সালাহউদ্দিন আহমেদ মুক্তি : অফুরন্ত সম্ভাবনার অপর নাম বাংলাদেশ। এ দেশের রয়েছে অমিত সম্ভাবনাময় ষোল কোটি মানুষের বত্রিশ কোটি হাত। ষোল কোটি মানুষ বাংলাদেশের জন্য অভিশাপ নয়, আশীর্বাদ। কেননা আবহমানকাল থেকেই এ দেশের মানুষেরা কর্মনিষ্ঠ, পরিশ্রমী। অচিরেই এ দেশ পরিণত হবে পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ পোশাক, জুতা, ওষুধ, সিরামিক ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানিকারক দেশে। সৃষ্টিকর্তার অপার কৃপায় ধন্য এদেশে রয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে উর্বর মাটি আর দূষণমুক্ত পানি। গ্যাস ও কয়লার প্রাচুর্যের পাশাপাশি এ দেশে বছরে তিনবার ফসল উৎপাদিত হয়। ফলে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হওয়া সত্ত্বেও ইতোমধ্যেই খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জিত হয়েছে, এ দেশে এখন আর কেউ না খেয়ে মরে না।
কৃষিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের পাশাপাশি দেশের দরিদ্র, শ্রমজীবী, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীনির্ভর প্রবাসী আয়কে পুঁজি করে বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে ঘামঝরা শ্রমের ফসল পোশাকশিল্প উন্নয়নের ধারাকে করেছে আরও বেগবান। দেশে যেভাবে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে, অর্থনীতি এগিয়েছে, যেভাবে বিশ্বমন্দা ও রাজনৈতিক অস্থিরতা মোকাবিলা করেছে, তাতেই বোঝা যায় বাংলাদেশের মানুষ অপরিসীম ক্ষমতার অধিকারী।
সত্তর দশকের ‘ষড়যন্ত্রমূলক’ তলাবিহীন ঝুড়ি, নব্বই দশকের বিশ্ব পরিম-লে তুলনামূলক অচেনা বাংলাদেশ এখন বিশ্বব্যাপী এক বিস্ময়ের নাম। উন্নয়ন নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করা মানুষদের কপালে ভাঁজ ফেলে রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেও সম্ভাবনার দিগন্তে সাফল্যের পতাকা উড়িয়ে দেশ অব্যাহত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিএমআই রিসার্চের মতে আগামী ১০ বছরে বাংলাদেশ হয়ে উঠবে বিশ্বের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নতুন চালিকাশক্তি। বিএমআই রিসার্চ মনে করছে, ২০২৫ সালের মধ্যে এই ১০টি দেশ সম্মিলিতভাবে বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ৪ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন অর্থাৎ চার লাখ তিন হাজার কোটি ডলার যোগ করবে, যা বিনিয়োগকারীদের বড় সুযোগ এনে দেবে। উল্লিখিত অর্থ জাপানের বর্তমান অর্থনীতির সমান।
স্মর্তব্য, ফিচ রেটিংস বিশ্বের সবচেয়ে বড় তিন ঋণমান কোম্পানির একটি। নিউইয়র্কভিত্তিক এই কোম্পানির সহযোগী প্রতিষ্ঠান বিএমআই রিসার্চ। তারা ২০০টি দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও ঝুঁকি এবং ২০ ধরনের শিল্প নিয়ে নিয়মিত গবেষণা করে থাকেন। গত ৬ জুলাই বিএমআই রিসার্চের ‘টেন ইমারজিং মার্কেট অব দ্য ফিউচার’ নামের এই রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়। গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি গত মে থেকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সংক্রান্ত গবেষণাটি শুরু করে। গুলশান জঙ্গি হামলার পর তা প্রকাশিত হলেও এতে জঙ্গিবাদের হুমকি সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি। তবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংঘাতের বিষয়টি তাদের পর্যালোচনায় এসেছে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়ার যে সম্ভাবনা বাংলাদেশের সামনে হাতছানি দিচ্ছে তাকে কাজে লাগাতে হলে রাজনৈতিক সংঘাতের অবসানের পাশাপাশি জঙ্গিবাদের শেকড় উৎপাটনেও যতœবান হতে হবে। এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হলে সম্ভাবনাময় দেশের বদলে ব্যর্থ রাষ্ট্রের অভিশাপ যে জাতির জন্য অনিবার্য হয়ে উঠবে সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। এ বিপদ ঠেকাতে পেশাদারিত্বের মনোভাব দিয়ে জঙ্গিবাদ দমনের প্রয়াস চালাতে হবে। বাংলাদেশকে এ অঞ্চলের অন্যতম উৎপাদন কেন্দ্রে পরিণত করতে চাইলে আইনশৃঙ্খলার প্রশ্নে হতে হবে আপসহীন।
সম্প্রতি জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ৪৫টি দেশ সম্পর্কে প্রকাশিতব্য মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে তরুণদের দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশের ৪৯ শতাংশ মানুষের বয়স ২৪ বছর কিংবা তার নিচে। দেশের কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা ১০ কোটি ৫৬ লাখ বা মোট জনসংখ্যার ৬৬ শতাংশ। জনসংখ্যাতাত্ত্বিক এই অবস্থান বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে সুবর্ণ সুযোগ এনে দিয়েছে। ইউএনডিপি বলছে, এ সুযোগ কাজে লাগাতে হলে আরও বেশি কাজের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে, শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। আর বিনিয়োগ বাড়াতে হবে উৎপাদনশীল খাতে। ইউএনডিপির পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী কর্মক্ষম জনসংখ্যা ১০ কোটি ৫৬ লাখ। অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার ৬৬ শতাংশই কর্মক্ষম। আগামী ১৫ বছরে অর্থাৎ ২০৩০ সাল নাগাদ কর্মক্ষম জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ১২ কোটি ৯৮ লাখে, যা হবে মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ। দেশে বয়স্ক বা ৬০ বছরের বেশি বয়সী মানুষ ৭ শতাংশ। ২০৩০ ও ২০৫০ সালে তা বেড়ে দাঁড়াবে যথাক্রমে ১২ ও ২২ শতাংশে।
উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ এবং অর্থনীতিবিদদের মতে, চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে তরুণ জনগোষ্ঠীকে যথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে। বাংলাদেশের সামনেও সোনালি ভবিষ্যৎ হাতছানি দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সফল হবে কিনা তা নির্ভর করছে সৃষ্ট সুযোগ কতটা কাজে লাগানো যাবে তার ওপর। বাংলাদেশের জন্য এ মুহূর্তে সমস্যা হলো জনগোষ্ঠীর এক বিরাট অংশ বেকার। যুব জনগোষ্ঠীর একটি অংশ অভিভাবকদের আয়ের ওপর নির্ভরশীল। যুব সমাজের কর্মসংস্থানের যথাযথ পদক্ষেপ যেমন দেশের উন্নয়ন নিশ্চিত করবে তেমন এ ক্ষেত্রের ব্যর্থতা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। দেশের সোনালি ভবিষ্যতের স্বার্থেই কর্মসংস্থান সৃষ্টিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে গতি আনার উদ্যোগ নিতে হবে।
দেশে শিক্ষিতের হার শতকরা ৭০ শতাংশের মতো হলেও মোট জনশক্তির প্রায় এক-তৃতীয়াংশই বেকার। যাদের অধিকাংশই শিক্ষিত, স্বল্প শিক্ষিত, কিংবা অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন। প্রতিবছর বাংলাদেশে গড়ে গ্র্যাজুয়েট বের হচ্ছে লক্ষাধিক, যাদের বেশির ভাগের কর্মসংস্থান হয় না। ফলে বাড়ছে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যাও।
পরিসংখ্যান মতে, বর্তমানে বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা প্রায় দুই কোটি। এমনিতেই বিশ্ব মন্দা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার প্রেক্ষাপটে সারা বিশ্বেই কর্মসংস্থান সঙ্কুচিত হচ্ছে। দেশে কর্মসংস্থান যে হারে বাড়ছিল তা হ্রাস পেয়েছে নানা কারণে। তাই অনেকে শ্রম বেচতে বাইরে যেতে বাধ্য হচ্ছে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের নানা অস্থিরতার কুফল যেসব দেশ ভোগ করছে বাংলাদেশ তার অন্যতম। সারা বিশ্বে প্রায় দেড় কোটি বাংলাদেশি নাগরিক কর্মসংস্থানের কারণে বসবাস করছে। এর মধ্যে মালয়েশিয়ায়ই উল্লেখযোগ্যসংখ্যক। তাই বলা যায়, সার্বিক পরিস্থিতি যে কতটা ভয়াবহ তা সহজেই অনুমেয়। পরিস্থিতির অবনতি রোধে সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগ কোনোটাই মূলত কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। ফলে বৃহৎ এই জনগোষ্ঠী সম্পদ নয়, রাষ্ট্রের বোঝা হিসেবেই ভাবা হচ্ছে।
কিন্তু এই অবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হওয়া সঠিক হবে না। তাই অন্যের মুখাপেক্ষী না হয়ে সরকারের দেয়া সুযোগ-সুবিধা কাজে লাগিয়ে আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। নিজেদের সম্পদ কাজে লাগিয়ে দেশেই কর্মসংস্থানের পথ খুঁজতে হবে। সময়টা তথ্যপ্রযুক্তির। তথ্যপ্রযুক্তির প্রসারের ফলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দক্ষতা প্রদর্শনের সুযোগ পাচ্ছে এদেশের যুবকরা। অনেকেই ইন্টারনেটের মাধ্যমে কাজের ক্ষেত্র গড়ে তুলতে সক্ষম হচ্ছেন। ফলে সমাজে সম্ভাবনার ক্ষেত্র আরও সম্প্রসারিত হচ্ছে। আসলে যুব সমাজই হচ্ছে ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও নিরক্ষরতামুক্ত আধুনিক, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার প্রধান চালিকাশক্তি। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ গড়তে দেশের এই বিশাল শক্তির উপযুক্ত ব্যবহার হওয়া দরকার। এরাই নিজেদের মেধা ও মনন শক্তি ব্যবহার করে নির্ধারণ করবে দেশের আগামী দিনের চলার পথ। তাই সমাজের এই সৃজনশীল ও উৎপাদনমুখী অংশকে উন্নয়নের মূল ধারায় সম্পৃক্ত করতে হবে। এ জন্য যুব সমাজের দক্ষতা ও কর্মক্ষমতা বাড়াতে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও কর্মের জোগান দিতে হবে। যুব সমাজের অমিত সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। তাই প্রবাসে নয়, স্বদেশেই কর্মসংস্থান নিশ্চিতের ব্যবস্থা করতে হবে।
লেখক : সংসদ সদস্য, সদস্য তথ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ও যুগ্ম মহাসচিব, জাতীয় পার্টি কেন্দ্রীয় কমিটি
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন