বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আদিগন্ত

আসুন বই পড়া প্রজন্ম গড়ি

| প্রকাশের সময় : ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

এস এম মুকুল : আপনি কি জানেন, মায়ের মুখে গল্প শোনার সময় শিশুরা মনে মনে কল্পনার জাল বোনে। বই মানুষের কল্পনাশক্তিকে উজ্জীবিত করার পাশাপাশি মনের ভিতর নিজের একটি জগৎ তৈরি করে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, বইয়ের সংস্পর্শে এবং বই পড়ে শোনানোর মধ্য দিয়ে বড় করে তোলা শিশুদের সহজে ভাষা শেখা ও স্কুলে সাফল্যের সংযোগ রয়েছে। বই মানুষের মধ্যে দয়া, বিনয় ও সৃজনশীলতার বিকাশে সাহায্য করে। এসব কারণে বই পড়া খুব জরুরি। সন্তানদের হাতে বই তুলে দেওয়া আরো বেশি জরুরি। কিন্তু আমরা বাবা-মায়েরা সন্তানদেরকে সহজে বই কিনে দিতে চাই না। মনে করি, এই টাকাটাই বুঝি গচ্চা গেল। অথচ এই বাবা ময়েরাই পরিশীলিত ও মানবীয় সুসন্তান প্রত্যাশা করি। কিন্তু আমরা আগে ভাবি না যে- সন্তানের মানবীয় বিকাশে বইয়ের গুরুত্ব ও অবদান সবচেয়ে বেশি।
আমরা এই বাবা মায়েরাই নিদ্বিধায় চায়নিজ রেস্টুরেন্টে বা অভিজাত হোটেলে বসে এক-দুই হাজার টাকা খরচ করতে কাপর্ণ্য করি না। অথচ বইমেলায় এসে বই কেনার জন্য দুই হাজার টাকার বাজেট থাকে না। এভাবে মানুষ দিন দিন বই পড়া থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে শিশুদেরকে। অথচ বই হচ্ছে শিশুদের বিনোদনের অন্যতম বড় উৎস। আমাদের বইমেলা ঘুরে এমনও দেখা গেছে, শিশু কিশোররা তাদের ইচ্ছেমতো বা পছন্দমতো বই কিনতে পারছে না। এর পেছনে কারণ দুটি- ১) বাবা-মার অনীহা, ২) বাজেট কম। এমনও দেখা যায়, শিশু-কিশোরদের ইচ্ছা ও আগ্রহকে তুচ্ছ করে, তাদেরকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে মেলা থেকে ফিরিয়ে নেয়া হয়। তারাই আবার বাইরে গিয়ে ফুচকা, আইসক্রিম, বার্গার বা পিৎজা খাইয়ে বই না কিনতে পারার দুঃখটি ভুলিয়ে দেয়া হয়। এটিকে সৃজনশীলতা বিকাশের বিপক্ষে প্রতারণা বললে কি ভুল হবে?
অনেক বিশেষজ্ঞ, ঘুমাতে যাওয়ার আগে মাথাকে শান্ত ও দুঃশ্চিন্তা মুক্ত করার জন্য বই পড়ার উপদেশ দিয়ে থাকেন। কারণ বই পড়ে মানুষ মুক্ত চিন্তাশক্তির বিকাশ ঘটাতে পারে। গভীর মগ্ন হয়ে পড়ার অভ্যাসে ব্রেনের ফিজিক্যাল পরিবর্তন ঘটে। যারা খুব মগ্ন হয়ে বই পড়েন, তারা বাস্তব জীবনে অনেক বেশি সংবেদনশীল হন। অজানাকে জানা ও অচেনাকে চেনার যে চিরন্তন আগ্রহ, তা বই পড়ে মেটানো যায়। একটি উত্তম বই মানুষকে মহৎ হতে শেখায়, মনকে প্রসারিত করে, বুদ্ধির বিকাশ ঘটিয়ে জীবনকে করে তোলে পরিমার্জিত। আবার বই মানুষের সময় কাটানোর অন্যতম উপায়। এখন সেই স্থান দখল করেছে ফেসবুক, মোবাইল, ইন্টারনেট। এসব করে দৃশ্যমান সামাজিক দক্ষতা বাড়লেও স্থায়ী মননশীলতার কোনো উন্নতি হয় না। পক্ষান্তরে বই পড়ে জ্ঞানের ভুবনে মানুষ আপন মনে বিচরণ করে। মানুষকে পরিশীলিত-বিশুদ্ধ জ্ঞান ও আনন্দ দেয় বই। বইয়ের সাথে পার্থিব কোনো ধন-সম্পদের তুলনা হয় না। মানুষের ধন-রতœ, অঢেল সম্পদ এক সময় নিঃশেষ হয়ে যায়, কিন্তু একটি ভালো বইয়ের শিক্ষা কখনো নিঃশেষিত হয় না।
আমাদের শরীরের যেমন ব্যায়াম লাগে, তেমনি মন কিংবা ব্রেনেরও ব্যায়াম লাগে। আর মন ও ব্রেনের সঠিক ব্যায়াম হলো বই পড়া। মগজকে কাজে লাগানো আর মনের পেশিগুলোকে শক্তিশালী করার শ্রেষ্ঠ উপায় বই পড়া। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা-গবেষক ও অধ্যাপক এনি ই. কামিংস তার ‘হোয়াট রিডিং ডাস ফর দ্য মাইন্ড’ নামক গবেষণাপত্রে প্রমাণ করেছেন, বই পড়া স্বাভাবিকভাবেই মানুষকে আধুনিক মানসকামী করে তার বয়স কমিয়ে দেয়। বই পড়ার অনেক উপকার। বই পড়লে শব্দ ভাÐার বাড়বে, স্মরণ শক্তি বাড়বে, ভাবনা আর কল্পনার জগৎ বড় হবে, সৃষ্টিশীলতার বিকাশ ঘটবে। আমেরিকান একাডেমি অব পেডিয়াট্রিকসের গৃহীত নীতিনির্ধারণী অবস্থানে বলা হয়েছে, জন্মের পর থেকেই পড়াশোনার বিষয়টি প্রাথমিক শিশু পরিচর্যার অংশ হওয়া উচিত। এর অর্থ, খুব ছোট বাচ্চাদেরও বই পড়ে শোনানোর গুরুত্ব সম্পর্কে মা-বাবাদের সচেতন করা শিশু চিকিৎসাবিদদের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। আমাদের দেশে এই চর্চা একেবারেই নেই। আমাদের চিকিৎসকরা, শিক্ষকরা এমনকি অন্য পেশাজীবীরাও পড়াশোনার চেয়ে অর্থ উপার্জনের পেছনেই অধিক সময় ব্যয় করেন। পেডিয়াট্রিকস জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্র থেকে জানা গেছে, যেসব শিশুর বাসায় বেশি বই আছে এবং শিশুকে বেশি বই পড়ে শোনানো হয়, তাদের মস্তিষ্কের বাঁ অংশ উল্লেখযোগ্য হারে সক্রিয় বা উদ্দীপিত হয়। একটু বড় শিশুরা জোরে শব্দ করে পড়লে মস্তিষ্কের এই অংশটি উদ্দীপিত হয়।
আরো একটি মজার খবর হলোÑ বই পড়লে আয়ু বাড়ে! ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের মহামারী-সংক্রান্ত বিদ্যার অধ্যাপক এবং বেকা আর লেভির মতে, দিনে আধা ঘণ্টা পড়লেও একদম বইবিমুখ লোকদের চেয়ে কিছু দিন বেশি বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বাড়ে। বই কীভাবে মানুষের সুস্থতা ও আয়ুর ওপর এমন প্রভাব ফেলে তা অস্পষ্ট হলেও গবেষণা বলছে কবিতা, গল্প, উপন্যাস পড়লে মস্তিষ্কের সংযোগ সামর্থ্য ও সহানুভূতি সাধারণত বাড়ে। সোশ্যাল সায়েন্স অ্যান্ড মেডিসিন সাময়িকীর অনলাইন সংস্করণে যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক বলছেন, পড়ুয়া লোকজনের মৃত্যুঝুঁকি অন্যদের চেয়ে ২০ শতাংশ কম হয়ে থাকে। এতে বলা হয়, খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ এবং নিয়মিত শারীরিক ব্যায়ামের মতো বই পড়ার অভ্যাসও মানুষের শরীর ও মনকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। ফলে সুযোগ হয় বেশি দিন বেঁচে থাকার। বিশ্ব সংস্কৃতি সূচক বলছে, সবচেয়ে বেশি বই পড়ার অভ্যাস আছে যথাক্রমে ভারত, থাইল্যান্ড ও চীনে। গবেষণায় দেখা গেছে, যাদের বই পড়ার অভ্যাস আছে, বৃদ্ধ বয়সেও তাদের মস্তিষ্ক খুব তীক্ষè ও স্বাভাবিক থাকে। যারা নিয়মিত বই পড়ে তাদের মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা কমার হার ৪৮ শতাংশ কম। বই পড়ার সময় সহসাই ব্যস্ত রাখার মাধ্যমে মস্তিষ্ককে উদ্দীপিত করে তোলা হয়। মস্তিষ্ক ব্যস্ততায় থাকলে হৃদস্পন্দন, পেশি ও হাঁড়ের গঠন ঠিক থাকে। আর হৃদস্পন্দন ও ভালো হাড়ের গঠন স্মৃতিভ্রষ্টতার মতো রোগকে প্রতিরোধে ক্ষমতা রাখে।
বিশ্ব ব্রহ্মাÐের ভৌগোলিক অবস্থান, ইতিহাস ও সভ্যতা, বিজ্ঞানের বিস্ময়কর আবিষ্কার, জ্ঞানী ব্যক্তিদের চিন্তাধারা ও জীবন দর্শন প্রভৃতি বিষয় আমরা কেবল বই পড়ার মাধ্যমেই জানতে পারি। মহাজাগতিক রহস্য অথবা মহাশূন্য পরিভ্রমণ, সাহিত্য, ভ্রমণ, ইতিহাস, ঐতিহ্য, অর্থনীতি, রাজনীতি, দর্শন, ধর্ম যে কোনো বিষয় সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করতে হলে নিয়মিত বই পড়তে হবে। অনেকেই মনে করে থাকতে পারেন যে, ইন্টারনেটের বদৌলতে বই না পড়েই দুনিয়ার সব জেনে যাচ্ছেন। এটি নিছক অমূলক ধারণা মাত্র। বই পড়তেই হবে। সেটা প্রিন্ট ভার্সন হোক কিংবা নেট ভার্সন বা ই-বুক। তবে প্রিন্ট ভার্সন বা কাগজে মুদ্রিত বইয়ের গুরুত্ব ও আবেদন সবসময়ই থাকবে। তাই বইয়ের প্রতি সবাইকে আকৃষ্ট করে তুলতে হবে। বিশেষত আমাদের শিশু-কিশোরদের মাঝে শৈশব থেকেই এ বোধ জাগিয়ে দিতে হবে। কারণ বিদ্যালয়ে যে পুঁথিগত জ্ঞান শিশু-কিশোররা লাভ করে তাতে মেধার তেমন বিকাশ ঘটে না। তাই পাঠ্যপুস্তকের বাইরে বই পড়তে উৎসাহিত করতে হবে। আমরা অনেকভাবেই নিজেদের পরিবারের মাঝে বই পড়া, সংগ্রহ করা এবং বই উপহার দেয়ার রীতি চালু করতে পারি। কীভাবে হবে সেটাই বলছি। সামাজিক কোনো প্রতিক্রিয়ার দিকে না তাকিয়ে আমরা ঘর থেকেই শুরু করব বই পড়া আন্দোলনটি। প্রথমে পরিবারের সদস্যদের বিয়ে, জন্মদিন, বিশেষ সাফল্য অর্জন, বিদেশযাত্রা, বিশেষ দিবসে অন্য গিফটের পরিবর্তে বই কিনে দিতে পারি। সামাজিক কারণে আমরা বিয়ে বা জন্মদিনে দাওয়াতে বিশেষ কিছু উপহার দিয়ে থাকি। আমরা যদি এসব ক্ষেত্রে বই উপহারকে বেছে নিই তাহলে অনেক ধরনের অনেকগুলো বই উপহার দেয়া যায়। সমাজে এই প্রচলন ছড়িয়ে দিলে দেশব্যাপী বই পড়া আন্দোলন জোরদার হবে এতে সন্দেহ নেই। ঘরে ঘরে প্রতিষ্ঠিত হবে পারিবারিক পাঠাগার। আর এর মাধ্যমে মেধায়, মননে ও সৃজনশীলতায় আমাদের প্রজন্ম গড়ে উঠবে পরিশীলিত ও মানবীয় গুণে। আমরা যত বই পড়ব, মনের চক্ষু ততই খুলবে। আজকের দিনের অস্থির সমাজের অহমিকার ব্যারিকেড ভেঙে দিতে পারে বইপড়া আন্দোলন। আপনার সন্তানকে মোবাইল, ইন্টারনেট আর ফেসবুকের নেশা কাটিয়ে দিতে পারে বইয়ের নেশা। কিন্তু সে নেশাটি ধরাতে হবে অভিভাবকদের প্রাণান্তকর চেষ্টায়। সন্তানদেরকে মাদক আর জঙ্গিবাদ এমনসব বিপথগামিতার হাত থেকে রক্ষা করতে পারে বই। তাই আমাদের সন্তানদের হাতে বই কিনে দিতে হবে। একটি সুন্দর জামার চেয়ে, দামি মোবাইলের চেয়ে কিংবা রেস্তরাঁয় বসে হাজার টাকার উদরপূর্তি করার চেয়ে বইয়ের গুরুত্ব অনেক অনেক বেশি। বই চিরকালের মননশীলতার সঙ্গী। আসুন বইকে আঁকড়ে ধরি। বই পড়ি- জীবন গড়ি।
য় লেখক : সমাজ বিশ্লেষক ও উন্নয়ন গবেষক

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন