বৃহস্পতিবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ২৯ কার্তিক ১৪৩১, ১১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

পর্যটনবান্ধব প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে ওঠেনি অর্ধশত বছরেও

শীত কমতেই সুন্দরবনে পর্যটকদের ঢল

ডিএম রেজা, সুন্দরবন থেকে ফিরে | প্রকাশের সময় : ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

নৈস্বর্গিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি সুন্দরবন। বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট এই সুন্দরবন। প্রতিদিনই দেশি বিদেশি অসংখ্য পর্যটক সুন্দরবন দেখতে আসেন। ২৪ ঘণ্টায় সুন্দরবনের ৬টি রূপ, সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত, গাছ গাছালী, জীববৈচিত্র্য-সব কিছুই পর্যটকদের মুগ্ধ করে। পদ্মাসেতুর কারণে রাজধানী থেকে সুন্দরবনের দূরত্ব মাত্র চার ঘণ্টায় নেমে আসায় সুন্দরবনে পর্যটকের সংখ্যা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। শীত কমে আসায় সুন্দরবনের করমজল, দুবলার চর, হিরনপয়েন্ট, কোকিলমুনি, কচিখালি, জামতলা, হারবারিয়া-সব স্থানেই এখন পর্যটকদের উপচে পড়া ভিড়। দিনে দিনে সুন্দরবনে পর্যটকদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও সুযোগ সুবিধার অভাবে পর্যটকরা অনেকটাই হতাশ হয়ে ফিরে যান সুন্দরবন থেকে। অর্ধ শত বছরেও সুন্দরবনে পর্যটন বান্ধব প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে ওঠেনি। সুন্দরবনকে কেন্দ্র করে প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করা সম্ভব হলে সরকারের রাজস্ব আয়ের বড় একটি অংশ সুন্দরবনের পর্যটন শিল্প থেকে লাভ করা সম্ভব হত বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

সূত্র জানিয়েছে, সুন্দরবনের খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা অংশে ছোট বড় কমপক্ষে ১৪টি পর্যটন স্পট রয়েছে। এরমধ্যে বাগেরহাট অংশে করমজল পর্যটন কেন্দ্রে সবচেয়ে বেশি পর্যটক এসে থাকেন। সমুদ্র বন্দর মোংলা থেকে নৌপথে এক ঘণ্টা দূরত্বের করমজল পর্যটন কেন্দ্রে রয়েছে কুমির, কচ্ছপসহ বন্য প্রাণীর কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্র, চিড়িয়াখানা, বনের ভিতরে দীর্ঘ কাঠের ব্রিজ ওয়াকওয়ে, সুউচ্চ ওয়াচ টাওয়ার প্রভৃতি। ওয়াচ টাওয়ার থেকে সুন্দরবনের বড় একটি অংশ এক নজরে দেখা যায়। ওয়াকওয়ে দিয়ে হাঁটার সময় চোখে পড়ে বানর আর হরিণের দল। বানরগুলো নির্ভয়ে সামনে চলে আসে। জামতলায় রয়েছে প্রশ্বস্ত সমুদ্র সৈকত। কয়েক বছর ধরে জেগে ওঠা ডিমের চরে পর্যটকেরা মনের আনন্দে নিরাপদে পশুর নদীতে পা ভিজিয়ে হেঁটে বেড়ান। দূবর্লার চরে শুঁটকি পল্লী পর্যটকদের মুগ্ধ করে। কটকা, কচিখালি, হিরণপয়েন্ট, শেওলারচর, হারবাড়িয়া প্রভৃতি স্থানের সৌন্দর্যও মনোমুগ্ধকর। তবে এসকল স্থানে পর্যটকদের জন্য এখনো প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে ওঠেনি। জামতলায় সমুদ্র সৈকত দেখতে প্রায় সাড়ে ৩ কিলোমিটার পথ হাঁটতে হয় পর্যপকদের জন্য। এর মাঝে কোনো বিশ্রামাগার নেই। পর্যটকদের জন্য একটি মাত্র অপরিষ্কার শৌচাগার রয়েছে। কচিখালিতে দীর্ঘ একটি ওয়াক ওয়ে এবং ওয়াচ টাওয়ার ছাড়া আর কোনো সুযোগ বা সুবিধা নেই। হিরণপয়েন্ট, কটকাতে একই রকম ওয়াকওয়ে ও ওয়াচ টাওয়ার ছাড়া আর কিছুই নেই। বনবিভাগের পক্ষ থেকে এসকল কেন্দ্রে পর্যটকদের দেখভাল করা বা সুন্দরবন সম্পর্কে তথ্য দেয়ার কোনো উদ্যোগ এ পর্যন্ত গ্রহণ করা হয়নি, তবে সামান্য কিছু তথ্য সম্বলিত কয়েকটি সাইনবোর্ড লাগিয়ে রাখা হয়েছে। সুন্দরবনের মাঝে কেউ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা নেই। পর্যটকবাহী একেকটি লঞ্চের সাথে নির্ধারিত ফী এর বিনিময়ে এক বা দুজন সশস্ত্র বনরক্ষী দেয়া হয়ে থাকে। যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।

সরেজমিনে দেখা গেছে, করমজল পর্যটন কেন্দ্রের ওয়াকওয়ে বিভিন্ন স্থানে ভেঙে পড়েছে। যেকোনো সময় ঘটতে পারে বড় ধরণের দূর্ঘটনা। করমজলের বনি অফিস থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে নতুন করে ওয়াকওয়ে ও ব্রিজ নির্মাণ কাজ চলছে। কচিখালিতে পর্যটকদের বিশ্রাম নেয়ার জায়গাটুকুও নেই। কটকায় একই অবস্থা। এ সকল স্পটে পর্যটকদের জন্য রাত্রি যাপনের কোনো ব্যবস্থা নেই। পর্যটক যারা আসেন, তারা শুধু ওয়াকওয়েতে হেঁটে সুন্দরবন দেখে চলে যান।

সুন্দরবনের ট্যুরে অপারেটর রয়েল এর স্বত্বাধিকারী নাজমুল হাসান বলেন, পর্যটকদের যে সকল সুযোগ সুবিধা দেয়া হয় তা মূলত ট্যুরিস্ট লঞ্চে। বনবিভাগ তেমন কোনো ব্যবস্থা রাখেনি। পর্যটকেরা লঞ্চেই রাত্রি যাপন করেন। সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত তাদের বিভিন্নস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। সমগ্র সুন্দরবন দেখতে মূলত একই রকম। তাই একদিন পার হলেই পর্যটকদের সুন্দরবন দেখার আগ্রহ কমে যায়। যদি পর্যটন স্পটগুলোতে সুযোগ সুবিধা বাড়ানো হত, তাহেলে পর্যটক সংখ্যা আরো বেড়ে যেতো। পর্যটকদের বিভিন্ন ভোগান্তি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা যারা ট্যুর পরিচালনা করি, ট্যুর প্যাকেজের শেষ দিন অর্থাৎ তৃতীয় দিন দুপুরেই খুলনা পৌঁছাই। বেশিরভাগ পর্যটক রাতে নিজ নিজ গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা হন। ফলে দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত তাদের যেখানে সেখানে অপেক্ষা করতে হয়। বনবিভাগের পক্ষ থেকে তাদের বিশ্রামের কোনো ব্যবস্থা নেই। সুন্দরবনে নৌবাহিনী, মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের রেস্ট হাউজ থাকলেও সবাই সেগুলো ব্যবহার করতে পারেন না। বনবিভাগের রেস্ট হাউজেও সব সময় অনুমতি মেলে না। বনের ওয়াচ টাওয়ার গুলো ৬ তলার বেশি উঁচু। ওয়াচ টাওয়ার থেকে অনেক স্থানেই পুরো সুন্দরবনটি দেখা যায় না। আবার উঁচু করা সম্ভব নয়, কারণ উঁচু করা হলে সেগুলোতে পর্যটকদের ওঠা কষ্টকর হবে। বনবিভাগের নিজস্ক কোনো গাইড নেই পর্যটকদের জন্য। বিদেশী পর্যটকদের জন্য কোনো বাড়তি সুযোগ সুবিধা নেই।

সুন্দরবনের ট্যুরিস্ট লঞ্চ ‘মা রবা’র মালিক গোলাম রহমান বিটু বলেন, পর্যটকদের আমরা সর্বোচ্চ সুযোগ সুবিধা দিয়ে থাকি। পর্যটকেরা দুই রাত তিন দিন এর প্যাকেজ ট্যুরে সুন্দরবন ভ্রমন করেন। বর্তমানে ট্যুরিস্ট লঞ্চ ভেদে এ জন্য পর্যটকদের মাথা পিছু ৮ থেকে ১৫ হাজার টাকা খরচ হয়। লঞ্চে নানারকম মুখরোচক খাবার, বার বি কিউ পার্টি, র‌্যাফেল ড্র, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বনবিভাগ পর্যটকদের জন্য তেমন কোনো বিনোদন বা সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা রাখেনি।

সুন্দরবন দেখতে আসা একাধিক পর্যটক জানান, সুন্দরবনে পর্যটকদের জন্য কোনো সুযোগ সুবিধা নেই। বনের মাঝে শুধু হেঁটে যাওয়ার জন্য ওয়াকওয়ে আর ওয়াচ টাওয়ার রয়েছে। হরিণ বানরসহ বন্যপ্রাণীরাও এখন সামনে আসে না। বনের ভিতরের পরিবেশ পর্যটকেরা যাচ্ছেতাই ভাবে নষ্ট করছেন। পানির বোতল, চিপস এর প্যাকেটে সারা বন ভরে গেছে। পরিষ্কার করার যেন কেউ নেই। এজন্য সকলের সচেতনতা প্রয়োজন।

সুন্দরবন বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, করমজল, হাড়বাড়িয়া, কটকা, কচিখালী, দুবলা, কলাগাছিয়া ও হিরণ পয়েন্ট-নীলকমলে রয়েছে পর্যটন স্পট। নতুন করে পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের শরণখোলা রেঞ্জের আলীবান্ধা ও চাঁদপাই রেঞ্জের আন্ধারমানিক আর পশ্চিম সুন্দরবন বিভাগে খুলনার শেখেরটেক ও কৈলাসগঞ্জে হবে আরো চারটি পর্যটন স্পট। এজন্য বন বিভাগের ব্যয় হবে ২৪ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। কাজ ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। খুলনাঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কান্তি দো জানান, সুন্দরবনে পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। পর্যটন স্পটগুলোতে সুযোগ সুবিধা বাড়ানোর কাজ চলছে। গ্রহণ করা হয়েছে বিভিন্ন প্রকল্প। আশা করা হচ্ছে, এগুলো বাস্তবায়িত হলে পর্যটকেরা আরও সুযোগ সুবিধা পাবেন এবং সুন্দরবন ভ্রমণে আগ্রহী হবেন।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহার এমপি বলেন, সুন্দরবন সুরক্ষা প্রকল্প শুরু হয় ২০১১। কিন্তু এ প্রকল্পের আওতায় সুরক্ষার কোনো কাজ হয়নি। বর্তমানে সুন্দরবনে পরিবেশবান্ধব পর্যটক সুবিধা উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্পের মাধ্যমে সুরক্ষার কিছু কাজ শুরু হয়েছে। একই সাথে তিনি বলেন, সুন্দরবন আমাদের প্রতিনিয়ত প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা করে। তাই বন বিভাগের লোকদের পাশাপাশি স্থানীয় জনগণকে এই সম্পদ রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। সুন্দরবন রক্ষায় আমাদের সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।

প্রসঙ্গত, প্রতিবছর সুন্দরবনে দেড় থেকে দুই লক্ষ পর্যটক এসে থাকেন। বাংলাদেশে সুন্দরবনের আয়তন ৬ হাজার ৫১৭ বর্গ কিলোমিটার। যার শতকরা ৮০ ভাগ স্থানে পর্যটকেরা প্রবেশ করতে পারেন না। বর্তমানে সুন্দরবনের প্রায় ৫৩ শতাংশ এলাকা অভয়ারণ্য এর অন্তর্ভুক্ত। ১৯৯৭ সালের ৬ ডিসেম্বর সুন্দরবনকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ইউনেস্কো। সুন্দরবনে এখন ৩৩৪ প্রজাতির উদ্ভিদ, ১৬৫ প্রজাতির শৈবাল, ১৩ প্রজাতির অর্কিড এবং ৩৭৫ প্রজাতির বন্যপ্রাণী পাওয়া যায়। বন্যপ্রাণীর মধ্যে ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ, ৮ প্রজাতির উভচর, ৩১৫ প্রজাতির পাখি, ২১০ প্রজাতির মাছ, ২৪ প্রজাতির চিংড়ি, ১৪ প্রজাতির কাঁকড়া আছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন