বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আদিগন্ত

নিন্দিত এক-এগারোর এক দশক

| প্রকাশের সময় : ১৩ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

হোসেন মাহমুদ : ২০০৭ সালের প্রথম মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বাংলাদেশে একটি দিন এসেছিল। এ রকম একটি দিন আসবে, কেউ ভাবেনি। সে দিনটি হলো ১১ জানুয়ারি। যুক্তরাষ্ট্রের নয়-এগারোর আদলে আমাদের দেশে দিনটিকে এক-এগারো বলে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশের ইতিহাসে দিনটি ব্যাপকভাবে নিন্দিত। অবশ্য প্রথমদিকে অনেকেই এক-এগারোর পরিবর্তনকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। দেশব্যাপী রাজনৈতিক গোলযোগ ও বিশৃঙ্খলার মধ্যে সেদিন সেনাবাহিনীর সমর্থনে দেশে জরুরি অবস্থা জারি হয়। পরদিন গঠিত হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। শুরু হয় সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনকাল। কেউ কেউ একে তিন উদ্দিনের শাসনকালও বলে থাকেন। সেই এক-এগারোর এবার এক দশক পূর্তি হলো।
কীভাবে ঘটল এক-এগারো? তার কিছুটা বর্ণনা দিয়েছেন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী তৎকালীন প্রেসিডেন্টের প্রথমে প্রেস সেক্রেটারি ও তারপর উপদেষ্টা দিনকালের সাবেক সাংবাদিক মোখলেসুর রহমান চৌধুরী। তিনি সেদিনের কথা লিখেছেন এ ভাবে- ‘জেনারেল মইনের সাথে ছিলেন নৌবাহিনী প্রধান রিয়ার এডমিরাল হাসান আলী খান, বিমান বাহিনী প্রধান এয়াার ভাইস মার্শাল ফখরুল আজম, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের পিএসও মেজর জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, এসএসএফ ডিজি মেজর জেনারেল সৈয়দ ফাতেমী আহমেদ রুমী, রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিব মেজর জেনারেল আমিনুল করিম, ডিজিএফআই-র ভারপ্রাপ্ত ডিজি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল চৌধুরী ফজলুল বারী। তিন বাহিনী প্রধান ছাড়া বাকি কর্মকর্তারা আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত সভা উপলক্ষে আগেই বঙ্গভবনে এসেছিলেন। রাষ্ট্রপতির সাথে দেখা করার সময় জেনারেল মইন সশস্ত্র অবস্থায় ছিলেন। রাষ্ট্রপতিকে ভয় দেখানোর জন্য জেনারেল মইনের অস্ত্র দৃশ্যমান অবস্থায় ছিল।
সেনাপ্রধান মইন বিভিন্ন বিষয়ে উপস্থাপনা দিয়ে ড. ইয়াজউদ্দিনকে প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশে জরুরি আইন জারির আদেশে সই করতে বলেন। রাষ্ট্রপতির ভাষণ, জরুরি অবস্থা জারির কাগজপত্র এবং প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগপত্র ইত্যাদি কাগজপত্র সেনাপ্রধান ও তার সহযোগীরা আগেই তৈরি করে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। চাপের মুখে রাষ্ট্রপতি পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করতে না চাইলে সেনাপ্রধান মইন কলম এগিয়ে দেন। লে. জেনারেল মইন রাষ্ট্রপতির সামনে থেকেই মেজর জেনারেল মাসুদকে বঙ্গভবনে আসার জন্য কয়েকবার নির্দেশ দেন। ঘণ্টাখানেক পরে নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল মাসুদ এ কক্ষে প্রবেশ করে মইনের সাথে যোগ দেন। এরপরে রাষ্ট্রপতি মইন ও তার সহযোগীদের সম্মিলিত চাপের মুখে তাদের দেয়া কাগজপত্রে স্বাক্ষর করেন। রাষ্ট্রপতি এ বিষয় নিয়ে তার পতœী ও আমার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলেন। আমাকে তিনি তাদের উপস্থিতিতে ডেকেছিলেন। কিন্তু আমাকে সেখানে যেতে দেয়া হয়নি। সই করার সময় আতংকে রাষ্ট্রপতির হাত কাঁপছিল। পদত্যাগপত্র ও জরুরি অবস্থার অধ্যাদেশ ছাড়াও অনেকগুলো সাদা কাগজে রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর নেয়া হয়। পরবর্তীতে এ সকল সইয়ের মাধ্যমে নানাবিধ অবৈধ কাজ হাসিল করা হয়।’
তিনি আরো লিখেছেন, ‘সেনাপ্রধানের সরবরাহ করা জাতির উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রপতির ভাষণের কপি আমি আমার দায়িত্ব হিসাবে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে পরামর্শ করে সংশোধন করেছিলাম। কিছু আপত্তিকর লাইন কেটেছিলাম। ...সেনাপ্রধানের সঙ্গে রাত সাড়ে বারটায় এ নিয়ে আমার কথা হলে আমি তাকে বললাম, আপনাদের লেখা এ ভাষণে ৯ জন উপদেষ্টার কাছ থেকে পদত্যাগপত্র গ্রহণ এবং অপর উপদেষ্টা বিচারপতি ফজলুল হককে ভারপ্রাপ্ত প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব প্রদানের যে কথা বলা হয়েছে তা মারাত্মক ভুল ও সংবিধান পরিপন্থী। ...সেনাপ্রধানের সাথে কথা শেষ হওয়ার পরে শেখ হাসিনা ফোনে আমার কাছে জানতে চান, উপদেষ্টাদের কাছ থেকে পদত্যাগপত্র নেয়া এবং বিচারপতি ফজলুল হককে ভারপ্রাপ্ত প্রধান উপদেষ্টা করার মতো ভুলগুলো কি করে হলো। আমি তাকে জানাই যে, সেনাপ্রধান এগুলো করেছেন এবং এইমাত্র আমি এ বিষয়ে সেনাপ্রধানের সঙ্গে কথা বলেছি।’ তার ভাষ্যের সত্যাসত্যের দায়িত্ব তার। তবে তার কথায় আরো জানা যায় যে, জেনারেল মইন সেদিন মার্শাল ল’ জারি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতায় তা ব্যর্থ হয়। তিনি জরুরি অবস্থা জারি করেন।
কী ছিল এক-এগারোর মূল উদ্দেশ্য? কী করতে চেয়েছিলেন তারা? কেউ কেউ বলেন, স্থায়ী সামরিক শাসন কায়েম করতে চেয়েছিলেন তারা। কিন্তু পরবর্তী অবস্থায় সেদিকে আর তারা হাঁটেননি। ২০০৭-৮ সালে এ নিয়ে কেউ গবেষণা করেননি, হয়তো সাহস পাননি। আর ২০০৯-এ এসে বা তারপরও এ নিয়ে কেউ তেমন একটা অগ্রসর হননি। কারো কারো ধারণা, এক-এগারো নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার ব্যাপারে ক্ষমতাসীন সরকারের মধ্যে এক ধরনের অনাগ্রহমূলক মনোভাব থাকায় সরকার সমর্থক বা অনুরাগী লেখক-গবেষক-বিশ্লেষক-সাংবাদিক কেউই এ নিয়ে চিন্তার চর্র্চা করেননি বললেই চলে। উল্লেখ্য, তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ড. ইয়াজ উদ্দিন আহমেদকে আইনি খুঁটি হিসেবে দাঁড় করিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফখরুদ্দীন আহমদের কাঁধে বন্দুক রেখে দু’বছর ধরে দেশের সকল ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করেন সেনাপ্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমেদ। শোনা যায় যে বেশ কিছুদিন ধরে আলোচনার পর গোটা পরিকল্পনা স্থির করা হয়, যার পিছনে ছিল বিশেষ কিছু দেশের সমর্থন, যাদের ঢাকাস্থ রাষ্ট্রদূতরা জড়িত ছিলেন শলা-পরামর্শে। তবে প্রকৃত ও বিশদ তথ্য জেনারেল মইনেরই জানা বলে বলা হয়ে থাকে। এক-এগারো পরবর্তীকালে তিনি যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী হয়েছেন। এ পর্যন্ত দেশে ফেরেননি, ফিরবেন বলেও বলেননি। কয়েক বছর আগেই তিনি বলেছিলেন যে গ্রন্থ রচনা করে বিশদ জানাবেন। তার সে বই রচনা সম্পন্ন হয়েছে কিনা জানা যায়নি। কবে তা আলোর মুখ দেখবে তা তিনিই ভালো জানেন।
সে সরকারের সর্বাপেক্ষা বড় কুকীর্তি হচ্ছে ‘মাইনাস টু’ থিওরি বাস্তবায়নের চেষ্টা। সাদামাটা কথায় বলতে হয়, তারা দেশের বিদ্যমান রাজনীতিবিদদের রাজনীতি থেকে অবসরে পাঠানোর পদক্ষেপ নেন। এ জন্য একটি পরিকল্পনা নেয়া হয় যদিও তা ছিল সীমিত দৃষ্টিভঙ্গিজাত এবং একেবারেই অবাস্তব। সে কারণে তা ব্যর্থ হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে। তারা ‘কিংস পার্টি’ তৈরির চেষ্টা করেন। তবে সেটা সফল হয়নি। যাহোক, তাদের বিশেষ অপচেষ্টা ছিল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সংস্কারপন্থী গ্রুপ সৃষ্টি করে দু’দলকে দুই নেত্রীমুক্ত করা। এক্ষেত্রে উভয় দলের মধ্য থেকে অত্যন্ত সীমিত সাড়া মেলে। ফলে কাক্সিক্ষত ফল লাভ করা সম্ভব হয়নি। পরিণতিতে দু’দলেই এসব কথিত সংস্কারপন্থীরা দলচ্যুত হয়ে পড়েন। আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে শেষ পর্যন্ত দলের সভানেত্রী তাদের সবাইকে মার্জনা করে দলের মূল¯্রােতে ফিরিয়ে নেন। এতে দল উপকৃত হয় বলেই দেখা যায়। কিন্তু বিএনপি চেয়ারপারসন তার দলের কথিত সংস্কারপন্থীদের প্রতি ক্ষমার হাত প্রসারিত করেননি। তাই তারা বিএনপির দলীয় বলয়ের বাইরেই রয়ে গেছেন। এতে বিএনপির ক্ষতি হয়েছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেন। শোনা যায়, এ সংস্কার কাজে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল দ্বয় খুবই তৎপর ছিলেন। তাদের আরেকটি কুকীর্তি হল আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাবিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে আটক করে কারাবন্দি রাখা। শেখ হাসিনাকে আটক করা হয় ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই এবং বেগম খালেদা জিয়াকে আটক করা হয় ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর। তাদের দু’জনকেই জাতীয় সংসদ ভবনের দু’টি বাড়িকে সাব জেল বানিয়ে সেখানে বন্দি রাখা হয়।
এক-এগারোর কুকীর্তির আরেকটি হচ্ছে তারেক রহমানকে গ্রেফতার করে নির্মম নির্যাতন করা। ২০০১-২০০৬ মেয়াদে তারেক রহমানের নামের সাথে হাওয়া ভবনকে জড়ানো হয়। এটি পরিণত হয় আওয়ামী লীগের বিএনপি বিরোধী প্রচারণার এক প্রধান অস্ত্রে। এর সত্যাসত্য সম্পর্কে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দলীয়দের মধ্যে পরস্পরবিরোধী মত রয়েছে। তবে কোনো কোনো বিএনপি নেতা ঘোর তারেক বিরোধী। তারা হাওয়া ভবন তত্ত্বকে সমর্থন করেন। যাহোক, তারেক রহমান সকল কাজের পার্সেন্টেজ গ্রহণকারী, তার ইঙ্গিত বা অনুমোদন ছাড়া সরকারের কোনো কাজই হত না ইত্যাদি কথা প্রচলিত হয় এবং আওয়ামী লীগ আজো তা জোরালোভাবে ব্যবহার করে। তারেক রহমানের সকল আর্থিক দুর্নীতির একান্ত সহযোগী হিসেবে ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের গলায় মামলা ও জেলের মালা ওঠে। যাহোক, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৭ সালের ৭ মার্চ তারেক রহমানকে গ্রেফতার করে। কোন অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করা হলো তা তখন বলা হয়নি। তবে গ্রেফতারের বেশ কয়েকঘণ্টা পর তার বিরুদ্ধে এক ব্যক্তি তারেক রহমান তার কাছে এক কোটি টাকা চাঁদা দাবি করেছিলেন বলে এক মিথ্যা মামলা দায়ের করেন। কথা হচ্ছে, তারেক রহমানকে গ্রেফতার করা যেতেই পারে। কিন্তু মূল ঘটনা অন্যরকম ছিল বলে প্রতীয়মান হয়। গ্রেফতারের পর তার উপর নির্মম নির্যাতন চালানো হয় যাতে এক পর্যায়ে তার মেরুদ- ভেঙে যায় বা প্রচ- আক্রোশে তা ভেঙে দেয়া হয়। অবশেষে ২০০৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর চিকিৎসার জন্য আদালতের নির্দেশে তাকে মুক্তি দেয়া হয়। তাকে পঙ্গু করে দেয়ার কোনো দায় জেনারেল মইন নেননি। তিনি তারেক রহমানের উপর নির্যাতন চালানোর কথা জানতেন না বলেও দাবি করেছেন। পরে খালেদা জিয়ার অপর পুত্র আরাফাত রহমানকেও গ্রেফতার করা হয়।
এক-এগারোর কুশীলবদের কুকীর্তির এখানেই শেষ হয়নি। দেশের বেশ কিছু রাজনৈতিক নেতাকে আটক করা হয়। অন্যদিকে বিশেষ সংস্থার লোকজন অনেক বিত্তবান ব্যবসায়ীকে আটক ও হয়রানির শুরু করে। কারো কারো কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আদায়ের ঘটনাও ঘটে। রাজনীতির প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়া জনগণের একাংশ প্রথম দিকে এসব কর্মকা-ে উল্লসিত হলেও শেষ পর্যন্ত তারাও এর প্রয়োজনীয়তা ও সুফলের ব্যাপারে আস্থা হারায়। এভাবে ক্ষুব্ধ জনগণের উল্লেখযোগ্য অংশের সমর্থন প্রথমে পেলেও সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার পরে তা আর ধরে রাখতে পারেনি। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে তুচ্ছ ঘটনায় ছাত্রদের সাথে সেনা সদস্যদের সংঘর্ষ ও প্রতিবাদী কয়েকজন বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষককে কারাগারে প্রেরণের ঘটনা জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে।
সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ে দেশের দু’ প্রধান রাজনৈতিক দলের দৃষ্টিভঙ্গি ও অবস্থান পৃথক। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে কারারুদ্ধ করা সত্ত্বেও, তার দলের নেতাদের জেলে নিলেও তিনি ২০০৮ সালেই ঘোষণা করেন যে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে এ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সকল কর্মকা- অনুমোদন করবে। তাই করা হয়েছে। তাকে অন্যায়ভাবে জেল খাটানোর জন্য তিনি তাদের অভিযুক্ত করলেও দায়ী ব্যক্তিদের কারো বিরুদ্ধেই কোনো ব্যবস্থা নেননি। এমনকি সংসদে এ নিয়ে দাবি উঠলেও কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। দুর্মুখেরা দাবি করেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাথে আওয়ামী লীগের গোপন সমঝোতা ছিল। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের নেপথ্যে তাদের ভূমিকা ছিল। শুধু তাদেরই নয়, এতে যুক্তরাষ্ট্রেরও যে ভূমিকা ছিল তা পরবর্তী সময়ে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মধ্যকার টেলিফোন সংলাপকালে হিলারি তাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন বলে প্রকাশিত খবরের কথা হয়তো অনেকেরই মনে আছে। বেগম খালেদা জিয়া তখন এবং এখনো সেনা সমর্থিত সরকারের বিরুদ্ধে নিরাপস অবস্থান বজায় রেখেছেন। বিএনপি যদি ২০০৮-এর নির্বাচনে জয়ী হতে পারত তাহলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কুশীলবদের হয়তো বিচারের আওতায় আনা হতো।
সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার সবই কি খারাপ করেছিল? তখন কি কোনো ভালো কাজ হয়নি? এখানে তাদের কোনো প্রশংসা বা গুণকীর্তনের ব্যাপার নেই। তারপরও একটি অতি সামান্য ঘটনার উল্লেখ করি। ২০০৩ সালে আমার ছেলের এক সিনিয়র বন্ধু সাধারণ পরিবারের ছেলে সাইদ এইচএসসির ছাত্র ছিল। বহুদিন তার সাথে দেখা নেই। ২০১৩ সালে একদিন ছেলের সাথে সে বাসায় এল। পুলিশের সাব ইন্সপেক্টরের ড্রেস পরা। লালবাগ থানায় আছে। কবে এ চাকুরি পেয়েছে জানতে চাইলাম। বলল, ২০০৭-এর শেষ দিকে। বললাম, কয় লাখ দিতে হয়েছে? বলল, এক টাকাও না। তাই নাকি? সে বলল, হ্যাঁ। আল্লাহর রহমত যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসেছিল। লিখিত-ভাইভা পরীক্ষা দিয়েছি। কোনো তদ্বির করিনি, সে রকম কেউ আমার ছিলও না। কাউকে কোনো টাকাও দিতে হয়নি। এভাবেই আমার এসআই’র চাকরি হয়েছে। অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
সামরিক শাসন ভালো নয়, কাম্যও নয়। আবার সামরিক শাসন মানে যে ধ্বংস তাও নয়। তাহলে ১৯৬০-এর পর দফায় দফায় সেনা শাসন কবলিত তুরস্ক ধ্বংস হয়ে যেত। কিন্তু দীর্ঘ সেনা শাসনেও সে দেশে অর্থনৈতিক উন্নতি হয়েছে। বাংলাদেশেও ’৭৫ থেকে-৮১ জিয়া ও ’৮২ থেকে ’৯০ পর্যন্ত এরশাদের শাসনামলে দেশ দুঃশাসনের শেষ সীমায় পৌঁছেছিল, অর্থনৈতিক সংকটে অগ্রগতি কিছুই অর্জিত হয়নিÑ এ রকম কথা ইতিহাস লেখেনি। সামরিক শাসনামলে দুর্নীতি হয়নি তা নয়। সর্বোচ্চ পর্যায়ের কথা আলাদা। অফিস-আদালতে নানা ক্ষেত্রে তখন দুর্নীতি হতো টেবিলের নিচে। আর এখন দুর্নীতির সোনার পাখি ডানা মেলে উড়ে বেড়ায় সর্বত্র। যাহোক, সেনা শাসনে যা লোপ পায় তা হচ্ছে গণতন্ত্র। সভ্য সমাজে রাজনীতিতে শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্রই একমাত্র কাম্য, সামরিক শাসন বা সেনা সমর্থিত শাসন নয়।
লেখক : সাংবাদিক
h_mahmudbd@yahoo.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন