রাজু আহমেদ : দেশের সকল ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকা-ে বৈধ-অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে জঙ্গি তৎপরতা, সন্ত্রাসী হামলা, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, জমি দখলসহ বিভিন্ন শ্রেণির অনৈতিক প্রভাব বিস্তারে অস্ত্র প্রদর্শনের মহড়া বাড়ছে। প্রশাসনের সামনে ফিল্মি স্টাইলে বুলেটের আঘাতে কেড়ে নেয়া হচ্ছে জীবন। অন্যায়ভাবে প্রাণসংহারণে ব্যবহৃত আগ্নেয়াস্ত্রকে বৈধ বলার সাধ্য নাই; হোক সে লাইসেন্সধারী। এখানে দিনপঞ্জি থেকে এমন দিন অতিবাহিত হয় না যেখানে অবৈধভাবে বৈধ-অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহারে ভীতির রাজ্য সৃষ্টি হচ্ছে না। বর্তমান রাজনৈতিক অঙ্গনে ক্ষমতা প্রতিষ্ঠায় আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার নিত্যদিন বেড়েই চলছে। বিপক্ষ রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংঘর্ষ ছাড়াও দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে একপক্ষের ওপর অন্যপক্ষের প্রভাব বিস্তারে ব্যবহৃত হচ্ছে মরণাস্ত্র। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে নিকট অতীতেও সমমনা রাজনৈতিক মতাদর্শের নেতাকর্মীদের ওপর অস্ত্র তাক করার দৃষ্টান্ত বিরল অথচ বর্তমানে ভিন্নদলের সাথে সংঘর্ষে অস্ত্র দিয়ে যে পরিমাণ প্রাণ কেড়ে নেওয়া হচ্ছে, তারচেয়ে বেশি পরিমাণ জীবন কেড়ে নেয়ার দৃষ্টান্ত সৃষ্টি হয়েছে নিজ ব্যানারের সমর্থক থেকে। রাজনৈতিক অঙ্গনে জাতীয় এবং দলীয় স্বার্থের ওপরে ব্যক্তিস্বার্থ ভর করাতেই এহেন দুর্গতির অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। ক্ষমতাশীন দলের অঙ্গসংগঠন ছাত্রলীগের কতিপয় ও অন্যান্য সহযোগী সংগঠনের একশ্রেণির নেতা নামধারীরা অস্ত্রের জোড়ে যেমন নিজেদের বিপক্ষ কোরামকে দমনেরত তেমনি সাধারণ মানুুষকে জিম্মি করে ব্যাপক চাঁদাবাজি ও দখলবাণিজ্যের প্রভূত্ব কায়েম করেছে। ক্ষমতার পালাবদলে ক্ষমতাশীনদলের কতিপয় নেতাদের মদদপুষ্টরা অস্ত্র নিয়ে যে মরণ খেলায় মেতেছে তা খুব বেশি রোধ হচ্ছে বলে প্রতীয়মান নয়। পুলিশের সামনে ক্ষমতাশীন দলের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা নিজেদের বিরাগভাজন কিংবা বিপক্ষদলের বিরুদ্ধে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের মহড়া দিলেও সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের নীরব ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়। মধ্যখান থেকে হারিয়ে যায় কতগুলো তাজা প্রাণ। এদের কেউ শিশু, কেউ পথচারী, কেউ নারী কেউবা সম্পূর্ণ নির্দোষ আবার কেউ কেউ হয়তো দোষীও। তাই বলে কেউ দোষী হলেও তাকে বিচারহীনভাবে হত্যা করা আইনসঙ্গত নয়। কেননা সাংবিধানিকভাবে ঘৃণ্য অপরাধীরও ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। বৈধ-অবৈধ অস্ত্র দিয়ে মানুষ হত্যা এবং নৈরাজ্য সৃষ্টিতে কালিমা রেখে যায় ক্ষমতাশীনদের আইন অমান্যের দৃষ্টান্তের ওপর। যা ভবিষ্য ইতিহাসে বর্তমান ক্ষমতাশীলদেরকে ভিন্ন দৃষ্টিকোণেই মূল্যায়ন করবে।
বৈধ অস্ত্রের অবৈধ চালনায় সিরাজগঞ্জের শাহাজাদপুরে ২ ফেব্রুয়ারি খুন হলো দৈনিক সমকালের প্রতিনিধি আব্দুল হাকিম শিমুল (৪২)। প্রত্যক্ষদর্শী ও মিডিয়ায় প্রকাশিত সূত্রমতে শাহাজাদপুর পৌরসভার মেয়র হালিমুল হক মিরুর শর্টগানের গুলিতেই নিহত হয়েছে সাংবাদিক শিমুল। সেখানে পৌরসভার মেয়রের কোরাম এবং সদ্য আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃৃত কোরামের মধ্যে রাস্তার কাজ ভাগাভাগি নিয়ে সৃষ্ট সংঘর্ষে বৈধ-অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের অবৈধ ব্যবহারে পেশাগত দায়িত্বপালন করতে এসে ঝড়ে গেলো সাংবাদিক শিমুল। শিমুলের মৃত্যুর খবর সহ্য করতে না পেরে না ফেরার দেশে চলে গেলো তার বৃদ্ধ নানীও। ভিন্ন দলের মধ্যে কিংবা ক্ষমতা এবং স্বার্থ রক্ষার স্বার্থে একই দলের সদস্যদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ বিবাদ-সংঘর্ষে গুলি খেয়ে আহত হওয়া সাংবাদিকের সংখ্যা এদেশে একেবারে কম নয়। শিমুল নিহত হওয়ার পর মিডিয়ার ঐক্যবদ্ধ ভূমিকায় মিরুকে দল থেকে বহিষ্কার এবং তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আশা করা যায়, অপরাধ প্রমাণিত হলে মিরুর শাস্তিও হবে। কিন্তু শুধু এক মিরুর শাস্তিই কি যথেষ্ট? ক্ষমতাশীন দলের প্রভাব-প্রতিপত্তি দেখিয়ে বিগত কয়েক বছরে বহু নেতাকর্মী অস্ত্রের লাইসেন্স পেয়েছেন। তাদের সে বৈধ অস্ত্র দিয়ে অবৈধ কার্যকলাপের বেশ কিছু খবর বিগত দিনগুলো মিডিয়াসূত্রে জানতে পেরেছে। শুধু এক শাহাজাদপুরেই নয় বরং দেশের বহু হউনিয়ন, পৌরসভা, উপজেলা, জেলা এবং বিভাগীয় শহরে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ সংঘাতে বারবার দ্বি-পক্ষীয় কিংবা ত্রি-পক্ষীয় সংঘর্ষ ঘটছে। অবশ্য ক্ষমতাসীন দলের অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষে ত্রি-পক্ষ হিসেবে উপস্থিত থাকা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য সাধারণ মানুষের মতো দর্শকের ভূমিকা পালন ছাড়া খুব বেশি ভূমিকা নিয়েছে কিংবা নিতে পেরেছে বলে প্রতীয়মান হয়নি। আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে পিরোজপুর জেলার মঠবাড়ীয়া উপজেলাতে পৌর মেয়র সমর্থক এবং উপেজলা মেয়র সমর্থকদের মধ্যে যুদ্ধংদেহী মনোভাব বিরাজ করছে। দু’দলের সংঘর্ষে সেখানে পূর্বেই একজন নিহত এবং বেশ কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হয়েছে।
স্বাধীনতা পরবর্তীকালে দেশে বৈধ অস্ত্রের সংখ্যা কত এবং এসব কোথায়, কী কাজে ব্যবহার হয় তার সঠিক বিবরণ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দফতরে নেই। বিগত সাত বছরে ১০ হাজার অস্ত্রের লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত খসড়া মতে, দেশে বৈধ অস্ত্রের সংখ্যা ২ লাখ। যার মধ্যে ২০ হাজারের কোনো হদিস নেই। বৈধ অস্ত্রগুলো যে নানাভাবে অবৈধকাজে ব্যবহার হচ্ছে তার প্রমাণ মেলে পত্রিকায় প্রকাশিত কিছু প্রতিবেদনে। ২০০৮ সালের ২৩ মে রাজধানীর ওয়ারীতে আশিকুর রহমান অপু হত্যাকা-ে চারটি বৈধ অস্ত্রের ব্যবহার হয়েছিল বলে পুলিশি তদন্তে প্রকাশ পেয়েছে। সিরাজগঞ্জের আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক জান্নাত আরা হেনরীর বাসায় তার লাইসেন্সকৃত শর্টগানের গুলিতে আহত হয় তিন নেতা। ২০১২ সালের এপ্রিলে নড়াইলের স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা রবিন তার বৈধ অস্ত্র দিয়ে হামলা চালায় বিদ্যুৎ অফিসে। নারায়াণগঞ্জের আলোচিত সেভেন মার্ডারে প্রধান অভিযুক্ত ও ফাঁসির দ-াদেশপ্রাপ্ত নূর হোসেন এবং তার সহযোগীদের নামে ৯টি আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স আছে। আগ্নেয়াস্ত্রের মতো স্পর্শকাতর হাতিয়ারের লাইসেন্স যাকে তাকে দেয়ার কারণে এবং সঠিক নজরদারি না রাখায় দেশে হত্যা ও নৈরাজ্যের ঘটনা বেড়েছে। আত্মরক্ষার স্বার্থেই অস্ত্র বহনের অনুমতি দেয়া হয়। কিন্তু সে অস্ত্র যখন অন্যায়ভাবে মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয় এবং অনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার হয় তখন তা সার্বিকভাবেই রাষ্ট্রের ভাবমর্যাদা ক্ষুণœ করে। কাজেই অস্ত্রের লাইসেন্স প্রদানের ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে আরও কঠোর ও যতœশীল হওয়া দরকার।
নিঃসন্দেহে বলা চলে, দেশে বৈধ অস্ত্রের চেয়ে অবৈধ অস্ত্রের সংখ্যা বেশি। কেননা ক্ষমতাসীনসহ অন্যান্য দলের ছাত্রসংগঠন এবং উগ্রপন্থিরা যেভাবে অস্ত্রের মহড়া দেয় তাতে ভীত না হয়ে উপায় নেই। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কিংবা একই দলের ভিন্ন ভিন্ন নেতার ছত্রছায়ায় থাকা ছাত্ররা পরস্পরের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে অস্ত্র ব্যবহারের যে লাইভ চিত্র দেখিয়েছে তা আমাদের উদ্বিগ্ন করার জন্য যথেষ্ট। গত বছরের ৩১ জুলাই কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের দু’পক্ষের গোলাগুলি, ২৭ অক্টোবরে রাজধানীর গুলিস্তানে ব্যবসায়ী ও হকারদের ওপর ছাত্রলীদের দু’নেতার প্রকাশ্যে গুলিবর্ষণ কিংবা কুষ্টিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গহীন অরণ্যে আরেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের অস্ত্রচালনার যে চিত্র পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে তা ছাত্রলীগের ভাবমর্যাদা কিছুটা হলেও ম্লান করেছে। এছাড়া ছাত্রলীগ, যুবলীগ কিংবা অন্য সংগঠনের টেন্ডার বাণিজ্য নিয়ে বিবাদমান সংঘর্ষে গোলাগুলির ঘটনায় যে অস্ত্রের ব্যবহার হয়েছে তাও অবৈধ অস্ত্র। বিভিন্ন সময়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের জন্য অভিযান চালানো হয় কিন্তু বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে সে অভিযান সময় উপযোগী নয়। ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা কারণে যারা আগ্নেয়াস্ত্র মজুদ রাখার সাহস বেশি দেখায় তাদের থেকে অস্ত্র উদ্ধারের প্রশ্নে প্রশাসন বোধহয় কিছুটা হাতবাঁধা বলেই বিভিন্ন ঘটনার বিশ্লেষণে মনে হয়েছে। জাতীয় স্বার্থে জাতীয় নেতৃবৃন্দকে অবৈধ অস্ত্রমুক্ত বাংলাদেশ গঠনে আরও উদারতার পরিচয় দিতে হবে। চট্টগ্রামের পাহাড়ের গহীন পরিখায় কিংবা রাজধানীর বিভিন্ন অঞ্চলে অভিযান চালিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা যে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র উদ্ধার করতে সমর্থ হয়েছে তা অবশ্যই প্রশংসনীয়। তবে স্থানীয় পর্যায়ের অবৈধ অস্ত্রগুলোও যেকোনভাবে উদ্ধার করতে পারলে দেশে পূর্ণ শান্তি-শৃঙ্খলার পরিবেশ ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
বাংলাদেশে যেসকল অবৈধ অস্ত্রের কারণে হুমকি ও ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয়েছে তার বেশিরভাগ আসে ভারতের সীমান্ত পেরিয়ে। বিশেষ করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, যশোরের বেনাপোল ও সাতক্ষীরা সীমান্ত দিয়েই বেশি অস্ত্র বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এছাড়া কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সীমান্ত পথ দিয়েও কিছু আসে। সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কাছে কিছু অস্ত্র ধরা পড়লেও বিশাল সংখ্যক অবৈধ অস্ত্র ছড়িয়ে যায় দেশের সর্বত্র। এছাড়া কিছু কিছু লাইসেন্সধারী অস্ত্র ব্যবসায়ীরাও অনৈতিক ব্যবসার সাথে জড়িয়ে দেশের পরিস্থিতিকে ঘোমট করছে। অবৈধ অস্ত্র কিংবা বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার এবং শান্তি পাশাপাশি বাস করতে পারে না। কাজেই যেকোন একটাকে গ্রহণ করতে হবে। অস্ত্র মানব সভ্যতাকে ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড় করাবে এবং শান্তি মানুষকে নিরাপত্তাবেষ্ঠিত আবাস দেবে। জনগণ শান্তি চায়। জনগণের শান্তির গ্যারান্টি রাষ্ট্রের দায়িত্বশীলদের জাতীয় স্বার্থরক্ষামূলক সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে। অবৈধ অস্ত্রের উপস্থিতি কমানো এবং বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহারের লাগাম টানতে সংশ্লিষ্ট আইনের প্রয়োগকে আরও যুগোপযোগী করা আবশ্যক। আর কোন শিমুলের অস্বাভাবিক মৃত্যু আমরা চাই না।
লেখক : কলামিস্ট
raju69alive@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন