শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আদিগন্ত

গণতন্ত্র মাইনাস করে উন্নয়ন হতে পারে না

| প্রকাশের সময় : ২১ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:৫৫ এএম

আহমেদ জামিল : জানুয়ারি ২০১৭-তে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তাদের শাসনের ৩ বছর পূর্তি উদযাপন করল। এ উপলক্ষে ক্ষমতাসীনরা ব্যাপক শোডাউন ও প্রচার চালায়। এদিকে গত ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের তরফ হতে আয়োজিত বিশাল জনসভায় ভাষণদানের এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালনের কথা বলেছেন। এতে ক্ষমতাসীন দলের আরো দু’মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার ইচ্ছা ও আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে। যে কারণে নির্ধারিত সময়ের জাতীয় সংসদের নির্বাচনের বেশ আগে থেকেই আওয়ামী লীগ নির্বাচনী তৎপরতা শুরু করেছে। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে প্রভাবশালী মন্ত্রীরা রাষ্ট্রপতির সাথে সংলাপ চালানোর সময় নির্বাচন কমিশন গঠনে আইন ও ই-ভোটিংসহ চারটি প্রস্তাব পেশ করেছেন। উল্লেখ্য, এর আগে ই-ভোটিং জাতীয় সংসদ এবং স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে তল্পিবাহক বিদায়ী নির্বাচন কমিশন চালুর উদ্যোগ নিলে বিরোধী দল বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধী দলের প্রবল আপত্তির কারণে তা বেশি দূর এগুতে পারেনি।
৫ জানুয়ারি নির্বাচনের বার্ষিকীতে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ তাদের বক্তব্যে আগামী নির্বাচন সব দলের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা বলেছেন। অর্থাৎ মূলধারার রাজনীতির প্রধান প্রতিপক্ষ দল বিএনপিকেও এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করাতে চাইছেন ক্ষমতাসীনরা। সরকারের তিন বছর পূর্তিতে গত ১৩ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ধরনের ইঙ্গিত দিয়ে বলেছেন, ইসি গঠনে প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্তে সবাই আস্থা রাখবে এবং নির্বাচনে অংশ নেবে। তবে বিদায়ী বিতর্কিত ইসির মতো নতুন আরেকটি ইসি গঠন করা হলে বিএনপিসহ সমমনা ও অন্যান্য বিরোধী দল নির্বাচনে অংশ নিতে কতটা আগ্রহী হবে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। আওয়ামী লীগ উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের কথা বলছে। কোনো কোনো আওয়ামী নেতার মুখ থেকে ‘গণতন্ত্র নয়, উন্নয়ন আগে’ কথাটিও উচ্চারিত হয়েছে বহুবার। বাস্তবে গণতন্ত্র উন্নয়ন বিরোধী নয়, বরং উন্নয়নের সহায়ক। দেখা যায় বিশ্বের সকল উন্নত দেশে প্রকৃত গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চালু রয়েছে।
যাহোক, আওয়ামী নেতাদের এ ধরনের কথাবার্তা আর যাই হোক প্রকৃত গণতন্ত্রের বিকাশ ও অগ্রযাত্রার জন্য সহায়ক হতে পারে না। সেই সাথে যেনতেন প্রকারে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় থাকার পরিকল্পনাও সত্যিকারের গণতন্ত্রের পরিপন্থী। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি প্রধান বিরোধী দল বিএনপিও তার জোট শরীকসহ অন্যান্য দলের অংশগ্রহণ ছাড়া এক তরফা নির্বাচনের মাধ্যমে বিপুলসংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়ে সরকার গঠন করেছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার। চতুর্থ বছরে পা রাখা এই সরকার অর্থনৈতিক, সামাজিক, যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে উন্নয়ন সাধন করেছে সন্দেহ নেই। তবে এই উন্নয়ন নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। সরকার ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৭ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ঠিক করেছে। বিশ্বব্যাংকের মতে এই প্রবৃদ্ধির হার বড় জোর ৬ দশমিক ৮ শতাংশ হতে পারে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশে এখন দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আশঙ্কাজনকহারে কমে গেছে। কমে গেছে ফরেন রেমিটেন্সও।
এসব কিছু অর্থনীতির জন্য অশনিসংকেত। তাছাড়া বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি সচল নয়, অচল অর্থনীতির পরিচয় বহন করে। অর্থনীতি সচল থাকলে আবাসনসহ অন্যান্য ব্যবসা-বাণিজ্য মুখ থুবরে পরতো না। অথচ এই উন্নয়নের নাম দিয়ে ক্ষমতার মেয়াদ দীর্ঘতর করার জন্য গণতন্ত্রকে কার্যত অদৃশ্য করে দেয়া হয়েছে। বিরোধী দলের ওপর জেল, জুলুম, নির্যাতন, গুম ও হত্যা অব্যাহত রয়েছে। সভা-সমাবেশ করার অধিকার সত্যিকারের একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মৌলিক রাজনৈতিক অধিকারের অংশ। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও গৃহপালিত বিরোধীদল জাতীয় পার্টি ঢাকা মহানগরীতে একাধিক জনসভা করলেও মূলধারার রাজনীতির প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি বিএনপি ও তার শরিক দলগুলোকে ২০১৬ সালের ৭ নভেম্বর এবং এ বছরের ৫ জানুয়ারি ঢাকা মহানগরীর কোথাও জনসভা করার অনুমতি দেয়া হয়নি।
ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় ৭ নভেম্বর ও ৫ জানুয়ারির বিএনপির ঘোষিত সভা-সমাবেশ ও মিছিল কর্মসূচি পুলিশের পাশাপাশি ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডাররা হামলা চালিয়ে ভ-ুল করে দেয়। প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, ৩ বছরে বিএনপির ৭টি সমাবেশের অনুমতি চেয়েও পায়নি। এ প্রসঙ্গে গত ১৪ জানুয়ারি দৈনিক নয়া দিগন্তে ‘বাধার মুখে বিএনপি’ শিরনামে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, “খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ‘বিগত ৩ বছরে কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়াই বিএনপি সভা-সমাবেশের অনুমতি পায়নি। সাতবার সমাবেশের অনুমতি চাইলেও তা দেয়নি পুলিশ সর্বশেষে এ বছরের ৫ জানুয়ারি ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ উপলক্ষে ৭ জানুয়ারির সমাবেশ করতে পারেনি বিএনপি। ঢাকার দুটি স্থানে সমাবেশের অনুমতি দেয়া হয়নি বিএনপিকে।’ এর পেছনে নিরাপত্তাজনিত কারণ, সংঘর্ষ বা সহিংস কর্মকা-কে কারণ হিসেবে দাঁড় করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতারা।”
অন্যদিকে বিএনপিকে শুধু সভা-সমাবেশ থেকে বঞ্চিত করাই নয়, বিএনপিসহ সকল বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ওপর নির্যাতন, জেল, গুম, হত্যাও অব্যাহত রয়েছে। প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, গত বছর ৭০ জনের বেশি নিখোঁজ হয়েছেন। এর মধ্যে ৩৪ জন গুম হয়েছেন বলে সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলো অভিযোগ করেছে। বিশ্বের নামি মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বাংলাদেশ প্রসঙ্গে এক বার্ষিক প্রতিবেদনে বলেছে, বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে নির্বিচারে গ্রেফতার, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ রয়েছে। তবে এই অবমাননাকর চর্চার কোনো বিচার নেই। ...ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালে বেসামরিক লোকজন, সংবাদ মাধ্যম ও বিরোধী দলের ওপর সরকারের দমন-পীড়ন বেড়েছে। বিরোধী দলের বহু সদস্য আত্মগোপনে যেতে বাধ্য হয়েছেন। অনেকের বিরুদ্ধে ফৌজদারী মামলা চলছে, বাকিরা হয় আটক বা নিখোঁজ। এ রিপোর্টে সংবাদপত্রের সম্পাদকদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা ও বেসরকারি সাহায্য সংস্থাগুলোর (এনজিও) কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির অভিযোগ আনা হয়েছে।
রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের ওপর দমন-নির্যাতন, হত্যা-গুম, সভা-সমাবেশ এবং মিছিলের ওপর হামলা এবং অনুমতি না দেয়া পেছনে বর্তমান সরকারের এক ধরনের গণভীতি কাজ করছে। যে কারণে বৈধতার সংকট নিয়ে ক্ষমতাসীনরা শুরু থেকে একটা ভয়ভীতির মধ্যে আছে। তাই প্রহসনের নির্বাচন এবং বল প্রয়োগের মাধ্যমে বিরোধী শক্তি নিশ্চিহ্ন করে ক্ষমতার মেয়াদ দীর্ঘায়িত করতে চাচ্ছে। বর্তমান সরকার ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি প্রায় ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছে। দল নিরপেক্ষ নির্বাচন পর্যবেক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে এই নির্বাচনে ভোট পড়েছে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ। অনুগত নির্বাচন কমিশন তা বাড়িয়ে ৪০ শতাংশ বলেছে। বাস্তবে এই সরকারের ক্ষমতার পেছনে ভোটারদের কোনো ম্যান্ডেট নেই। যে কারণে রয়েছে বৈধতার সংকট। সে যাই হোক, ক্ষমতাসীনদের তরফ হতে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা বলা এবং দ্রুত নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দেয়া হলেও এখন তারা ভিন্ন সুরে কথা বলছেন।
সরকার প্রতিশ্রুতি থেকে সরে গিয়ে বলছে ২০১৯ সালের আগে কোনো নির্বাচন নয়। এদিকে স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে বিরোধী দলের নিশ্চিত বিজয় ছিনতাই করে সরকার দেখাতে চাইছে দেশজুড়ে তাদের বিশাল জনপ্রিয়তা রয়েছে। আগেই বলা হয়েছে, ২০১৯ সালের নির্বাচনে একতরফা এবং নিরঙ্কুশ বিজয় হাসিলের জন্য দমন-নির্যাতনের মাধ্যমে বিএনপিসহ বিরোধী দলের কোমড় ভেঙে দেয়া হচ্ছে এবং তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করার হীন প্রয়াস চালানো হচ্ছে। অর্থাৎ ২০১৯ সালের নির্বাচনের আগেই বিরোধী দলের জন্য কোনো ‘লেভেল প্লেইং ফিল্ড’ রাখা হচ্ছে না। সুতরাং নতুন নির্বাচন কমিশন সরকারের অনুগত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। অন্যদিকে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি থেকে অঘোষিতভাবে সরে এসে যে নির্বাচন সহায়ক সরকার ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের দাবি করছে সেটিও উপেক্ষিত হতে হবে।
চলমান রাজনৈতিক অবস্থা থেকে এটিই প্রতীয়মান হয় যে শাসকগোষ্ঠী বিরোধী বিএনপিসহ সকল বিরোধী দলকে গণতান্ত্রিক ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে রাজপথের আন্দোলন করতে প্রলুব্ধ করছে। এটি ঘটলে বিরোধী দলের ওপর নতুন করে ব্যাপক দমন-পীড়ন চালানো সহজ হবে। বিরোধী দলকে ধ্বংসাত্মক ও উন্নয়ন বিরোধী শক্তি হিসেবে চিত্রিত করা যাবে। সেই সাথে সহজ হবে বিরোধী দলের গায়ে জঙ্গিবাদীর তক্মা আটা। এভাবে বিরোধী দল সম্পর্কে দেশে-বিদেশে বিভ্রান্তি ছড়ানো ও নেতিবাচক ধারণা তৈরি সম্ভব হবে। এসব হীন কৌশল অবলম্বন করে ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করতে চাইছে সরকার। কিন্তু ইতিহাসের শিক্ষা বলে এভাবে ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করা যায় না। সরকারের ভূমিকা সম্পর্কে প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক মহলও সচেতন। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের বাংলাদেশ প্রসঙ্গে সর্বশেষ প্রতিবেদন এর এক জ্বলন্ত উদাহরণ।
লেখক : কলামিস্ট

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন