মুহাম্মদ আবদুল কাহহার : গত ১৯ ডিসেম্বর জাতীয় ‘ওষুধনীতি ২০১৬’ অনুমোদন করেছে সরকার। ২০০৫ সালের পর এটিই পরিপূর্ণ এক নীতিমালা। নীতিমালায় বিদ্যমান আইন ও বিধিমালা সংশোধন, কার্যকর, নিরাপদ ও ওষুধের মান, ওষুধ প্রস্তুত, বিক্রি, ওষুধ সংগ্রহ, মজুদ, বিতরণ, বিজ্ঞাপন, মূল্য নির্ধারণ, আমদানি ও রপ্তানি ওষুধ গবেষণা উন্নয়ন ইত্যাদি বিষয়ে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় এ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। একই সাথে ওষুধের দামবৃদ্ধির প্রবণতা রোধে প্রতি বছর ওষুধের দাম হালনাগাদ করার বিধান রাখা হয়েছে। তিন দশকে ওষুধ শিল্পের অগ্রগতি রিপোর্ট থেকে জানা যায়, গামর্ন্টেস শিল্পের মতো ওষুধ শিল্পও এগিয়ে চলছে। এখন দেশের ওষুধের চাহিদার ৯৭ শতাংশ ওষুধের যোগান দিচ্ছে দেশীয় কোম্পানিগুলো। স্বাধীনতার পর পর মোট চাহিদার মাত্র ২০ শতাংশ ওষুধ আমাদের দেশে তৈরি হয়েছে, আর ৮০ শতাংশ নির্ভর করতে হয়েছে বৈদেশিক আমদানির উপর। সেই বাংলাদেশ এখন ৯৭ শতাংশ অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হয়েছে। ডা. এহসানুল কবির এক সাক্ষাৎকারে বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশ প্রায় ২৬৯টি ওষুধ কোম্পানি বিশ্বের ১৩৩টি দেশে বাংলাদেশ ওষুধ রফতানি করছে।
দেশের অনেক কোম্পানি এখন আন্তর্জাতিক মানের ওষুধ তৈরি করছে এ দৃষ্টান্ত যেমন আছে, আবার অনেক কোম্পানি ভেজাল ওষুধ খেয়ে মানুষের মৃত্যু ঘটেছে এ দৃষ্টান্তও আছে। তাই ‘শৃঙ্খলা ফিরছে ওষুধ শিল্পে’ এই ধরনের শিরোনাম পত্রিকায় দেখলে আশান্বিত হই। ঠিক একইভাবে কোনো জাতীয় দৈনিকের শিরোনাম যখন এরকম হয় ‘ভেজাল ওষুধে ২৮ জনের প্রাণহানি’ তখন হতাশ হই। কিন্তু কেন? এ প্রশ্ন সবার। নীতিমালায় বলা হয়েছে, প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওষুধ কেনা যাবে মাত্র ৩৯টি, বাকি প্রায় এক হাজার ২০০ আইটেমের ওষুধ কিনতে প্রেসক্রিপশন লাগবে। এবারই প্রথম অ্যালোপেথিকের বাইরে আয়ুর্বেদিক, হোমিওপ্যাথিক, উইনানির মতো ওষুধকেও নীতিমালায় আনা হয়েছে। ওষুধ খাতে বিশৃঙ্খলা কমাতে সরকার যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে তা ইতিবাচক হলেও এ বিষয় খবর রাখেননি অসংখ্য ওষুধ বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান।
আমরা প্রত্যেকেই চাই যেন সুস্থ থাকি। এজন্য নানা উপায় অবলম্বন করি। ব্যক্তিবিশেষে বিভিন্ন ধরনের ওষুধ গ্রহণ করে আমরা অভ্যস্ত। এ ক্ষেত্রে খুব কম সময়ে আমরা চিকিৎসকদের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী ওষুধ সেবন করি। আর অধিকাংশ সময় নিজেকে অভিজ্ঞ ডাক্তারের আসনে বসাই। তাছাড়া আমাদের অনেকেরই একটি প্রচলিত অভ্যাস হলো, রাজনৈতেক ব্যাপারে আলোচনা শুনলেই নিজেই হয়ে উঠি বড় একজন রাজনীতিবিদ কিংবা বুদ্ধিজীবী। মাসয়ালা-মাসায়েল বিষয়েও আমরা জ্ঞানীদের চেয়ে নিজেরাই বড় ফতোয়াবাজ হয়ে যাই। কথা বলার সুযোগ পেলে সবটুকু সময় একাই কথা বলতে চাই, তিনি নিজেকে ভাবি বড় মাপের বক্তা। তেমনিভাবে কারো অসুস্থতার কথা শুনেই সে রোগের প্রতিকারে ওষুধের নাম বলতে থাকি। আমাদের এমন চিন্তাধারাতেও পরিবর্তন আনতে হবে।
ওষুধের মান বজায় না থাকলে অসুখ ভালো হওয়ার পরিবর্তে শরীরের মারাত্মক ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। ভোক্তার যেমন জানা নেই ওষুধনীতি তেমনি ওষুধ প্রেসক্রাইবকারী ও বিক্রেতা তার মুনাফা বৃদ্ধির জন্য ইচ্ছামাফিক ওষুধ দিয়ে থাকেন। ভেজাল ওষুধের বাজার কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে সে বিষয়ে একটি ঘটনা বললে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে উঠতে পারে। দু’বছর আগে ঢাকার একটি প্রাইভেট হাসপাতালে একজন শিশুবিশেষজ্ঞের চেম্বারে অবস্থানকালে একজন ব্যক্তির সাথে দেখা হলো, যিনি মিডফোর্ড থেকে প্রস্তুতকৃত একটি ওষুধ বাজারজাত করেন। তিনি ওই হাসপাতালে তার এক আত্মীয়ের সাথে দেখা করতে এসেছেন। সেখানে উপস্থিত চার ব্যক্তিই একজন আরেকজনের সাথে পূর্ব পরিচিত। ওষুধ কীভাবে বাজারজাত করেন, লভ্যাংশের হার কেমন, কোথায় তৈরি, কোন রোগের উপকার করবে, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে কিনা ইত্যাদি জানতে চাইলে তিনি চিকিৎসকের এক প্রশ্নের জবাবে বলেই ফেললেন ‘আমার এ ওষুধে কারো উপকারও হবে না, আবার কারো ক্ষতিও হবে না। চিকিৎসক তাকে প্রশ্ন করলেন, ‘তাহলে ওই ওষুধ রোগীরা কেন কিনবেন? আর আপনি তা জেনে-শুনে কেন বিক্রি করছেন?’ লোকটি তখন বলল, পড়ালেখা করেছি, চাকরি পাচ্ছি না, একটা কিছু না করলে চলব কীভাবে? পাঠকদেরকে এ ঘটনাটি এ জন্য জানালাম যে, আমাদের সমাজে এমন অসংখ্য অসাধু ব্যক্তি আছেন যারা মানুষের সাথে নিয়মিত প্রতারণা করে চলছেন। এমন ভেজাল ওষুধ বাজারজাত করতে অসংখ্য মানুষ হন্য হয়ে ঘুরছেন, কিন্তু আমরা হয়তো কারো খবর রাখছি না।
শহর থেকে পল্লী এলাকার পথে-ঘাটে যত্রতত্র ফেরি করে ওষুধ বিক্রি করে চলছে এক শ্রেণীর ওষুধ বিক্রেতা। কখনো রাস্তার পাশে, কখনো বাজারে, হয়তো বাসস্ট্যান্ডে নয়তো রেলস্টেশনে, কিংবা জনসমাগম হয় এমন স্থানে তারা নি¤œমানের ওষুধ বিক্রি করেন। তাদের ওষুধে মৃত্যু ছাড়া সব রোগ ভালো হয়- এমনটিই তারা দাবি করে থাকেন। কোনো কোনো ওষুধ তারা নিজ হাতে বাড়িতে তৈরি করেন আবার কিছু কিছু তারা বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করেন। কেউ হ্যান্ড মাইক নিয়ে, কেউ প্রাইভেটকারের ছাদে মাইক লাগিয়ে কেউবা নিজস্ব বুদ্ধিমত্তা খাটিয়ে স্থান-কাল-পাত্র ভেদে ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিতে মানুষকে আকৃষ্ট করে নি¤œমানের ওষুধ বিক্রি করছেন। তাদেরকে ওই ব্যবসা বন্ধে সরকারকে কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায় না। ওইসব ভেজাল ও গুণগতমান পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া যেসব ওষুধ বাজারে আসছে তার উৎস বন্ধ করা না হলে সাধারণ মানুষ ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পাবে না। ক্রেতা-বিক্রেতা যে যার মতো করে অনিয়মকে নিয়মে পরিণত করে চলছে। ফলে সুস্থতার পরিবর্তে ক্রমশ জটিল ও কঠিন রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। অ্যালোপ্যাথিক ও আয়ুর্বেদিকসহ সব ওষুধেই ভেজাল পাওয়া যাচ্ছে। ওষুুধ কোম্পানিগুলো লোভনীয় অফার দিয়ে চিকিৎসকদের ম্যানেজ করে নি¤œমানের ওষুধ বাজারজাত করার উপায় অবলম্বন করছেন।
অপরদিকে অধিকাংশ রোগীর একটা অভ্যাস হলো- তারা বেশি ওষুধ খেতে রাজি নয়। অ্যান্টিবায়োটিক কিংবা স্বাভাবিক ওষুধ কোনোটি পূর্ণ মাত্রায় সেবন করবেন না। খুব তাড়াতাড়ি ভালো হতে অধিক মাত্রার ওষুধ গ্রহণ করেন। এ ক্ষেত্রে রোগী নিজেই নিজের চিকিৎসক। ওইসব রোগীরা চিকিৎসকদের এড়িয়ে চলেন। পরবর্তীতে দেখা যায়, এই লোকগুলোই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। বিতর্কিত ওইসব ওষুধ খেয়ে কিডনি বিকল, বিকলাঙ্গতা, লিভার, মস্তিষ্কের জটিল রোগসহ বিভিন্ন সংক্রামক রোগে মৃত্যুর ঘটনাও বাড়ছে। অধিকাংশ মানুষ এতটা অসচেতন যে, ভুল চিকিৎসা কিংবা ভুল ওষুধ গ্রহণে বড় ধরনের ক্ষতি হচ্ছে অথচ নিজের মধ্যে কোনো উপলব্ধি নেই। সে কারণে একজন লেখক বাস্তবতা তুলে ধরে লিখেছেন, ‘দেশে প্রচুর ওষুধ, কিন্তু মানুষের জন্য ওষুধ নেই।’ ছোট্ট এই কথাটির মর্মার্থ অধিক।
সর্বোপরি, জনসচেতনতা কীভাবে বৃদ্ধি করা যায় সে লক্ষ্যে প্রত্যেকের অবস্থান থেকে চেষ্টা করতে হবে। তাছাড়া বাজারে ভেজাল, মেয়াদউত্তীর্ণ, নকল, অনুমোদনহীন যেসব ওষুধ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তা বন্ধ করা না হলে নীতিমালা কাজে আসবে না। এজন্য ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে যথাযথ মনিটরিং জোরদার করতে হবে। কোন ওষুধের মূল্য কত হবে তা ওষুধ প্রশাসনের ওয়েবসাইটে উল্লেখ থাকলেই হবে না বরং তা মাঠপর্যায়ে কার্যকর হচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে হবে। কৃত্রিম সংকট তৈরি করে কেউ যাতে বেশি টাকা না নিতে পারে সে বিষয়ে নজরদারি বাড়াতে হবে। ভালো উদ্যোগ নিয়ে তা ফাইলবন্দি না রেখে আইনের বাস্তবায়ন করতে হবে।
য় লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন