বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আদিগন্ত

প্রথম জেলা পরিষদ নির্বাচন ও গণতন্ত্রের হালচিত্র

| প্রকাশের সময় : ৭ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মুর্শিদা খানম : সঠিক ও সুষ্ঠু গণতন্ত্রের উদ্দেশ্যই হচ্ছে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন যন্ত্রের সর্বস্তরের জনবলের অংশগ্রহণ। বর্তমান প্রতিনিধিত্বশীল সরকারের যুগে উন্নত গণতন্ত্রের অর্থ দাঁড়ায়, প্রশাসনের সর্বস্তরে নীতি-নির্ধারণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় জনপ্রতিনিধিরাই মূল ভূমিকা পালন করবেন। জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার বাস্তবায়ন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন ও উন্নয়নের স্বার্থে অধিকতর জনসম্পৃক্তির জন্য বর্তমান যুগে প্রশাসনের বিকেন্দ্রিকরণ একটি অতীব জরুরি বিষয়। আধুনিক রাষ্ট্র জনকল্যাণমূলক হবার কারণে রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও কর্তব্য সকল স্তরের জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়ার উদ্দেশ্যে স্থানীয় সরকার প্রশাসন প্রবর্তন করা হয়েছিল। যেসব দেশে এ বিষয়গুলোর চর্চা হয় সেসব দেশকে উদারনৈতিক গণতন্ত্রের উদাহরণ হিসেবে ধরা হয়।
পাশ্চাত্য উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক তাত্ত্বিকগণ স্থানীয় প্রশাসনকে জনগণের সেবা প্রদানের উপযুক্ত বলে পক্ষে মতামত ব্যক্ত করে এসেছেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জন স্টুয়ার্ট মিলের মতে, সড়ফবৎহ ফবসড়পৎধপু রং ঃযব ৎবংঢ়ৎবংবহঃধঃরাব ফবসড়পৎধপু. অর্থাৎ বর্তমান গণতন্ত্র, প্রতনিধিত্বশীল গণতন্ত্র। তিনি বরাবরই প্রকৃত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রত্যেক গ্রুপের লোকের আনুপাতিক হারে প্রতিনিধিত্ব থাকার উপর গুরুত্ব আরোপ করে এসেছেন। অত্যন্ত পরিতৃপ্তির বিষয় যে, আমাদের দেশে আধুনিক গণতন্ত্রের কাঠামোয় জনপ্রিয় গণতান্ত্রিক উপাদান-ক্ষমতা বিকেন্দ্রিকরণ, স্থানীয় সরকারের স্তর বিন্যাস, স্থানীয় সরকার ও এর প্রতিষ্ঠানগুলো বিদ্যমান আছে। ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, উপজেলা পরিষদ কার্যত চলমান। জনগণ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অংশগ্রহণ ও সেবাগ্রহণের প্রক্রিয়ায় মোটামুটি সংযুক্ত আছে। যাই হোক, দ্রুত উন্নয়নের পদ যাত্রায় বিশ^ যখন অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এমনকি সামরিক ক্ষেত্রসমূহে সফল উন্নয়নের প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের জন্য নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, সন্দেহ নেই বাংলাদেশও এ যাত্রার অন্যতম সহযাত্রী। বাংলাদেশ এখন বিশে^ উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। এ জন্য জাতীয় নেতৃবৃন্দের প্রতি জাতি কৃতজ্ঞ। এরইমধ্যে ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৬ অনুষ্ঠিত হয়ে গেল স্থানীয় সরকারের অন্যতম স্তর জেলা পরিষদ নির্বাচন। এটি স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে প্রথম জেলা পরিষদ নির্বাচন।
বহু প্রাচীনকাল থেকে এদেশে যে স্থানীয় সরকারের অস্তিত্ব ছিল তা বারবার পরিবর্তন হয়েছে, রাজনৈতিকভাবে হোঁচট খেয়েছে আর নানা বিবর্তনের পথ ধরে আজ তা বাংলাদেশে বিকাশমান। আজকের ‘জেলা পরিষদ’ ব্রিটিশ আমলে ‘জেলা বোর্ড’ নামে পরিচিত ছিল। পাকিস্তান আমলে ‘জেলা কাউন্সিল’ এবং স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশে এটি আবার ‘জেলা বোর্ড’ নামে অভিহিত হয়। ১৯৭৫ সালে ‘জেলা গভর্নর’ পদ্ধতি চালু হলেও শেষ পর্যন্ত তা কার্যকর হতে পারেনি। ১৯৭৬ সালে স্থানীয় সরকার অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে জেলা বোর্ডের নামকরণ হয় ‘জেলা পরিষদ’। ১৯৮৮ সালে স্থানীয় সরকার (জেলা পরিষদ) বিল পাস হয়। ওই আইনেও পরোক্ষ নির্বাচনের বিধান রাখা ছিল। এতে ছিল সংশ্লিষ্ট জেলার সংসদ সদস্য, উপজেলা পরিষদ চেয়্যারম্যান ও পৌরসভা চেয়্যারম্যান, মনোনীত সদস্য, মনোনীত মহিলা সদস্য এবং কতিপয় সরকারি কর্মকর্তা।
এভাবে জেলা পরিষদ ১৯৯০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত কাজ করেছে। ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকারের সময় ঐ আইনটি বাতিল করে দেওয়া হয়। সরকারের উপসচিব পদমর্যাদার একজন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা দিয়ে জেলা পরিষদ পরিচালনা শুরু হয়। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকার জেলা পরিষদ আইন, ২০০০ পাস করে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ আবারও ক্ষমতায় এসে জেলা পরিষদ সক্রিয় করার উদ্যোগ নেয়, ২০১১ সালের ডিসেম্বর সরকার জেলা পরিষদ আইন, ২০০০ এর ৮২(১) ধারা অনুযায়ী দেশের তিনটি পার্বত্য জেলা বাদে বাকি ৬১টি জেলা পরিষদে প্রশাসক নিয়োগ করে। সে আইন অনুসারে, নির্বাচিত জেলা পরিষদ গঠিত না হওয়া পর্যন্ত সরকার কর্র্তৃক নিযুক্ত প্রশাসক জেলা পরিষদের কার্যাবলী সম্পাদন করেন। সম্প্রতি সংসদে পাস হয়েছে ‘জেলা পরিষদ (সংশোধন)’ বিল ২০১৬। এ বিল অনুযায়ী এখন থেকে স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ভোটে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্য নির্বাচিত হবেন। প্রতিটি জেলায় ১৫ জন সাধারণ ও ৫ জন সংরক্ষিত (মহিলা) সদস্য থাকবেন। এ নির্বাচনে স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিরাই শুধু ভোট দিতে পারবেন। প্রার্থীর প্রস্তাবক-সমর্থককেও হতে হবে স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধি।
ইতিহাসের প্রথম জেলা পরিষদ নির্বাচন আইয়ুবীয় ‘বেসিক ডেমোক্রেসি’ বা ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ ধাচের হওয়ায় অর্থাৎ ঞযব বষবপঃৎড়ধঃব বা নির্বাচকম-লীর ভোটে নির্বাচন অনুষ্ঠান সংবিধানের মূল চেতনার পরিপন্থী হলেও স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত ‘জেলা পরিষদ’ নামে একটি প্লাটফর্ম তৈরি হবে এটাই প্রত্যাশা। ‘জেলা পরিষদ নির্বাচন’ অনুষ্ঠান জাতির দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু, এদেশের গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষের মধ্যে নির্বাচনী উচ্ছ্বাসের ভাটা লক্ষণীয়। তাছাড়া দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক জোটের নিবার্চন বর্জন ও মিডিয়ার বদৌলতে প্রাপ্ত রিপোর্টও এ নির্বাচন এবং গণতন্ত্রকে আবারও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
২৭ ডিসেম্বর ২০১৬ জাতীয় দৈনিক প্রথম আলোর সংবাদ শিরোনাম ছিল ‘জেলায় জেলায় উড়ছে টাকা’। পত্রিকাটির প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য অনুযায়ী, নির্বাচনকে ঘিরে ভয়, চাপ ও অনুরোধের পাশাপাশি টাকাও উড়ছে এমন খবরই দেওয়া হয়েছে। ২৭ ডিসেম্বর, ২০১৬ জাতীয় দৈনিক ‘নয়াদিগন্ত’ এর শিরোনাম ছিল, ‘জেলা পরিষদ নির্বাচনে টাকার খেলা’ এ নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নেয়ায় মুখোমুখি অবস্থানে ছিল আওয়ামী লীগ সমর্থিত ও তাদের বিদ্রোহী প্রার্থীরা। অল্প সংখ্যক ভোটার হওয়ায় প্রার্থীরা ভোটাদের মন জয় করতে মোটা অংকের টাকাসহ উপহার বিতরণ করছেন। নির্বাচনকে ঘিরে এ ধরনের ঘটনা ঘটলেও কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি ইসি। স্থানীয় এমপি ও মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ পেলেও তার প্রতিকারে কোনো তৎপরতা ছিল না। তবে চমকপ্রদ খবর ছিল গত ১ জানুয়ারি ২০১৭ দৈনিক কালেরকণ্ঠের ‘ভোট দিলি না, টাকা দে’ শিরোনামের খবরটি। খবরটি থেকে জানা গেছে, গাইবান্ধা জেলা পরিষদে সদস্য পদে নির্বাচন করেছিলেন এমন একজন প্রার্থী তার নির্বাচনী এলাকার ৬৭টি জন ভোটারের মধ্যে ৩৫ জনকে টাকা দিয়েছিলেন। কিন্তু নির্বাচনে তিনি পেয়েছেন ১০ ভোট। এমন ঘটনা ছিল ঘটেছে আরও অনেক স্থানেই। তাই নির্বাচনে হেরে গিয়ে অনেকেই তাদের টাকা ফেরত চেয়েছেন।
এই যদি হয় নির্বাচনী আবহ আর পরিস্থিতি সেখানে সুষ্ঠু গণতন্ত্রের উপস্থিতি বড়ই ম্লান। টিআইবি-এর নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান মন্তব্য করেছেন ‘বাংলাদেশে নির্বাচনের সংস্কৃতিটাই এমন হয়েছে যে, প্রার্থী হওয়া, ভোট পাওয়া বা নির্বাচিত হওয়ার ক্ষেত্রে টাকা-পয়সা একটি বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে’। স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘কয়েকদিন ধরে দেশের বিভিন্ন এলাকায় নির্বাচনকে ঘিরে টাকা লেনদেনের যেসব খবর আসছে, তা দুঃখজনক ও নিন্দনীয়’।
স্থানীয় সরকারের অন্যান্য সকল প্রতিষ্ঠান যেমন সিটি কর্পোরেশন, উপজেলা, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদে প্রত্যক্ষভোটের বিধান থাকলেও জেলা পরিষদে প্রত্যক্ষ বিধান না থাকায় জনগণের মধ্যে ক্ষোভের প্রতিফলন দেখতে পাওয়া গেছে। দীর্ঘদিনের প্রত্যাশিত গণতান্ত্রিক এই প্রতিষ্ঠানটির নির্বাচন জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হলে বর্তমান সরকারের অর্জিত সকল উন্নয়নের সাথে রাজনীতি ও গণতন্ত্রের উন্নয়নে সরকারের আরও একটি অনবদ্য অর্জন ও অবদান বলে স্বীকৃতি পেত বলে মনে করছেন বিজ্ঞমহল। অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফলাফলে দেখা গেছে, নির্বাচন হয়েছে ৬১টি জেলায়, এর মধ্যে স্থগিত (বগুড়া ও কুষ্টিয়া) দুই জেলায় নির্বাচন। ২১ জেলায় ২১ জন আওয়ামী লীগের প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছেন। ঘোষিত ফলাফলে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগ সমর্থিত ব্যক্তিরা জয়ী হয়েছেন ২৫ জেলায়। সব মিলিয়ে আওয়ামী সমর্থিত চেয়ারম্যান হয়েছেন ৪৬ জন। অন্যরা বিদ্রোহী প্রার্থী আওয়ামী লীগেরই সাবেক ও বর্তমান নেতা। জেলা পরিষদে এমন নির্বাচনী ফলাফল ক্ষমতাসীন সরকারের জন্য কোনো অশনিসংকেত বহন করছে কিনা তা রাজনীতি বিশ্লেষকদের ভেবে দেখার প্রয়োজন রয়েছে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী টমাস রো মনে করেন, ‘গণতন্ত্র হলে স্বাধীনতা ও সাম্যের এবং ব্যক্তিমূল্য ও সমাজ চাহিদার সমন্বয়।’ আমরা দেখেছি, পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী অনেক জেলায় বিদ্রোহী প্রার্থীরা দলীয় প্রার্থীদের চেয়ে জনপ্রিয়তায় এগিয়ে ছিলেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের গণতন্ত্রে কি টমাস রো এর সাম্য, স্বাধীনতা ও সমাজ চাহিদার ঘাটতি রয়েছে? নইলে, প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের নির্বাচন বর্জন, প্রভাবশালী নেতাদের অনিয়ম-আচরণবিধি লঙ্ঘন আমাদের রাজনৈতিক সমাজকে ঘায়েল করছে কেন? দলের মধ্যে দলীয় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর বিজয় কিসের ইঙ্গিত বহন করছে। উন্নয়নের ‘রোল মডেল’ হিসেবে এগিয়ে যাওয়া আমাদের প্রিয় দেশটির গণতন্ত্রের উন্নয়ন ঘটেছে কতটুকু, এই যদি হয় স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে গণতন্ত্রের হাল চিত্র- তা হলে এটা জাতির সামনে অবশ্যই চিন্তার খোরাক। তবুও স্বস্তি এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জন প্রত্যাশা ও দাবি উঠে আসার জন্য তৈরি হলো ‘জেলা পরিষদ’ নামক স্থানীয় গণমানুষের এক বৃহৎ প্লাটফর্ম। জেলার উন্নয়ন ও এলাকাবাসীর আশা-আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নের বিষয়গুলো উঠে আসার নতুন পথ সৃষ্টি হলো।
লেখক : স্থানীয় সরকার ও রাজনীতি বিষয়ক পিএইচডি গবেষক, রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়
mkhanam.ru@gmail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন