আহমেদ জামিল : বর্ণবাদী ও ইসলামবিদ্বেষী ট্রাম্প গত ২০ জানুয়ারি অনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে একের পর এক যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করে চলেছেন তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে এবং বহির্বিশ্বে প্রচ- ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। প্রায় প্রতিদিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে এবং ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে প্রচ- ট্রাম্পবিরোধী বিক্ষোভ চলছে। ট্রাম্পের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের আদালত অবস্থান নিয়েছে। বলা চলে, ট্রাম্প প্রশাসন এবং বিচার বিভাগ একে অন্যের মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে। ট্রাম্পের ‘সবার আগে আমেরিকা’ এ ধরনের উগ্র জাতীয়তাবাদী স্লোগান বর্তমান সময়ের বিশ্বায়নের নীতির পরিপন্থী। এ ধরনের সংকীর্ণ এবং চরমপন্থি জাতীয়তাবাদী বক্তব্যের কারণে কেউ কেউ ট্রাম্পের মধ্যে হিটলারের প্রতিচ্ছবিও দেখতে পাচ্ছেন। ক্ষমতা গ্রহণের মাত্র ৭ দিনের মাথায় ট্রাম্প সবচেয়ে বিতর্কিত সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করেন।
গত ২৭ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক নির্বাহী আদেশ জারি করেন। এই নির্বাহী আদেশে সিরীয় ও অন্যান্য উদ্বাস্তু পুনর্বাসন ১২০ দিনের জন্য এবং মুসলিম প্রধান ৭টি দেশ যথাক্রমে সিরিয়া, ইরাক, ইরান, লিবিয়া, সুদান, সোমালিয়া ও ইয়েমেনের নাগরিকদের ৯০ দিনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ নিষিদ্ধের কথা বলা হয়েছে। বহু মার্কিন সংবিধান বিশেষজ্ঞের মতে, ট্রাম্পের এ ধরনের নির্বাহী আদেশ যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের পঞ্চম ও চতুর্দশ সংশোধনীর পরিপন্থী। এ প্রেক্ষাপটে ওয়াশিংটন অঙ্গরাজ্যের সিয়াটলের মার্কিন ডিস্ট্রিক্ট আদালতের বিচারক জেমস রবার্ট এই নির্বাহী আদেশ স্থগিত করেন এবং তার বিরুদ্ধে ট্রাম্প প্রশাসন আপিল করে। উল্লেখ্য, ওয়াশিংটন এবং মিনেসোটা এই দুটি অঙ্গরাজ্য এই আদেশের বিরুদ্ধে আদালতের শরণাপন্ন হয়েছিল।
যা হোক, ট্রাম্প প্রশাসন সিয়াটলের আদালতের ওপর স্থগিতাদেশ চাইলে আপিল আদালত ট্রাম্প প্রশাসনের আবেদন নাকচ করে। একে ট্রাম্পের নির্বাহী ক্ষমতার বিরুদ্ধে আদালতের চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হচ্ছে। এরপরও শ্বেতবর্ণবাদীয় ও মুসলিমবিদ্বেষী ট্রাম্প এবং তার সাঙ্গপাঙ্গরা বসে নেই। অভিবাসী ঠেকাতে ট্রাম্প নতুন পরিকল্পনা আঁটছেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে ইতোমধ্যে শত শত অবৈধ অভিবাসীকে আটক করা হচ্ছে। অভিবাসীদের মধ্যে বিরাজ করছে আতঙ্ক। অন্যদিকে ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশের বিরুদ্ধে রায়ের আপিল উচ্চ আদালত কর্তৃক নাকচ হওয়ার ঘটনাকে তার প্রশাসনের প্রতি বড় ধরনের আঘাত হিসেবে দেখা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, এক মাস না যেতেই ট্রাম্প প্রশাসনের মধ্যে শুরু হয়েছে নানা সংকট। প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইকেল ফ্লিন ওয়াশিংটনে রুশ রাষ্ট্রদূতের সাথে গোপনে কথা বলেছেন, যার বিষয়বস্তু ছিল রাশিয়ার ওপর ওবামা প্রশাসনের বিধিনিষেধ।
এই যোগাযোগ জাতীয় স্বার্থবিরোধী এই যুক্তিতে ফ্লিনের পদত্যাগ দাবি করেছেন বিরোধী ডেমোক্রেটরা। নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ অভিযোগ প্রমাণিত হলে ফ্লিন গুপ্তচরবৃত্তি অথবা দেশদ্রোহের মতো অভিযোগের সম্মুখীন হতে পারেন। ট্রাম্পের হটকারী ও অপরিণামদর্শী বিভিন্ন সিদ্ধান্ত বহির্বিশ্বে প্রচ- ক্ষোভ ও উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা ঘটাতে যাচ্ছেন? শুরুতে ট্রাম্প চীন ও ইরানের বিরুদ্ধে মারমুখী নীতি গ্রহণ করেন। ক্ষমতা গ্রহণের পর ট্রাম্প তাইওয়ানের প্রেসিডেন্টের সাথে ফোনালাপ ও তাকে যুক্তরাষ্ট্র সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েই ক্ষান্ত হননি, সেই সাথে তিনি ও তার প্রশাসনের প্রভাবশালী এক কর্মকর্তা ঘোষণা করেনÑ যুক্তরাষ্ট্র ‘এক চীন নীতি’ থেকে সরে আসার পরিকল্পনা করছে। অথচ, সাবেক প্রেসিডেন্ট নিক্সন হতে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের সকল প্রেসিডেন্ট এই ‘এক চীন নীতি’ অনুসরণ করে এসেছেন।
দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের আধিপত্য মোকাবেলায় সেখানে মার্কিন নৌশক্তি বাড়ানোর কথাও ঘোষণা করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। এতে করে দক্ষিণ চীন সাগরে বিরাজ করছে প্রবল উত্তেজনা। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে চীনা পণ্যের অবাধ প্রবেশে সৃষ্টি করা হচ্ছে নানা প্রতিবন্ধকতা। চীনা পণ্যের ওপর শুল্ক বহুগুণ বৃদ্ধি করা হয়েছে। চীনের সাথে সম্পর্ক তিক্ত করলেও এ সময়ে চীনের ঘনিষ্ঠ মিত্র রাশিয়ার সাথে নিবিড় সম্পর্ক গড়ার কথা বলছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। নির্বাচনী প্রচারকালে এবং প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণের পর বহুবার ট্রাম্প রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছেন। তবে এটি করার কারণে ট্রাম্প এখন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে তোপের মুখে আছেন। মজার ব্যাপার হলো, রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক দৃঢ় এবং পুতিনের প্রশংসা করার পরও ইউক্রেন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়াবিরোধী অবস্থান বজায় রাখার পাশাপাশি লাটভিয়াতে মার্কিন সমরাস্ত্র সরবরাহ বৃদ্ধি করেছে ট্রাম্প প্রশাসন।
এতে করে যে কোনো সময় যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যকার মধু চন্দ্রিমার অবসান ঘটতে পারে। মনে রাখতে হবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো রাশিয়াও আধিপত্যবাদী শক্তি। বিশ্বে আধিপত্য বিস্তার করা নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘাত অনিবার্য। ট্রাম্পের আরেকটি বিতর্কিত ও ঘৃণ্য সিদ্ধান্ত হলো অতি ইসরাইলপন্থি নীতির সাথে তেলআবিব থেকে জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তরের চিন্তা। ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত তার মুসলিমবিদ্বেষী মনোভাবেরই বহিঃপ্রকাশ। ট্রাম্প প্রশাসনের এ সিদ্ধান্ত ফিলিস্তিনসহ আরব বিশ্বে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। ট্রাম্পের এহেন কর্মকা- কথিত জঙ্গিদের হাতকেই শুধু যে শক্তিশালী করবে তা নয়, সেই সাথে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা ঝুঁকিও আরো বৃদ্ধি করবে। তাছাড়া প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ক্ষমতায় বসে প্রতিবেশী দেশ মেক্সিকোর সাথে বিবাদে লিপ্ত হয়েছেন।
মেক্সিকানদের যুক্তরাষ্ট্রে অবাধ প্রবেশ বন্ধের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকো সীমান্তে মেক্সিকোর নিজ অর্থে দেয়াল নির্মাণের জন্য এক ধরনের হুকুম জারির পাশাপাশি মেক্সিকান পণ্যের ওপর ২০ শতাংশ করারোপের পরিকল্পনা করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। এর ফলে মেক্সিকানদের মধ্যে মার্কিনবিরোধী মনোভাব প্রবল হয়ে উঠেছে। রাজধানী মেক্সিকো সিটিসহ দেশটির বিভিন্ন শহরে প্রায় প্রতিদিন ট্রাম্পবিরোধী বিক্ষোভ চলছে। এদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হুমকি দিয়েছেন মেক্সিকো যদি দেয়াল নির্মাণ না করে তাহলে সেদেশে মার্কিন সৈন্য প্রেরণ করা হবে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের এ ধরনের আগ্রাসী ও কর্তৃত্ববাদী নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট এনরিকো পেনা নিয়েতোর ওয়াশিংটনে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে বৈঠক বাতিল করেছেন।
এদিকে ইরানের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ নিষিদ্ধের প্রতিবাদে ইরান সরকার তাদের দেশে মার্কিন নাগরিকদের সফরে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এর পাশাপাশি ট্রাম্পের চীনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে বেইজিং কঠোর অবস্থান নেয়ায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সুর পাল্টে বলতে বাধ্য হয়েছেনÑ এক চীন নীতিকে সম্মান জানাবে যুক্তরাষ্ট্র। উল্লেখ্য, বিচ্ছিন্ন হওয়া তাইওয়ানকে চীন তার অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে মনে করে। এদিকে আরব তথা মুসলিম বিশ্বের প্রতিক্রিয়া লক্ষ করে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তর না করার কথাও ইতোমধ্যে ঘোষণা করেছেন। একইভাবে তিনি ন্যাটোর সাথে সম্পর্কচ্ছেদ না করা এবং জার্মানিসহ ইউরোপের দেশগুলোর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখার কথাও বলছেন। বিভিন্ন ইস্যুতে ট্রাম্পের এই পিছু হটা কার্যত তাকে কাগুজে বাঘে পরিণত করেছে। তার ভূমিকা বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমর্যাদাকেই খর্ব করেছে।
লেখক : কলামিস্ট
jamil201312@live.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন