই ছাপায়, যাতে ংববহ ও ঁহংববহ অনুচ্ছেদজুড়ে দেয়া হয়। এরপর ৫ম ও ৮ম এর জন্য সব বিষয়ে আর একটি ইয়া বড় সমাপনী গাইড বের করে। বছরের শেষদিকে কথিত সুপার সাজেসন নামে অভিন্ন কায়দায় আরেকটি বই চাপানো হয় শিক্ষার্থীদের অসহায় কাঁধে। সেইসাথে মডেল প্রশ্ন দিয়ে আলাদা আরেকটি বই। এক ইংরেজি বিষয়ে চারটি বই ছাপাতে গাইড প্রকাশকরা ক্লাসে পর্যন্ত হাজির হয়। আকর্ষণ বৃদ্ধির জন্য অবশেষে ছোট সাইজের আরেকটি সংস্করণ বের করা হয় ইংরেজিসহ বিভিন্ন বিষয়ে। ব্যবহারিক আরাম এবং সহজ পাসের জন্য নতুন প্যাকেটে পুরনো জিনিস বগলদাবা করে তৃপ্তিও পায় শিক্ষার্থীরা। এসব বই যে আগ্রহ নিয়ে কিনে সেই উৎসাহ নিয়ে পড়ে না ছাত্ররা। আবার এমন অনেক আছে বিনা পয়সায় সরকারি ঃবীঃ বই ছাড়া কোনো গাইডও কিনেনি। অথচ ঃবীঃ বইতে হাত না লাগিয়ে দাখিল অথবা এসএসসি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়। শব্দ শেখার ক্ষেত্রে অবস্থা এমন যে ক্রিকেট খেলে দিন পার করা ছেলে পধঃপয অর্থ বলতে পারে না। প্রাইভেট পড়ার ক্ষেত্রেও দেখা যায় গণিতের তুলনায় মাত্র দশভাগ ছাত্রও ইংরেজি প্রাইভেট পড়ে না।
গাইড বইয়ের উপর কাগুজে নিষেধটা বেশ পুরনো এবং নিষ্ক্রিয়। একে কিছুটা সক্রিয় করা গেলেও শিক্ষার্থীরা এত অলস হতো না। এখন কেউ নিজ হাতে নোট করে না। হ্যান্ড নোট ও শিট বাণিজ্যের যুগে নোট করতে যাওয়া চরম বোকামি বলেই বিবেচিত। অথচ শিটের ফটোকপি তোলা দুধের মতো। আর এখানেও পুরনো গ্রাম্য প্রবাদটি প্রযোজ্য- ‘তোলা দুধে পোলা বাঁচে না’। শিট/নোট কমন পড়লে ভালো ফল কিন্তু কমন না পড়লে ফেল। কারণ মেধা প্রয়োগে সমস্যা সমাধান করার যোগ্যতা অর্জন করার পরিবর্তে তোতার বুলির মতো আওড়িয়ে যায় পরীক্ষার হলে। এবছর মফঃস্বলে নবপ্রতিষ্ঠিত একটি কলেজে এইসএসসি-তে এক-তৃতীয়াংশ পাস করেছে মাত্র। অথচ প্রথম ব্যাচ হিসাবে ক্লাস টেস্ট ও মডেল টেস্ট এন্তার হয়েছিল। কিন্তু শেষরক্ষা না হওয়ার পেছনে কারণ হিসাবে একজন ডাক্তার অভিভাবকের মন্তব্য হচ্ছে শিট বাণিজ্য। সকাল ও বিকালে এমন কি সন্ধ্যা রাত পর্যন্ত প্রাইভেট পড়া এবং মাঝখানের দিনটা ক্লাসে। অতএব মেধা খরচ করে অধ্যয়নের সময় কই? কিন্তু পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নতো ছাত্রের প্রাইভেট ও সাজেশন ভিত্তিক হয় না। তাই প্রাইভেট পড়েই ফেলের কলঙ্ক ঘুচানো কঠিন।
ছাত্রছাত্রীদের সচেষ্টায় ঃবংঃ বুঝে অধ্যয়নের অনুশীলন পরিবেশ বানাতে হবে। এজন্য প্রথমেই বয়সভিত্তিক সহজবোধ্য পাঠ্য বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। প্রশ্নও সেইমানের হওয়া চাই। বেশ মনে আছে, ১৯৯৭ সালের ডিগ্রি পাসকোর্সে ইংরেজি প্রশ্নে (জেনারেল) ধঁংঃবৎরঃু-র গুরত্ব অরোপ করে অনুচ্ছেদ লিখতে বলা হয়েছিল। উত্তরটি কেউ দিয়েছিল এমনটা শোনা যায়নি। কারণ অস্টারিটি শব্দটির অর্থ কেউ বুঝেনি। ইংরেজিতে এমএ পাস করা অনেকেই বলতে পারেনি এর অর্থ।
অস্টারিটি অর্থে ক্রিচ্ছতা শব্দটি অনেক অভিধানে নেই। তেমনি বিশ্ব জলবায়ু, ওজনস্তর এবং এজাতীয় বিশ্বায়ন বিষয়ে গ্যাপ ফিলিং বা টেবিল দাখিল/এসএসসির জন্য মোটেই সহজ আইটেম হতে পারে না। অতএব, এসএসসি/দাখিলে গ্যাপ ফিলিংকে পার্ট অফ স্পিচ দিয়ে জগা খিচুড়ি বানানো যাবে না। এইচএসসির মতো ঢ়ৎবঢ়ড়ংরঃরড়হ ও ধৎঃরপষব-এর আলাদা প্রশ্ন রাখা হোক যা আগে ছিল। সড়ফরভরবৎ বানাতেও ঢ়ধৎঃ ড়ভ ংঢ়ববপয উল্লেখ করে দিতে হবে উচ্চ মাধ্যমিকের মতো।
বিদ্যার্জন পদ্ধতি যেমনই হোক পরীক্ষা পদ্ধতি ও মূল্যায়নত্রুটি ফলাফলকে আরো জটিল করছে। যান্ত্রিক লেখা পড়ার মূল্যায়নও যান্ত্রিক হয়েছে। এমন কি তা রাজনৈতিক ছোঁয়ায় ফলাফল কারসাজিতে পৌঁছার উপক্রম। কিন্তু নিম্ন ও নিম্নমাধ্যমিকে পাসের হার বাড়ানোর উৎসাহ সরকারিভাবেও কতটা বেড়েছে তার প্রমাণ দিতে একটি ঘটনা না বলে পারছি না। নিবন্ধকারের প্রাইমারি শিক্ষকবন্ধু ঢ়.ং.প খাতা মূল্যায়নে গিয়ে দেখেন খাতায় লেখা নেই বললেই চলে। পাস কীভাবে করাবে পরামর্শ চাইলেন সহকারী থানা শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। অফিসার বললেন হেকমতের সাথে, নৌকার ভিতরে যখন যাত্রী রাখা যায় না তখন নৌকার ছৈয়ের উপর লোক বসানো হয়। তদ্রুপ খাতার ভিতর নম্বর দেয়ার সুযোগ নেই, তাতে কি, খাতার উপরে পাঁচের বামে তিন বসালে পাস। উক্ত পদ্ধতি যে বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় তা কেউ অস্বীকার করবে না।
কথিত শতভাগ পাসের দুরন্ত প্রচেষ্টার পরও দেখি ফেলের সংখ্যা বেশ। তারচেয়ে দুঃখের বিষয় হচ্ছে, ফেল ঘোষিত হতভাগাদের অনেকে যখন পুনঃনিরীক্ষিত হয় তখন মলিন মুখে হাসি ফুটে উঠে। গত উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফলে এহেন ঘটনার অভাব ছিল না। চট্টগ্রাম বোর্ডে এ বছর (২০১৬) পুনঃমূল্যায়নের ফলে ৮৬ জন ঐ.ং.প পাস করে এবং ২৯ জনের ফল পরিবর্তিত হয়ে অ+ পায়। তেমনি যশোর বোর্ডে পুনঃমূল্যায়নের ফলে ৩৯ জন পাস করে এবং ৩৯ জনের ফলাফল পরিবর্তিত হয়ে অ+ পায়। অন্যান্য বোর্ডেও এমনটি যে ঘটছে তা সবার জানা। এর ফলে যে আত্মহত্যার মতো ঘটনা ঘটে, তাও সবার জানা। অথচ নির্ভুল ফলাফল নিশ্চিত করার জন্য কম্পিউটারের সাহায্য নেয়া হচ্ছে। এর আগে পরীক্ষক, প্রধান পরীক্ষক ও তার সহায়তায় স্ক্রুটিনারগণ দেখেন। তারপরও কেন জীবনঘাতি ভুল?
শিক্ষার মান উন্নয়নে সরকার শতকোটি টাকা খরচ করছে। শিক্ষনের মান উন্নয়নে খরচ মোটেই কম বলা যাবে না। কিন্তু এর সুফলকে বেশি বলারও সুযোগ নেই। প্রশিক্ষণ শিক্ষক থেকে শিক্ষার্থী পর্যন্ত পৌঁছানো যাচ্ছে না। তাই ছাত্রছাত্রীরা ঘরে পড়ার চেয়ে প্রাইভেট/কোচিং-এর দিকে ঝুঁকছে। এতে পাসের হার (অ+সহ) বাড়ছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় ফেলের সংখ্যাও বাড়ছে। তাই পাস করানোর রাজনৈতিক সাফল্য এড়িয়ে ছাত্রদের নিজে পাস করার পরিবেশ কায়েম করা হোক। গাইড বইয়ের দাপট বন্ধ করা হোক। বন্ধ করা হোক সর্বমহলে ছিঃ ছিঃ রব উঠা ঢ়.ং.প, ল.ং.প / ল.ফ.প নামের তামশার পরীক্ষাগুলো। সরকার যে মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে সেগুলো চালু করেছিল তা বাস্তবে মিলছে না। উক্ত পরীক্ষাগুলো দ্বারা নকলের প্রসার ও গাইড বাণিজ্য এবং কোচিং বাণিজ্যের খেসারত দিচ্ছে জাতি অথচ পরীক্ষাগুলো ড্রপ আউটও ঠেকাতে পারেনি। ২০১৬ সালে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত পাঁচ লাখ ঝরে পড়ার হিসাব শিক্ষা অধিদপ্তরই দিয়েছে। অতএব, আর কেন পরীক্ষার মহড়া?
লেখক : শিক্ষাবিদ ও প্রাবন্ধিক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন