মীর আব্দুল আলীম : বাংলাদেশে ঘনঘন ভূকম্পন অনুভূত হচ্ছে। সর্বশেষ গত ৩ জানুয়ারি বিকাল ৩টা ৯ মিনিটে সারাদেশ কেঁপে উঠল ভূমিকম্পে। এর মধ্যরাতেও অনুভূত হয় ভূমিকম্প। সিলেট অঞ্চলে এর তীব্রতা ছিল বেশি। ফলে সেখানে ভবনে ফাটল এবং হেলে পড়ার ঘটনাও ঘটেছে। কোথাও কোথাও ভূমিতেও সৃষ্ট হয়েছে ফাটল। যা অনেকের মনেই আতঙ্ক ছড়িয়েছে। বিশেষ করে রাজধানীসহ অন্যান্য নগরবাসীর ভয়টাই বেশি। কেননা, ভূমিকম্পে ভবন কাঁপে, হেলে পড়ে এমনকি ধ্বসে পড়ার ভয়ও থাকে।
তাই সবার ভয় এই বুঝি ভেঙে পড়ছে মাথার উপর। এমন ভয় এখন সবাইকে পেয়ে বসেছে। কিন্তু ভূমিকম্পকে ভয় পেলে চলবে না। ভয়কে জয় করতে হবে। ভূমিকম্প থেকে বাঁচার উপায় বের করতে হবে। ভিম কিংবা কলামের পাশে শক্ত কোনো কিছুর পাশে থাকতে হবে। বিশেষ করে খাট কিংবা শক্ত ডাইনিং টেবিল হলে ভালো হয়। আগে থেকেই আশ্রয়ের জায়গা ঠিক করে নিতে হবে। ঘরে রাখতে হবে সাবোল এবং হাতুড়ি জাতীয় কিছু দেশীয় যন্ত্র। ভূমিকম্প হলে অনেকেই তড়িঘরি করে নিচে ছোটেন। তারা জানেন না ভূমিকম্পে যতো ক্ষতি হয় তার চেয়ে বেশি ক্ষতি হয় অস্থির লোকদের ক্ষেত্রে।
ভূমিকম্প খুব অল্প সময়ের মধ্যে শেষ হয়। প্রলয় যা হবার তা হয় কয়েক সেকেন্ড কিংবা মিনিট সময়ের মধ্যে। এ সময়ে আপনি কি নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে পারবেন? রাস্তায় গিয়ে তো আরো বিপদে পড়তে হবে আপনাকে। বাড়ি ঘর হেলে গিয়ে ধসে পরে সব কিছুতো রাস্তার ওপরই পড়বে। বরং রাস্তায় থাকলে চাপা পড়ে, মাথা কিংবা শরীরের ওপরে কিছু পড়ে আপনি হতাহত হতে পারেন। যারা এক তলা কিংবা দোতলায় থাকেন পাশে খালি মাঠ থাকলে দ্রুত দৌড়ে যেতে পারেন। সেখানে যেতে যদি জঞ্জাল থাকে তা হলে সৃষ্টিকর্তাকে ভরসা করে শক্ত কোনো কিছুর নিচে অবস্থান নেয়াই শ্রেয়।
দীর্ঘ দিন ধরেই বাংলাদেশে শক্তিশালী ভূমিকম্প এবং সুনামির আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। এর লক্ষণ হিসেবে প্রায়ই দেশের কোথাও না কোথাও মৃদু ও মাঝারি মাত্রায় ভূমিকম্প হচ্ছে। প্রশ্ন হলো ভূমিকম্প মোকাবিলায় বাংলাদেশ কি প্রস্তুত? রানা প্লাজা ধসের পরই আমাদের সক্ষমতা কতোটুকু তা আর বুঝতে বাকি থাকে না। ভূমিকম্প পরবর্তী প্রস্তুতি খুবই জরুরি। হাল সময়ে যে ভূমিকম্প হয়েছে এর উৎপত্তিস্থল ছিলো ভারতের ত্রিপুরা, মায়ানমার, নেপাল এবং চীনে। আমাদের সবচেয়ে কাছে ত্রিপুরায় উৎপত্তি হওয়া ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৫.৫, তবে অন্যান্য ক্ষেত্রে ৭.৪ এবং ৭.৯ মাত্রার ভূমিকম্পও হয়েছে। আমাদের থেকে ভৌগোলিকভাবে সেসব ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল দূরে হওয়ার কারণে সেসবের মাত্রা আমরা ততটা অনুভব করিনি। এ ছাড়াও এ সময়ে ছোট এবং মাঝারি কয়েক দফা ভূকম্পন অনুভূত হয়। মাত্রা হিসাবে নেপাল, চীন এবং ভারতের প্রায় অর্ধেক মাত্রায় ভূমিকম্প অনুভূত হয় বাংলাদেশে। নেপালের সম মাত্রায় বাংলাদেশে ভূমিকম্প হলে রাজধানী ঢাকার ৬০ থেকে ৭০ ভাগ ভবন ধসে এবং হেলে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। সারাদেশে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কতো ভয়াবহ হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।
সরকারের তরফ হতে যন্ত্রপাতি ক্রয় ও স্বেচ্ছাসেবক প্রশিক্ষণের কথা বলা হলেও ভূমিকম্পপরবর্তী বিপর্যয় সামাল দেয়ার ন্যূনতম প্রস্তুতিও যে আমাদের নাই তা স্পষ্ট। ব্যাপক অভাব রয়েছে জনসচেতনতারও। ভূমিকম্পের ব্যাপারে গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ, ইলেক্ট্রনিক ও প্রিট মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার প্রচারণার কোনোটাই সরকারের পক্ষ থেকে করা হচ্ছে না। ইতোমধ্যে অনেক মূল্যবান সময় অপচয় হয়েছে। আর বিলম্ব করা সমীচীন হবে না। ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবিলায় সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণের প্রকৃত সময় এখনই। ভূমিকম্প মোকাবিলায় সর্বদা আমাদের নিজেদেরও প্রস্তুত থাকতে হবে। ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবিলার ক্ষেত্রে আমাদের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত দুইটি। প্রথমত, ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রাকে নিম্নতম পর্যায়ে রাখা এবং দ্বিতীয়ত, ভূমিকম্প পরবর্তী বিপর্যয় সামাল দেয়া।
বাংলাদেশ একটি আরো বড় মাত্রার ভূমিকম্পের দ্বারপ্রান্তে- বিশেষজ্ঞদের এমন সতর্কবাণী এবং বিপদাশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না কিছুতেই। এ অবস্থায় কখন যে আরও তীব্র ভূমিকম্প আঘাত হানে; কখন যে কে তার শিকার হয়, অজানা এ ভয়ে সবার বুক দুরু দুরু। একেকটা ভূমিকম্পের পর আতঙ্ক আরো বেড়ে যায়। আর এ ভয় যেন জয় করার কোনো উপায় নেই। যদিও ভূমিকম্পের বিষয়টি সম্পূণর্ই অনুমেয়। তবে বড় ধরনের ভূমিকম্প হওয়ার কিছু পূর্বলক্ষণ আছে। যা বাংলাদেশে বেশ লক্ষণীয়। এর লক্ষণ হিসেবে প্রায়ই দেশের কোথাও না কোথাও মৃদু ও মাঝারি মাত্রায় ভূমিকম্প হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, কেবল ভূমিকম্পই নয়, দেশের উপকূলীয় এলাকা ঘিরে ভয়াবহ সুনামি সৃষ্টির জন্য সাইসমিক গ্যাপ বিরাজমান আছে। এ গ্যাপ থেকে যেকোনো সময় সুনামিও হতে পারে। তাদের মতে বঙ্গোপসাগরের উত্তরে আন্দামান থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সাবডাকশন জোন বরাবর ৬শ’ কিলোমিটারের একটি সাইসমিক গ্যাপ রয়েছে। আমাদের দেশে শক্তিশালী ভূমিকম্প হওয়ার জন্য যথেষ্ট শক্তি এই সাইসমিক গ্যাপে জমা হয়ে আছে। এখান থেকে ৮ মাত্রার মতো শক্তিশালী ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আর তা যদি সাগরতলে হয় তাহলে সেই ভূমিকম্প সুনামি সৃষ্টি করতে পারে। বাংলাদেশে শক্তিশালী ভূমিকম্প এবং সুনামিরই আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ অবস্থায় কিছু সতর্কতা অবলম্বন করা হলে ক্ষয় ক্ষতির পরিমাণ অনেকাংশে কমে যাবে।
পত্রিকান্তে বিশেষজ্ঞদের যে মতামত পাওয়া গেছে তাতে ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই আমাদের দেশে সুনামি ও ভূমিকম্পের ঝুঁকি বেশি। তাদের মতে ৩টি প্লেটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। বঙ্গোপসাগারের কূল ঘেঁষে বেঙ্গল বেসিনের প্রধান অংশে বাংলাদেশের অবস্থান। তবে বড় ভূমিকম্প হবেই তা কিন্তু নিশ্চিত করে বলা যাবে না। সম্প্রতি যেভাবে দেশে ঘনঘন ভূমিকম্প অনুভূত হচ্ছে তাতে আতঙ্ক বাড়ে বৈকি? অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাস পাওয়া যায়। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগের আগাম খবর অনুযায়ী জানমাল রক্ষায় ব্যবস্থা নেয়া যায়। কিন্তু ভূমিকম্পের বেলায় সে সুযোগ নেই। ভূমিকম্প ঘটে হঠাৎ করে। ফলে জানমাল রক্ষার প্রস্তুতি গ্রহণ করা সম্ভব হয় না।
তা হলে কি ভূমিকম্পে শুধুই অকাতরে প্রাণ দিতে হবে? জীবন রক্ষার কি কোনো উপায় নেই। এ দুর্যোগে কি কোনোই সুযোগ নেই পূর্ব প্রস্তুতির? প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো ভূমিকম্পে আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন হওয়া অধিক জরুরি। তাই ভূমিকম্পের সময় করণীয় সম্পর্কে সঠিক ধারণা রাখা এবং সে অনুযায়ী প্রস্তুত থাকা প্রয়োজন। জাতিসংঘের তৈরি ভূমিকম্পজনিত দুর্যোগের তালিকায় ঢাকা এখন দ্বিতীয় অবস্থানে। ভূবিদদের এক পরিসংখানে দেখা গেছে সাড়ে সাত মাত্রার ভূমিকম্প হলে কেবল রাজধানী ঢাকার প্রায় ৩ লাখ ২৬ হাজার অবকাঠামোর মধ্যে ৭২ হাজার ভবন ধসে যাবে। এতে প্রায় ৯০ হাজার লোকের প্রাণহানী হবে। তাই সচেতন হওয়ার পাশাপাশি যথাযথ উদ্যোগও নিতে হবে। যাতে ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা নিম্নতম পর্যায়ে রাখা যায়। ভূমিকম্পকে ভয় পেলে চলবে না। ভয়কে জয় করতে হবে। ভূমিকম্প থেকে বাঁচার উপায় বের করতে হবে।
য় লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন