মীর আব্দুল আলীম : প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। রোধ করা যাচ্ছে না। সংশ্লিষ্টদের তাবদ হুঙ্কার, আশ্বাস, ভবিষ্যদ্বাণী সবটাই যেন অকার্যকর মনে হচ্ছে। সব কিছুকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এবারও এসএসসি পরীক্ষায় গণিতের প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। গণিত পরীক্ষা শুরু হওয়ার বহু আগে ফেসবুকে দেয়া প্রশ্নের সাথে পরীক্ষার হলে দেওয়া প্রশ্নপত্রের হুবহু মিল পাওয়া গেছে। বরাবরই প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটছে। সরকার জঙ্গি দমন করতে পারছে, বিশ্ব ব্যাংককে উপেক্ষা করে পদ্মা সেতুর মতো কঠিন বৃহত প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে সক্ষমতা দেখানোর পরও প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে ব্যর্থ হচ্ছে কেন? প্রশ্ন হলো, সংশ্লিষ্টরা কি না দেখার ভান করছেন? সবাই জানে প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে। পরীক্ষার্থী, অভিভাবকরাও বলছেন, যে প্রশ্ন তারা অনলাইনে পেয়েছে তার সাথে পরীক্ষা নেয়া প্রশ্নে পুরোপুরি মিলও আছে। সবাই দেখছেন, জানছেন কিন্তু কর্তৃপক্ষ কেন দেখছেন না? প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা স্পষ্ট হলেও সংশ্লিষ্টরা এর দায় কেন নিচ্ছেন না? এমনটা চলতে থাকলে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়বে, শিক্ষার মান বলে কিছু থাকবে না। প্রকৃত শিক্ষিত জাতি থেকে বঞ্চিত হবে দেশ। আর তা দেশের জন্য ভয়ানক একটা সংবাদ।
প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা নতুন নয়। আমাদের ছাত্র জীবনেও প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু তখন কেউ হঠাৎ প্রশ্নপত্র পেলেও অল্প সময়ে এক জায়গা হতে আরেক জায়গায় পাঠানো দুঃসাধ্য ছিল। তথ্যপ্রযুক্তির কারণে এখন প্রশ্নপত্র ফাঁস এবং তা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেওয়া সহজ হয়েছে। কথায় আছে, কাঁটা দিয়েই কাঁটা তুলতে হয়। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমেই প্রশ্নপত্র ফাঁস সমস্যার সমাধান খুঁজতে হবে। প্রশ্নপত্র বিতরণে ভিন্নতা আনতে হবে। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে কৌশলী হতে হবে। প্রযুক্তির সুবিধা নিয়ে পরীক্ষার দিন সকালবেলা প্রশ্নপত্র ছাপানো এবং বিতরণ করা যায়। গণিত প্রশ্ন ফাঁসের পর প্রশ্ন ফাঁস রোধে পরীক্ষার দিন প্রশ্নপত্র স্থানীয়ভাবে ছাপা হবে বলে সংশ্লিষ্টরা বিবৃতি দিয়েছেন। বছর তিনেক আগে আমি প্রশ্ন ফাঁস রোধে আমার লেখা কলামে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে কয়েকটি সুপারিশ করেছিলাম। তখন শিক্ষা বিশেষজ্ঞরাও এজাতীয় সুপারিশ পেশ করেন। তা বাস্তবায়নে মন্ত্রণালয় উদ্যোগীও হয়। কিন্তু দীর্ঘ দিনেও সে সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়নি। তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে সহজেই প্রশ্ন ফাঁস রোধ করা যায়। আলোচিত সৎ এবং সাহসী মেজিস্ট্র্যাট রোকন-উ-দ্দৌলার মতো সরকারি আমলাদের এখানে কাজে লাগাতে হবে। যথা নিয়মে বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রশ্নপত্রের নমুনা কপি সংগ্রহ করা হবে। পরীক্ষার রাতে ঐসব সৎ আমলাদের সমন্বয়ে গঠিত একটি দল সংগৃহীত প্রশ্নপত্র থেকে বেছে বেছে নতুন প্রশ্নপত্রের সেট তৈরি করবেন। সেখান থেকে পরীক্ষার আধা ঘণ্টা আগে কেন্দ্র গুলোতে ই-মেইলে প্রশ্ন পাঠাতে হবে। কেন্দ্রে আধা ঘণ্টা আগে শিক্ষার্থীদেরও প্রবেশ করাতে হবে। এ সময়ে প্রিন্টারে প্রশ্ন প্রিন্ট করে পরীক্ষার হলে সর্বরাহ করতে হবে। তাতে সুফল মিলতে পারে।
এ ক্ষেত্রে পরীক্ষার জন্য একটি সেন্ট্রাল সার্ভার থাকবে। পরীক্ষার আধা ঘণ্টা আগে কেন্দ্রীয় সার্ভার হতে পরীক্ষাকেন্দ্রে থাকা ট্যাব বা কম্পিউটারে প্রশ্ন পৌঁছে দিতে হবে। অথবা ই-মেইলেও এ কাজটি করা যায়। এক ক্লিকেই কয়েক শ’ ই-মেইল পাঠানো সম্ভব। দেশের সবচাইতে বড় পাবলিক পরীক্ষা হলো পিএসসি। এই পরীক্ষার জন্য প্রযুক্তিগত কাঠামো ১২-১৫ কোটি টাকার মধ্যেই গড়া সম্ভব এবং শুধু পিএসসি কেন, জেএসসি, এসএসসি, এইচএসসিসহ যে কোনো পরীক্ষা কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এ ছাড়া বর্তমান প্রশ্নপত্র ছাপা এবং পাঠানোর খরচও অনেক বেশি পড়ে। প্রযুক্তি ব্যবহার করে কেন্দ্রে প্রশ্ন পাঠালে বর্তমানের তুলনায় খরচ কয়েকগুণ কম হবে তাতে সন্দেহ নাই। বর্তমানে উন্নত পৃথিবীতে পরীক্ষার গোপনীয়তা রক্ষার জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তিগত ব্যবস্থা চালু আছে। এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করে এদেশেও প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধ করা সম্ভব। আসল প্রশ্ন হলো, সংশ্লিষ্টরা সমাধান চাইছেন কিনা?
দেশে প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা বিভিন্ন সময়ে হয়েছে। এখনো হচ্ছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের সাফল্য দেশবাসীর কাছে বেশ স্পষ্ট হলেও পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা তাদের সে সফলতাকেই ¤øাান করে দিচ্ছে। প্রায় সব পরীক্ষাতেই এ ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটায় শিক্ষার্থী এবং অভিভাবক মহল চিন্তিত। আর এভাবে চলতে থাকলে শিক্ষা ক্ষেত্রে সাফল্য বজায় থাকবে কিনা তাতেও যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। পিএসসি, জিএসসি, এসএসসি ও সমানের পরীক্ষায় বিভিন্ন বিষয়ে একের পর এক প্রশ্ন ফাঁস হচ্চে। এ নিয়ে পত্রিকায় লেখালেখিও হচ্ছে। কিন্তু সংশ্লিষ্টদের কর্ণকুহরে পানি ঢুকছে বলে মনে হচ্ছে না। তা যদি হতো তাহলে একের পর এক প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটত না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঘটনা ধামাচাপা দেয়া হয়ে থাকে। একবারও এ বিষয়ে দুঃখ প্রকাশ করে না কেউ। ‘শর্ট সাজেশনস থেকে আসতে পারে’ এমন মন্তব্য করে শিক্ষা বিভাগ বিষয়টিকে এড়িয়ে যাওয়ার অপচেষ্টা চালায়। এর আগে মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা স্পষ্ট হলেও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। যথারীতি ফল প্রকাশ করে ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করায় মেধাবীরা বঞ্চিতই থেকে যাচ্ছে। পরীক্ষার আগে প্রশ্ন পাওয়াসহ মুঠোফোনে খুদে বার্তার (এসএমএস) মাধ্যমে প্রতিটি পরীক্ষার আগেই প্রশ্ন পৌঁছে যাচ্ছে পরীক্ষার্থীদের হাতে। পরীক্ষার পর দেখা যাচ্ছে, মূল প্রশ্নপত্রের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। এদিকে প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত অভিযোগে কয়েকজনকে আটকও করেছে পুলিশ।
প্রশ্ন হলো, কী হচ্ছে এসব? শিক্ষা ক্ষেত্রে এভাবেই কি প্রতিনিয়ত প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটবে? এসব রোধ করা হচ্ছে না কেন? সরকার কি রোধ করতে পারছে না? আমরা এ কথা সহজভাবে মেনে নিতে রাজি নই। সরকার চাইলে সবই পারে। বিশেষ করে বর্তমান সরকারের পারার পারঙ্গমতা অনেক বেশিই মনে হয়। এ সরকার জঙ্গিবাদ দমন করতে পারলে প্রশ্নপ্রত্র ফাঁসকারীদের রোধ করতে পারবে না কেন? তবে কি সরকার এ ক্ষেত্রে আন্তরিক নয়? যদি হয় তাহলে প্রতিবারই প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে কেন। যাই বলি না কেন এ ব্যাপারে সরকার দায় এবং ব্যর্থতা এড়াতে পারে না। সরকার এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হলে প্রশ্নপত্রের বিষয়টি বেসরকারি কোনো সংস্থার হতে ন্যস্ত করুক। কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে এর দায়িত্ব দিক। আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঢের দেখেছি। এখন খুব কম। এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনেকাংশে সফল বলা চলে। এ দায়িত্বটা বাড়তি দায়িত্ব হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পরীক্ষামূলকভাবে দেয়া যেতে পারে।
প্রশ্নপত্র ফাঁস, প্রকাশ বা বিতরণের সঙ্গে জড়িত থাকার শাস্তি ন্যূনতম ৩ বছর থেকে সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদÐসহ অর্থদÐের বিধান রয়েছে। কতবার প্রশ্নপত্র ফাঁস হলো ক’জনকে এ শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে। পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) আইন, ১৯৮০ এবং সংশোধনী ১৯৯২-এর চার নাম্বার ধারায় এই শাস্তির বিধান রয়েছে। কিন্তু আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এমনকি মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন অনেক কর্মকর্তাই শাস্তির এ বিধান সম্পর্কে খোঁজখবর রাখেন না। প্রশ্ন ফাঁসের পর তদন্ত কমিটি হয়। অনেক ক্ষেত্রেই অভিযোগ প্রমাণিত হয় কিন্তু শাস্তি হয় না। ফলে অপরাধীরা পার পেয়ে বারবার একই ঘটনা ঘটাচ্ছে। এক হিসাবে দেখা গেছে, ১৯৭৯ সালে প্রথম এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়। ওই সময় থেকে ২০১৭ সাল পর্যস্ত সরকারি তথ্য অনুযায়ী ৮২ বার বিসিএসসহ বিভিন্ন চাকরি ও পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। ২০১৪ সালের জেএসপি, পিএসসি, এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়। ২০১৫ সালে মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটে। ২০১৬ সালেও পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ ২০১৭ সালের গণিত পরীক্ষায় পশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটে। প্রশ্ন ফাঁসের তথ্য পরিসংখ্যান বেসরকারি হিসাবে সংখ্যা আরো বাড়বে। এর মধ্যে পরীক্ষা স্থগিত, বাতিল ও তদন্ত কমিটি হয়েছে মাত্র ৩০টি পরীক্ষায়। তদন্ত কমিটি হোতাদের চিহ্নিত করে প্রশ্ন ফাঁস রোধে বিভিন্ন সুপারিশ করলেও কোনোটিরই বাস্তবায়ন হয়নি। কারো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিও হয়নি। এমনকি তদন্ত প্রতিবেদন পর্যন্ত আলোর মুখ দেখে না।
প্রশ্নফাঁসের ফলে একটি নীতিহীন সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের বেড়ে ওঠার সুযোগ তৈরি হয়েছে। অভিভাবক ও শিক্ষার্থী সবার মধ্যেই একটি ব্যাধি সংক্রামক আকারে বাড়ছে। এটা রোধ করা না গেলে অদূর ভবিষ্যতে একটি নীতিবিবর্জিত প্রজন্ম উপহার দেয়ার মতো বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে বলেই আমরা মনে করি।
য় লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন