মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন : স্যামুয়েল জনসন বলেছেন, ‘দেশপ্রেম পাজি লোকের শেষ অবলম্বন।’ বক্তব্যটির মূল্যায়ন করা যাক, যদি স্যামুয়েল জনসনের বক্তব্যকে আক্ষরিক সত্য হিসেবে ধরে নেই, তবে জর্জ ওয়াশিংটন, চার্চিল, লিঙ্কন, গান্ধী, জিন্নাহ, সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিব, ভাসানী এবং জিয়া সকলেই দুষ্টলোক ছিলেন। অথচ, বাস্তবতাই প্রমাণ করে যে, এরা প্রকৃত দেশপ্রেমিক ছিলেন এবং সুযোগসন্ধানী ছিলেন না। যা-ই হোক, যদি অসৎ লোকেরা দেশপ্রেমের পোশাকে আবৃত হয় তবে তা হলো ভ-ামি, যাকে আদৌ দেশপ্রেম বলা যায় না।
দেশপ্রেম কি জাতীয় গর্ব, না উগ্র স্বাদেশিকতা? অবশ্যই জাতীয় গর্ব। আমার দেশ তোমার দেশের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর এমন অভিব্যক্তির মাধ্যমে মূলত দেশপ্রেম প্রকাশ করাটা জরুরি নয়। এটি অত্যন্ত সংকীর্ণ ও বিকৃত অভিব্যক্তি। যে দেশপ্রেম অন্য জাতিকে হেয় করে তা উৎকট স্বাদেশিকতা এবং বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে। জাপানিদের উন্নয়নের একটি প্রধান কারণ হলো তাদের দেশপ্রেম জাতীয় অহংকারে পরিণত হয়েছে। মানসম্মত পণ্য এবং দায়িত্বপূর্ণ আচরণ জাপানি দেশপ্রেমের নিদর্শন।
রাজনীতি মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের মাধ্যম, তাই রাজনীতির প্রতি মানুষের আগ্রহ সৃষ্টির শুরু থেকেই। রাজনীতির গতি-প্রকৃতি কোন দিকে যায় তার প্রতি মানুষের তীক্ষè দৃষ্টি থাকে। রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত হয় কার্যত রাজনৈতিক নেতৃত্বের দ্বারা, নেতৃত্ব কলুষিত হয়ে গেলে রাজনীতি মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের পরিবর্তে মানুষের ভাগ্যে নেমে আসে অবধারিত দুর্যোগ। বাংলাদেশে রাজনীতি আর রাজনীতিবিদদের হাতে নেই, এখানে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেন ব্যবসায়ী ও টাকাওয়ালারা; প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিবিদরা এই টাকাওয়ালাদের কাছে এক প্রকার জিম্মি। সারা জীবন যিনি রাজনীতির জন্য জীবনের মূল্যবান সময় ব্যয় করলেন, জীবন উৎসর্গ করে পরিবারের সদস্যদের সময় না দিয়ে রাজনীতির মাঠ তৈরি করলেন; তৈরি করলেন অগণিত নেতা-কর্মী ও শুভাকাক্সক্ষীÑ কিন্তু দেখা গেল একজন টাকাওয়ালা ব্যক্তি এসে হঠাৎ তার স্থান দখল করে নেয়। এমনকি কোনো দোষ ছাড়া, কোনো কারণ দর্শানো নোটিশ ছাড়া শুধু টাকার জোরে কেন্দ্র থেকে একজন রাজনীতিবিদকে বহিষ্কার পর্যন্ত করতে সমর্থ্য হন ওই ব্যবসায়ী এবং টাকাওয়ালারা। কী আশ্চার্যের ব্যাপার! রাজনীতির নামে এখানে এই নীতিই চর্চা ও লালন করেন দেশের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব পর্যন্ত! তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই!
এটিই বতর্মানে বাংলাদেশের প্রকৃত রাজনীতির চেহারা, এখানে প্রতিষ্ঠিত ও তারকা রাজনীতিবিদরা আজ পরিহাসের পাত্রে পরিণত হয়েছেন; রাষ্ট্রীয় কোনো নীতিনিধার্রণী কাজে তাদের মূল্যবান মেধা ব্যয়িত হচ্ছে না, ফুটপাতে দাঁড়িয়ে বা কোনো আলোচনা অনুষ্ঠানে তারা উপদেশ ফিকির করে বেড়াচ্ছেন। এই যদি হয় রাজনীতির চেহারা, তাহলে এ রাজনীতি মানুষের কল্যাণ করবে কী করে? এ রাজনীতি তো মানুষের কোনো উপকারে আসছে না! হাজার কোটি, লাখ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেও মানুষের কোনো সমস্যার সমাধান হচ্ছে না! মানুষের সামনে শুধু সমস্যার পাহাড় তৈরি হচ্ছে! যিনি রাজনীতিতে টাকা বিনিয়োগ করেন তিনি তো ব্যবসার উদ্দেশ্য নিয়েই তা করেন, জনসেবা তো তার মুখ্য উদ্দেশ্য নয়; তিনি তো নেতা নন, সাধারণ মানুষের কাছে তার তো কোনো দায়বদ্ধতা নেই।
টাকাই যদি রাজনীতির মূল চালিকাশক্তি হয়ে থাকে তাহলে রাজনীতির নামে সাধারণ মানুষের সঙ্গে এই ভ-ামির দরকার কি? দরকার কি সভা-সেমিনারে বসে নীতিকথা বলার? যে রাজনীতি মানুষের কোনো কল্যাণে আসে না, সে রাজনীতি তাসের ঘরের মতো ধসে পড়তে বাধ্য; আজ হোক কাল হোক এ রাজনীতি অবধারিত ধসে পড়বে।
দেশের অভ্যন্তরে বা বাইরে নাগরিকদের প্রতিটি কাজে, সিদ্ধান্তে এবং আচরণে জাতীয় গর্বের প্রতিফলন ঘটতে হবে। এ প্রতিফলন কেবল দেশের অভ্যন্তরে পারস্পরিক আচরণে ঘটলেই চলবে না, প্রতিটি নাগরিক একজন রাষ্ট্রদূত হিসেবে একজন অতিথি আপ্যায়নে কিংবা নিজ প্রবাসে অবস্থানকালীনও একই আচরণ বজায় রাখতে হবে। দেশীয় অহংকার জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিফলিত হতে হবে।
নিজের দেশকে ভালোবাসা মানে অন্যের দেশকে ঘৃণা করা নয়। নিজের শ্রেষ্ঠত্বকে প্রমাণের জন্য অন্য জাতিকে হেয় করাকে অবাস্তব দেশপ্রেম বলা হয়। এই গ্রহের অংশীদার হিসেবে আমরা পরস্পরের সাথে সম্পৃক্ত। আপনি যা করবেন, তা আমাকে প্রভাবিত করবে এবং আমার কাজ আপনার ওপর বর্তাবে; এ কারণেই পারস্পরিক সামাজিক দায়িত্ববোধ ও মানবিক মূল্যায়নের ওপর প্রতিটি দেশের কাঠামো প্রস্তুত হয়।
প্রত্যেক দেশে দুই ধরনের নাগরিক বাস করে, দেশপ্রেমিক ও প্রতারক; যারা ক্রমানুসারে সম্পদ ও দায়। দেশপ্রেমিক দু’প্রকার। যথা সময়সাপেক্ষ দেশপ্রেমিক, সত্যিকারের দেশপ্রেমিক। সময়সাপেক্ষ দেশপ্রেমিকরা ব্যক্তির ঊর্ধ্বে জাতির স্থানের কথা প্রচার করে। একজন সুযোগসন্ধানী দেশপ্রেমিক বলে, ‘জাতির জন্য যতটুকু প্রয়োজন আমি করব।’ এটি কোনো প্রতিশ্রুতি নয়, বরং মৌখিক বক্তব্য। সময়োচিত দেশপ্রেমিকরা হয় সুবিধা ভোগ কিংবা শাস্তি থেকে নিষ্কৃতির আশায় কাজ করে। তারা প্রতারক হিসেবে চিহ্নিত হতে চায় না, কিন্তু তাদের প্রতিশ্রুতি জোরালো নয় যে; তারা কিছু উৎসর্গ করতে পারে, অসুবিধা কিংবা বিপদের প্রথম দর্শনেই তাদের দেশপ্রেম উবে যায়।
ঝাঁসির রানী লক্ষী ভাই একজন সু-শাসক ছিলেন এবং একজন যোদ্ধা হিসেবে ব্রিটিশদের হুকুম তামিলে অস্বীকার করেছিলেন। স্থানীয় রাজাদের সাথে একটি সুসজ্জিত বাহিনীর নেতৃত্ব তিনি দেন এবং অপরাজেয় ব্রিটিশ সেনাবাহিনীকে পরাজিত করেন। ১৮৫৭ সালের মার্চে প্রায় ৪০০০ ব্রিটিশ সৈন্য ঝাঁসি অবরোধ করেন। রানী লক্ষী ভাই তার শিশুপুত্রকে পিঠে বেঁধে যুদ্ধে গিয়েছিলেন। যুদ্ধ চলাকালীন তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন এবং পরে মৃত্যুবরণ করেন। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ২২ বছর, তার শত্রু ব্রিটিশ বাহিনী পর্যন্ত তার দুর্দান্ত সাহস, রাজ্যরক্ষার প্রতিজ্ঞা ও দেশপ্রেমের কাছে মাতা নত করেন।
প্রত্যেক প্রজন্মেই একজন দেশপ্রেমিক থাকেন, যিনি ভিন্ন কিছু করেন। চেষ্টা না করার চেয়ে ঝুঁকি নিয়ে হেরে যাওয়া অনেক ভালো; ১৭৭৫ সালের মার্চে প্যাট্রিক হ্যানরি যুক্তরাষ্ট্রে একটি ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আমরা যদি স্বাধীন হতে চাই তবে আমাদের লড়তে হবে। দ্বিধা ও নিষ্ক্রিয়তার মাধ্যমে কখনো শক্তি অর্জন করা যায় না। জীবন কি এতই প্রিয় কিংবা শান্তি কি এতই মধুর যে শিকল ও দাসত্বের বিনিময়ে তা ক্রয় করতে হবে? পক্ষপাতিত্ব ও প্রত্যয়ের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। পক্ষপাতিত্ব হস্তান্তরযোগ্য। প্রত্যয় তা নয়। অবস্থার চাপে স্বজনপ্রীতি দুর্বল হতে থাকে আর প্রত্যয় হয় দৃঢ়। প্রশ্ন হলো, জনগণ স্থিতিশীল নয় কেন? তারা তা নয়, কারণ তা অসুবিধাজনক। নাগরিক যখন প্রত্যয়ের চেয়ে সুবিধাকে বেছে নেয়, তখন দেশে অবনতি ঘটে। যেসব নাগরিক নীতির ঊর্ধ্বে সুবিধাকে স্থান দেয়, তারা উভয়কেই হারায়। সুনাগরিকের জন্য দেশপ্রেম জীবনের একটি পন্থা।
উৎসর্গ মানে সবসময় হারানো নয়, বরঞ্চ বেছে নেয়ার চেয়ে বেশি কিছু। এর অর্থ হলো বৃহত্তর অর্জনের জন্য ক্ষুদ্রতর বিসর্জন। মহৎ নেতৃত্ব বিরক্তি নয়, বরং স্বেচ্ছায় উৎসর্গ করেন। দেশের বৃহত্তর স্বার্থের জন্য ক্ষুদ্র স্বার্থ ত্যাগ করতে পারলে দেশ উন্নতির পথে অগ্রসর হয়। যারা দেশের জন্য মৃত্যুবরণ করেন, তারা জীবিতদের মধ্যে জীবনের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দেন। দেশকে ভালোবাসার মানে সামাজিক ত্রুটির প্রতি অন্ধত্ব কিংবা সামাজিক বিশৃঙ্খলার প্রতি বধিরতা। পরিবার ও জাতির জন্য ত্যাগের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। কোনো ব্যক্তি যখন পরিবারের জন্য ত্যাগ করে তখন সে পরিবার লাভবান হয়। কোনো ব্যক্তি যখন জাতির জন্য কিছু করে তখন সে জাতি চিরতরে কিছু অর্জন করে, যদিও সে ব্যক্তির পরিবার চিরদিনের জন্য হারায়। আত্মস্বার্থ ও উৎসর্গের মধ্যে সংঘাতের সৃষ্টি হলে দ্বিতীয়টিকে প্রাধান্য দিতে হবে। ইতিহাসের বিখ্যাত নেতারা ব্যক্তিগত কর্মসূচিকে জাতীয় কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত করে নিতেন। জীবনের কোনো নিশ্চয়তা নেই। সফলতার কোনো সহজ, নির্বিঘœ দ্রুত উপায় নেই।
আমরা কি সত্যিই সভ্য সমাজে বাস করি? কোথায় ন্যায়বিচার? একে কি গণতন্ত্র বলে? একি আমাদের সংস্কৃতি? এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই যে, প্রতি বছর অগণিত ছাত্র অন্য দেশে পাড়ি জমায়, কারণ যে ব্যবস্থা সৎলোকের সাজা ও অসৎদের পুরস্কৃত করে, সেখানে তারা থাকতে চায় না; একেই কি জাতীয় লজ্জা বলে না? আমাদের যুবকরা হয় সুন্দর জীবনের জন্য বাংলাদেশ ত্যাগ করে প্রবাসে পাড়ি জমাচ্ছে, নয় তো অবিশ্বাসী কিংবা দূষিত হয়ে পড়ছে। মাত্র ২০ বছর আগেও বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়ার সময় কাউকে যদি প্রশ্ন করা হতো- ‘কবে ফিরবেন?’ উত্তর আসত ‘কয়েক বছরের মধ্যে।’ তারা বলত, ‘কিছু টাকা জমিয়ে কিংবা পড়াশোনা শেষ করেই ফিরে আসব।’ কিন্তু বর্তমানে কোনো বাংলাদেশি তরুণকে দেশ ছাড়ার সময় প্রশ্ন করলে তার জবাব আসে ভিন্ন রকম। সে জানায়, ‘আমি আর ফিরে আসছি না, আমি ওখানেই থেকে যাব।’ এর মানে কি তারা তাদের দেশকে আর ভালবাসে না?
আমরা নৈতিক রক্তাল্পতা ও আত্মিক ক্যান্সারে ভুগছি। সৎ ও ন্যায়বান লোকেরা দুর্নীতি ও আর্থিক অপুষ্টির মধ্যখানে পরিহাসের পাত্রে পরিণত হয়েছেন। এখানে নানা ধরনের অপরাধীরা রয়েছেÑ খুনি, ধর্ষক, দুর্নীতি ও চাঁদাবাজ। যারা জাতির সাথে প্রতারণা করে তারা নিকৃষ্টতম অপরাধী। পতিতাবৃত্তির বিরুদ্ধে রয়েছে আমাদের সামাজিক নিন্দা। কিন্তু একজন পতিতা তার বেঁচে থাকার তাগিদে শরীর বিক্রি করে। কিন্তু একজন বিশ্বাসঘাতক ও প্রতারক লোকের কবলে পড়লে পুরো জাতিই বিক্রি হয়ে যায়।
জেলিফিশ মাঝে মাঝে শামুক গিলে নেয় এবং যতক্ষণ পর্যন্ত শামুকটি শক্ত খোলসে থাকে ততক্ষণ সে বেঁচে থাকে। কিন্তু টিকে থাকার জন্য তার খাবারের প্রয়োজন। তাই সে জেলিফিশের ভেতরটুকু খেতে শুরু করে এবং ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। সত্যের প্রকৃতি এমনই। এসব কিন্তু রূপকথা নয়। সব সময় ঘরের শত্রু সমাজকে ধ্বংস করে দেয়। বিশ্বাসঘাতকেরা দুু’প্রকারের হয়- সক্রিয় বিশ্বাসঘাতক ও নিষ্ক্রিয় বিশ্বাসঘাতক। সক্রিয় বিশ্বাসঘাতকের স্বীয় লাভের জন্য মাতৃভূমিকে বাজারে বিক্রি করে দেয়। আর নিষ্ক্রিয় বিশ্বাসঘাতকেরা মাতৃভূমিকে বিক্রি করা দেখে নীরব থাকে। দ্বিতীয় শ্রেণীর প্রতারকেরা প্রথম শ্রেণীর চেয়ে নিকৃষ্ট। কারণ প্রথম শ্রেণীটি জালিয়াত কিন্তু দ্বিতীয় শ্রেণীটি শুধু জালিয়াতই নয় কাপুরুষও। সঠতার বিভিন্ন রকম অবয়ব থাকে। ব্রিটিশরা ২০০ বছরে যা করতে পারেনি, এদেশের পাজি, বিশ্বাসঘাতক ও প্রতারক লোকেরা ৪৫ বছরেই তা করে ফেলেছে। বিশ্বাসঘাতকেরা লজ্জাজনক অধ্যায় রেখে যায়। একজন ফরাসি লেখিকা বলেছিলেন, ‘গবেষণালব্ধ প্রতারণার চেয়ে দুর্বলতার মাধ্যমে প্রতারণা করার অপরাধে বেশির ভাগ মানুষ অপরাধী।’
প্রায় তিন হাজার বছর আগে গ্রিক সভ্যতার উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্ক ও দার্শনিকরা (আদর্শরাষ্ট্রে) বিধান দিয়েছিলেন, দার্শনিক রাজার না থাকবে কোনো পরিবার, না থাকবে কোনো ব্যক্তিগত সম্পদ। পরিবার না থাকলে আত্মীয়স্বজন বা সন্তান-সন্ততির প্রতি তার কোনো সময় দুর্বলতা জন্মাবে না। কোনো ব্যক্তিগত সম্পদে অধিকার না থাকলে রাষ্ট্রীয় সম্পদের সঠিক ব্যবহারে তিনি নিজে নিজেই উদ্বুদ্ধ হবেন।
রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রকৃতি হতে হবে উদার-নৈতিক, সংকীর্ণমনা নয়। রাজনৈতিক নেতাদের ব্যক্তিত্ব হতে হবে সৃজনমুখী; হতে হবে সংবেদনশীল, কঠোরমনা নয়। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে জনগণের আমানত হিসেবে গণ্য করতে হবে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নিজেদের প্রভাব, বৈভব বা প্রতিপত্তি অর্জনের মাধ্যম হতে পারে না। কোথাও কোনো পর্যায়ে কোনো বিচ্যুতি ঘটলে ঠিক তখনই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা পরিত্যাগ করার মানসিকতা তাদের অর্জন করতে হবে।
লালসা ও বিলাসিতার জন্য জাতির সর্বনাশ করার মতো প্রতারক ও বিশ্বাসঘাতক প্রত্যেক সমাজে রয়েছে। ঐ ধরনের লোকেরা হীনমন্যতাবোধ ও অহংবোধের প্রভাবে যে কোনো মূল্যে ক্ষমতা, সম্পদ ও মর্যাদা পেতে চায়। বেনেডিক্ট আরনল্ড ছিলেন এমনই এক বিশ্বাসঘাতক। আমেরিকার স্বাধীনতার যুদ্ধের সময় তিনি গোপনে ব্রিটেনে সৈন্য পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু তার দেশের লোকজন এ ষড়যন্ত্র টের পেয়ে গেলে তিনি ইংল্যান্ড পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। যখন তিনি ইংল্যান্ড থাকতেন, কেউ তার সাথে কথা বলত না, এমনকি নিজেদের চারপাশে তাকে দেখতেও চাইত না। তিনি জনগণের সামনে চরমভাবে অপমানিত হতেন। এমনও হয়েছে যে, কিছু লোক তার মুখের ওপর থুথু ছিটিয়ে দিত। তিনি যেখানে যেতেন, বিশ্বাসঘাতকতার কলঙ্ক তাকে অনুসরণ করত, তাকে সবাই ‘বিশ্বাসঘাতক বেনেডিক্ট আরনল্ড’ নামে ডাকত।
বর্তমানে আমাদের রাজনীতিবিদগণও কি এমন আচরণ করেন না? একেই কি ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি বলে না? সবসময়ই আমরা অতীতের ভুলের পুনরাবৃত্তি ঘটাই। মাশুল দিই উত্তরোত্তর। ইতিহাস আমাদের যে শিক্ষা দেয়, তা হলো আমরা আদৌ কিছু শিখিনি। ব্রিটিশ যখন সমগ্র বাংলাকে তাদের দখলে নিতে চাইল, নবাবের উচ্চাকাক্সক্ষী মন্ত্রী মীরজাফর তাদেরকে সাহায্য করল। পরবর্তীতে নবাব হওয়ার আশায় মীরজাফর তার শাসনকর্তা নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে পরামর্শ দিলেন পলাশীর প্রান্তর থেকে সৈন্যদল ফিরিয়ে নিতে, যদিও ব্রিটিশ বাহিনীকে হটানোর জন্য তারা প্রাণপণ যুদ্ধ করছিল। নবাব তার বিশ্বস্ত মন্ত্রীর উপদেশ গ্রহণ করে তার রাজত্ব এমনকি জীবন পর্যন্ত হারালেন। মীরজাফর এভাবে মাতৃভূমির সাথে বেইমানি করে তা তুলে দিল বিদেশি দখলদারের হাতে। লোভই বিশ্বাসঘাতকদের একমাত্র ধর্ম। সে তার ব্যক্তিগত লাভের জন্য শয়তানের সাথেও একপাত্রে চুমুক দিতে পারে।
আমরা প্রায়ই শুনি, ক্ষমতা দূষিত করে এবং ক্ষমতা সম্পূর্ণ দূষণ সম্পন্ন করে। এ কথা সত্য নয়, ক্ষমতা তাদেরকেই দূষিত করতে পারে; যারা দূষণযোগ্য। ক্ষমতা কেবল অন্তরালকে সম্মুখে এনে দেয়। ক্ষমতা নিরপেক্ষ। সৎ লোকের হাতে ক্ষমতা আশীর্বাদস্বরূপ, আর অধার্মিকের হাতে তা অভিশাপ; অনেকটা বৃষ্টি হলে আগাছা আর ফুল উভয়েই যেমন বাড়তে থাকে, ক্ষমতালোভী লোকেরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। ক্ষমতার অপব্যবহার তখনই যখন কারো প্রত্যাশা নোংরা হয়ে যায়। পাজি, বিশ্বাসঘাতক ও প্রতারক লোকেরাই ক্ষমতার অপব্যবহার করে কাজের মধ্যে দুর্নীতি ডেকে আনে।
যেসব নেতা উত্তরাধিকার সূত্রে লব্ধ বস্তু রেখে যেতে পারেন তারা মহান আদর্শ এবং প্রতিশ্রুতির গভীর বোধ নিয়ে যাত্রা শুরু করেন। আন্তরিক নেতা শুধু বর্তমান বিষয় নিয়ে ভাবে না, আগামীকাল তথা পরবর্তী সময়ের কথাও ভাবেন। এ ধরনের নেতৃত্ব ইতিহাসের গতি পরিবর্তন করে থাকে। আত্মবিশ্বাস, সাহসিকতা এবং অনমনীয়তার শক্তি বলে যেসব ব্যক্তি নেতৃত্বের পর্যায়ে উন্নীত হন, ইতিহাস তাদের বিশেষ স্থান দিয়েছে।
লেখক : কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
belayet_1@yahoo.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন