আল ফাতাহ মামুন : বলা হয়ে থাকে, প্রতিটি মানুষের ভেতর একটি নদী বাস করে। আমরা যখন দুঃখ পাই তখন এ নদী জেগে ওঠে। হৃদয়ে কান্নার ঢেউ তোলো। চোখে অশ্রু ঝড়ায়। সে হিসেবে নদীর সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক সৃষ্টির শুরু থেকেই। হৃদয় নদীর মতই পৃথিবীর নদীর সঙ্গেও মানুষের সম্পর্ক খুব গভীর এবং প্রাচীন। মানব সভ্যতার গোড়াপত্তন হয়েছে নদী কেন্দ্রীক বসতির মাধ্যমেই। জীবিকা ও দৈনিন্দন প্রয়োজনের সুবিধার কথা বিবেচেনা করে মানুষ নিজেকে সপে দিয়েছে নদীর কোলে। নদীও তাকে দিয়েছে আঁচল ভরে। যাতায়াত থেকে শুরু করে খাবার ও রুটি রুজির ব্যবস্থা, কী দেয়নি নদী মানুষকে? নদীর কাছে মানুষ তেমনই ঋণী যেমন ঋণী মায়ের কাছে। তাই তো কবি-সাহিত্যিক ও গায়করা নদীকে ডেকেছেন মা বলে।
যে নদী মানুষকে এত কিছু দিয়েছে-দিচ্ছে সে নদীকেই মানুষ মেরে ফেলছে। অনেক বছর ধরেই আমাদের দেশে নদী দখলের হিড়িক চলছে। চলছে নদী মেরে ফেলার মহোৎসব। কখনো ছোটখাটো নদীর মাঝখানে জাল পেতে জল¯্রােত বন্ধ করে মৎস্য নিধন, আবার কখনো পাড় ঘেঁষে নদী দখল নিত্যনৈমত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রায়ই দৈনিক পত্রিকার পাতায় চোখ বোলাতেই দেখা যায় কোনো না কোনো নদীর ওপর হামলার খবর। একটি জাতীয় দৈনিক তেঁতুলিয়া নদী দখলের চিত্র তুলে ধরেছে এভাবে- ‘বেঁধে ফেলা হয়েছে তেঁতুলিয়া। পাড় ভাঙার অজুহাতে মেরে ফেলা হচ্ছে নদী। এপার-ওপারজুড়ে দেওয়া হয়েছে বেড়া। তা-ও আবার একটি-দুটি নয়, পরপর তিনটি।’ কিংবদন্তির নদী তেঁতুলিয়ার ভাগ্যে তৈরি হয়েছে মরণদশা। ওই প্রতিবেদনের মতে, ‘ওই বন্ধনের উদ্দেশ্য নদী দখল। অবরোধের ফলে তৈরি হবে চর, চলবে চর দখলের পালা। এই দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় অবশেষে অংশত হলেও মৃত্যু ঘটবে তেঁতুলিয়ার।’ বাংলাদেশের প্রধান নদী যমুনার করুণ চিত্র তুলে ধরে গত ১৩ জানুয়ারি দৈনিক ইনকিলাব এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, ‘চৈত্র আসার এখনো দুই মাস বাকী। পানির অভাবে দেশের অন্যতম প্রধান নদী যমুনা এখনই মরুপথে। পানি প্রবাহের স্তর নীচে নেমে যাওয়ায় জেগে উঠেছে অসংখ্য বালুচর। হুমকির সম্মুখীন হয়েছে জীব-বৈচিত্র্য। নদীর দু’ধারে মাইলের পর মাইল ধূধূ চর আর চর। কোথাও কোথাও নদীর পেটের ভিতরেই জেগে উঠেছে বিশালাকৃতির চর। পৌষের শেষ দিকে যেখানে প্রমত্ত নদীর পানিতে উথাল-পাতাল অবস্থা থাকার কথা; সেখানে পানির স্তর নীচে নেমে যাওয়ায় মানুষজন হেঁটে নদী পার হচ্ছে। নদীকে কেন্দ্র করে যাদের জীবিকা নির্বাহ হয় তাদের কপালে পড়েছে চিন্তার ভাঁজ। অনেকেই বাপ-দাদার পেশা বদল করে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। যারা সেচ কাজে যমুনার পানি ব্যবহার করেন তারাও পড়ে গেছে মহাবিপাকে।’ প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ‘উজানের নদী থেকে ভারত অবৈধভাবে পানি তুলে নেয়ার কারণে কমে গেছে পানি প্রবাহ। ফলে ১৯৯৮ সাল থেকেই যমুনা নদীতে ব্যাপক চর জাগতে শুরু করে। সময়ের ধারাবাহিকতায় সেই চরের সংখ্যা প্রতিবছর বাড়ছে। স্থানীয়দের মতে, এক সময় যমুনা নদীর নীল পানির স্রোত আর প্রবল ঢেউ দেখে মানুষ ভয় পেত। ২০ বছর আগেও পৌষ মাসে গভীর পানি থাকতো নদীতে। চৈত্র-বৈশাখে তখন বালির চর দেখা যেত বটে; তবে তার মধ্য দিয়েই থাকতো নদীর পানির ¯্রােতধারা। এখন ভরা বর্ষায়ও সে পানি দেখা যায় না। কেউ কেউ বলছেন, যমুনায় প্রতিবছর যেভাবে চর উঠছে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে একদিন করালগ্রাসী যমুনা নদী হবে রূপকথার গল্পের মতো।’
এক শ্রেণীর অসাধু মানুষের লোভ ও জবরদস্তির শিকার হচ্ছে আমাদের দেশের নদীগুলো। এমন ঘটনা দুই-একটি নয়, বরং দেশের অধিকাংশ নদীই মানুষরূপী হায়েনার কালো থাবায় মরণোম্মুখ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ প্রক্রিয়া চলতে থাকলে বাংলাদেশের প্রাণপ্রবাহ রুদ্ধ হয়ে পড়বে। মৃত্যু ঘটবে মাঝারি ও বড় নদীগুলোর। ছোট নদ-নদী ও খাল-ঝিল এখন নেই বললেই চলে। চর দখল, কল-কারখানার বর্জ্য ইত্যাদি ছাড়াও নদী ধ্বংেসের অন্যতম প্রধান কারণ হলো পাশ্ববর্তী দেশে নির্মিত বাঁধের অপব্যবহার এবং পানি বণ্টনে ন্যায্য হিস্যা থেকে বাংলাদেশের মানুষকে বঞ্চিত করা। ভারত কর্তৃক বাংলাদেশের অভ্যন্তরেও প্রবাহমান নদীগুলোর উৎস মুখে বাঁধ নির্মাণের ফলে দেশের অসংখ্য নদী তার নাব্যতা হারিয়ে ফেলছে। বারো ভাগের এক ভাগে নেমে এসেছে নৌ-যোগাযোগ। বাংলাদেশের ভূ-আভ্যন্তরীণ পানির স্তর নিচে নেমে গেছে আশাঙ্কাজনকভাবে। ক্রমশঃ শুকিয়ে যাচ্ছে নদ নদীগুলো। প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে সেচ প্রকল্পসমূহও। শুস্ক মৌসুমে নদী-উপনদীগুলো তার সাধারণ প্রবাহ হারানোর ফলে এগুলো শুকিয়ে যায় এবং সেচ কার্য অসম্ভব হয়ে পড়ে। উজান হতে নদীর প্রবাহ কমে যাওয়ায় সামুদ্রিক লোনা জল আমাদের নদীগুলোতেও ঢুকে পড়েছে। ফলে ফসলি জমিগুলো আক্রান্ত হয়েছে লবণাক্ততায়। শুধু তাই নয়, বাঁধের কারণে বিশ্বখ্যাত সুন্দরবন আজ হুমকির মুখে। দেশের মৎস্য সম্পদ বিলীন হওয়ার পথে। পশু পাখি আর আগের মতো দেখা যায় না। হালে দেখা যাচ্ছে জীবনঘাতি মারাত্মক আর্সেনিক সমস্যা। ফলে ব্যবহার্য ও খাবার পানিতে আর্সেনিকের দূষণ ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় দুই কোটির বেশি মানুষ আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে মৃত্যুর দিকে। নদী ও পানি বিশেষজ্ঞ এবং পরিবেশবিদরা বলেন, ‘উজানের নদীগুলোর উপর নির্মিত বাঁধগুলো অনতিবিলম্বে উঠিয়ে না দিলে আগামী ২৫-৩০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ মানুষ্য বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে। বিলীন হয়ে যাবে জীববৈচিত্র্যও।’
একদিকে ঘরের শত্রু, অপর দিকে বাইরের রাক্ষস- এ দুইয়ে মিলে খেয়ে ফেলছে আমাদের নদীর পানি। সার্বিক বিবেচনায় ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যের দিকে এগুচ্ছে সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা সোনার বাংলাদেশ। অথচ এ বিষয়ে ভাবনা নেই সাধারণ জনগণসহ কারোই। কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয় না সরকার মহোদয়ের পক্ষ থেকেও। নদী মায়ের আর্ত চিৎকার শুনছে না কোনো সন্তান। মোটা দাগে বলতে চাই, নদী মাকে বাঁচাতে আমরা যদি এগিয়ে না আসি তবে একদিন নদীর সঙ্গে মরতে হবে আমাদেরও। ভুগবে ভবিষ্যত প্রজন্ম। তাই আসুন! নদী বাঁচানোর আন্দোলনে শরীক হই। শুধু দিবস নির্ভর নয়, কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে নদী মায়ের পাশে থাকি সবসময়। রুখে দেই ভিনদেশী রাক্ষসদের অবৈধ হস্তক্ষেপ, ভেঙ্গে দেই তাদের কালো হাত। উপরে ফেলি লোভে চকচক করা চোখগুলো, যা তাকিয়ে থাকে নদী মায়ের দিকে।
য় লেখক : শিক্ষার্থী, ডিপ্লোমা ইন এ্যারাবিক ল্যাঙ্গুয়েজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন