মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী : বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পরিচালিত একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম অধ্যুষিত রাষ্ট্র। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার ধারণায় ‘মেজরিটি মাস্ট বি গ্রান্টেড’ বলে একটি বিষয় রয়েছে; কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকেই ব্রাহ্মণ্যবাদের আজ্ঞাবাহী একশ্রেণির পেইড ও প্রপাগান্ডিস্ট মিডিয়া ও ইসলামবিদ্বেষী সেক্যুলার অপশক্তি এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ বৃহত্তর তৌহিদি জনতার ধর্মীয় মূল্যবোধ ও ঈমান-আক্বিদার বিরুদ্ধে নানা ধরনের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পন্থায় অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বাতিল, পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ দেয়া নাস্তিক্যবাদী ও হিন্দুত্ববাদী প্রবন্ধ-নিবন্ধ সংযোজনের দাবিও করছে। সুতরাং আমরা মনে করি, সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গণে গ্রিক দেবীর মূর্তি স্থাপনও সেই ধারাবাহিকতারই একটি অংশ। মসজিদের নগরী ঢাকাকে মূর্তির নগরী বানানোর নতুন ষড়যন্ত্রেরই অংশ এটি। এটা কৌশলে সুপ্রিমকোর্টের বিচারক, বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা, ইতিহাস-ঐতিহ্যকে হেয় ও অপমান করা, কোটি কোটি মুসলমানকে ঈমানহারা করা এবং বাংলাদেশের মুসলিম ঐতিহ্য ও পরিচিতি মুছে ফেলার সুগভীর ষড়যন্ত্রের অংশ। এরা ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ধর্মহীন কর্মকা-ের মাধ্যমে বাংলাদেশে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে আদর্শিক সংঘাত সৃষ্টির ক্ষেত্র তৈরি করছে।
দেশের মানুষের ন্যায়বিচার পাওয়ার সর্বোচ্চ স্থান হচ্ছে বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট। এর সাথেই রয়েছে আমাদের জাতীয় ঈদগ্াহ ময়দান। যেখানে রাষ্ট্রপ্রধানসহ সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ প্রতি বছর পবিত্র দু’ঈদের নামাজ আদায় করে থাকেন। মুসলমানরা এক আল্লাহর ইবাদত করে, তাকেই ন্যায় ও ইনসাফভিত্তিক সার্বজনীন কল্যাণকর আইনের বিধানদাতা হিসেবে বিশ্বাস করে। ইসলামী শরিয়তে নামাজ যেমন ইবাদত, ঠিক তেমনিভাবে ন্যায়বিচার করাও ইবাদত। আর ন্যায়বিচারের প্রতীক হলো মহান আল্লাহর পবিত্র কিতাব মহাগ্রন্থ আল কোরআন। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম অধ্যুষিত রাষ্ট্র বাংলাদেশের সুপ্রিমকোর্ট ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসেবে আল কোরআনকেই স্বীকার করবে এবং মানবে, এটাই যুক্তিযুক্ত। গ্রিকদের কল্পিত দেবী থেমিসের মূর্তিকে ন্যায়ের প্রতীক মনে করা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক এবং অগণতান্ত্রিক। সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গণে কথিত ন্যায়ের প্রতীক গ্রিক দেবীর মূর্তি স্থাপন মুসলমানদের সাথে চরম ধৃষ্টতার শামিল, এমনকি রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের অবমাননাও বটে। এদেশের সংবিধানের সাথেও এটি সাংঘর্ষিকÑঅর্থাৎ সংবিধানের ২ (ক), ১২ এবং ২৩ অনুচ্ছেদের সম্পূর্ণ বিরোধী। এটি দেশের তৌহিদি জনতার ঈমানী চেতনা, ধর্মীয় ভাবধারা ও মূল্যবোধের বিরোধী এবং সেইসাথে এটি স্বাধীন জাতি হিসেবে আমাদের নিজস্ব ইতিহাস, কৃষ্টি-সংস্কৃতি ও আত্মমর্যাদাবোধেরও সম্পূর্ণ বিপরীত।
গ্রিক দেবীর মূর্তি নয়, মুসলমানদের জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার প্রতীক হলো মহাগ্রন্থ পবিত্র আল কোরআন। মহান আল্লাহর মনোনীত ধর্ম ইসলামে মূর্তি স্থাপন হারাম। মূর্তিকে ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসেবে বিশ্বাস করলে বা এমন ভাবনা অন্তরে পোষণ করলে, কোনো মুসলমানের ঈমান থাকবে না। হাদিস শরিফে রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন, কিয়ামতের দিন আল্লাহর নিকট সর্বাধিক আযাবপ্রাপ্ত লোক হবে মূর্তি প্রস্তুতকারীগণ। ইসলামে মূর্তি স্থাপন, মূর্তিকে সম্মান জানানো এবং ন্যায়ের প্রতীক মনে করা র্শিক। কোনো প্রাণীর-মূর্তি নির্মাণ করা ইসলামী শরিয়তে সম্পূর্ণ হারাম ও কবীরা গুনাহ। মূর্তি সংগ্রহ, মূর্তি সংরক্ষণ এবং মূর্তি কেনা-বেচা ইত্যাদি সকল বিষয় শক্তভাবে নিষিদ্ধ। মূর্তিপূজার কথাতো বলাই বাহুল্য, মূর্তি নির্মাণেরও কিছু কিছু পর্যায় এমন রয়েছে যা কুফরীর শামিল। মূর্তি ও ভাস্কর্যের মধ্যে বিধানগত পার্থক্য নেই। ইসলামের দৃষ্টিতে মূর্তি ও ভাস্কর্য দুটোই পরিত্যাজ্য। কোরআন মজীদ ও হাদিস শরিফে মূর্তি ও ভাস্কর্য দুটোকেই নির্দেশ করেছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা পরিহার কর অপবিত্র বস্তু মূর্তিসমূহ এবং পরিহার কর মিথ্যাকথন’ (সূরা হজ-৩০)। ‘এরা (মূর্তি ও ভাস্কর্য) অসংখ্য মানুষকে পথভ্রষ্ট করেছে’ (সূরা ইবরাহীম-৩৬)।
নবী করীম (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ তা’আলা আমাকে প্রেরণ করেছেন, আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার, মূর্তিসমূহ ভেঙে ফেলার এবং এক আল্লাহর ইবাদত করার ও তাঁর সঙ্গে অন্য কোনো কিছুকে শরিক না করার বিধান দিয়ে’ (সহীহ মুসলিম হাদিস নং- ৮৩২)। রাসূলুল্লাহ (সা.) আরো বলেন, ‘প্রতিকৃতি তৈরিকারী (ভাস্কর, চিত্রকর) শ্রেণী হলো ওইসব লোকদের অন্তর্ভুক্ত যাদেরকে কিয়ামত-দিবসে সবচেয়ে কঠিন শাস্তি প্রদান করা হবে’ (সহীহ বুখারি হাদিস নং- ৫৯৫০)। সুতরাং কোরআন ও সুন্নাহর এই সুস্পষ্ট বিধানের কারণে মূর্তি বা ভাস্কর্য নির্মাণ, সংগ্রহ, সংরক্ষণ ইত্যাদি সকল বিষয়ের অবৈধতার উপর গোটা মুসলিম উম্মাহর ইজমা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি এই বাংলাদেশের নাগরিকদের ধর্ম, কৃষ্টি, সংস্কৃতির সাথে রোমানদের সংস্কৃতির কোনো মিল নেই, সম্পূর্ণ আলাদা। রোমানদের কাছে ন্যায়ের প্রতীক কল্পিত গ্রিক দেবীর সাথে এই দেশের ঐতিহ্য, ইতিহাস ও ভাব-সম্পদের ন্যূনতম সম্পর্ক নেই, তা সত্ত্বেও কীভাবে এবং কাকে খুশি করতে হাইকোর্টের সামনে এরকম অগ্রহণযোগ্য ও বিজাতীয় দেবীর মূর্তি স্থাপন করা হলো? কারা কী উদ্দেশ্যে এটি করার সুযোগ পেল? কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে দেশের মানুষের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। দেশের ৯২ ভাগ মুসলমানের চিন্তা ও চেতনার পরিপন্থি গ্রিক দেবীর মূর্তি স্থাপন কোনোভাবে মেনে নেয়া যায় না। গ্রিক পুরাণের কল্পিত দেবী থেমিসÑ রোমানদের কাছে ন্যায়ের প্রতীক হতে পারে, কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে আমরা তাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য থেকে ধার করে কেন হীন ঔপনিবেশিক ধ্যান-ধারণা লালন করব? আমরা ভূইফোঁড় কোনো জাতি নই যে পরজীবিতার আশ্রয় নিতে হবে। অন্যদিকে, উদাহরণস্বরূপ : আমাদের প্রতিবেশী হিন্দু অধ্যুষিত ভারতের সুপ্রিমকোর্ট-প্রাঙ্গণে কোনো ধরনের মূর্তি স্থাপনের নজির নেই। এছাড়া খ্রিস্টান অধ্যুষিত আমেরিকার সুপ্রিমকোর্টের সামনে পৃথিবীর সফল আইনপ্রণেতা হিসেবে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর সম্মানে একটি নামফলক রয়েছে। তাহলে আমাদের হাইকোর্টের সামনে কেন গ্রিক দেবীর মূর্তি স্থাপন করা হবে? যা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।
আমরা লক্ষ করছি যে, সম্প্রতি গুটিকয়েক গণবিচ্ছিন্ন বাম ও সেক্যুলারপন্থী বুদ্ধিজীবীরা মিডিয়ার মারফতে গ্রিক দেবীর মূর্তিকে ‘ভাস্কর্য’ বলে জনগণকে বিভ্রান্ত করছেন। ভিনদেশী রোমানদের উলঙ্গ গ্রিক দেবীর মূর্তিকে শাড়ি পরিয়ে বাঙালি সংস্কৃতির আদলে উপস্থাপন করার অপচেষ্টা চালাচ্ছেন। যা আমাদের জাতিগত হীনম্মন্যতারই বহিঃপ্রকাশ। অথচ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে কোনো গ্রিক দেবীর ন্যূনতম সম্পর্ক নেই। তাছাড়া ঔপনিবেশিক ধ্যান-ধারণা পোষণ কোনোভাবেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হতে পারে না। গ্রিক দেবীর মূর্তি স্থাপনপূর্বক আমাদের জাতীয় মন ও মানসে ঔপনিবেশিক বিজাতীয় কৃষ্টির অনুপ্রবেশ করা হচ্ছে। এছাড়া সময়ান্তরে মানব-প্রতিকৃতি এবং পৌত্তলিক ধ্যান-ধারণার সাথে সম্পৃক্ত বিশেষ জীব-জানোয়ারের মূর্তি তৈরি করে সেগুলোকে ঢালাওভাবে ‘বাঙালি সংস্কৃতি’ বলে সার্বজনীন করার অপরাজনীতিও চলছে।
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বিবিসি’কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘ভাস্কর্য এবং মূর্তির মধ্যে পার্থক্য বোঝা প্রয়োজন। ভাস্কর্য এবং ধর্মীয় প্রতিমাকে গুলিয়ে ফেলার একটা প্রবণতা আমাদের সমাজে আছে। সেই সুযোগ নেয় ধর্মীয় উগ্রবাদিরা। এখনো তাই হয়েছে।’ আমরা মনে করি, তার এই বক্তব্য ঠিক মলমূত্রকে খাদ্য বলে চালিয়ে দেয়ার নামান্তর। ভাস্কর্য এবং মূর্তি’র পার্থক্যের জ্ঞান ধর্মীয় জ্ঞানহীন লোক থেকে আমাদের শিখতে হবে কেন? দেশের ধর্মপ্রাণ জনসাধারণ ও আলেম সমাজকে বোকা ভাবা এবং ধর্মজ্ঞান শেখানো মূর্খতারই পরিচায়ক। প্রশ্ন হলো, ১৯৪৮ সালে সুপ্রিমকোর্ট প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে দীর্ঘদিন তো কোনো মূর্তি ছিল না। তাহলে কি এতদিন বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টে ন্যায়বিচার হয়নি?
বিবিসি’কে তিনি আরো বলেছিলেন, ‘রোমান আইন থেকেই আমাদের বিচারের বিষয়ের উৎপত্তি। সেজন্যই অন্যান্য দেশের মতো এই ভাস্কর্য করা হয়েছে।’ একটি স্বাধীন ঐতিহ্যবাহী জাতির অ্যাটর্নি জেনারেল হয়ে তার এহেন বক্তব্য অসমীচীন, কারণ তিনি এই বক্তব্যের মাধ্যমে আমাদের বিচারব্যবস্থায় এখনো যে ঔপনিবেশবাদের গোলামির চর্চা চলছে, সেই অপ্রিয় সত্য কথাটি প্রকারান্তরে স্বীকার করে নিলেন। আমরা মনে করি, আমাদের বিচারব্যবস্থার সংস্কার অপরিহার্য, কেননা ব্রিটিশ ঔনিবেশবাদের রেখে যাওয়া এবং গড়ে দেয়া পুরনো ও পশ্চিমা মধ্যযুগীয় আইন ও নীতিমালা এখন পর্যন্ত আমাদের বিচারব্যবস্থায় চালু রাখার অর্থই হলো, আমরা এখনো ব্রিটিশ ঔনিবেশবাদের গোলামি থেকে নিজেদের সম্পূর্ণ মুক্ত করতে পারিনি। আজকে এই ব্যর্থতা স্বীকার করে আমাদের বিচারব্যবস্থা ও আইনতত্ত্বকে ন্যায় ও ইনসাফের প্রতীক পবিত্র কোরআনের আলোকে ঢেলে সাজাতে হবে, এবং যতক্ষণ তা করা হবে না, ততক্ষণ এদেশের গণমানুষ প্রকৃত ইনসাফ ও ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হতে থাকবে।
গত ৬ ফেব্রুয়ারি হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশর আমির, মুসলিম উম্মাহর আধ্যাত্মিক রাহাবর, শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফী (দা.বা.) গণমাধ্যমে প্রেরিত এক বিবৃতিতে সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, ‘মুসলমানদের ঈমান, আক্বিদা ও ঐতিহ্য রক্ষার লক্ষ্যে হাইকোর্ট-প্রাঙ্গণ থেকে এই গ্রিক মূর্তি অপসারণ করতে হবে; অন্যথায় আলেম-ওলামা বৃহত্তর তৌহিদি জনতাকে সঙ্গে নিয়ে প্রয়োজনে রাজপথে নেমে দুর্বার গণআন্দোলন গড়ে তুলতে বাধ্য হবে, এই বিষয়ে কোনো আপস হবে না এবং কোনো ছাড় দেয়া হবে না।”
হেফাজত আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফী বিবৃতির মাধ্যমে মুসলমানদের ঈমান আক্বিদা রক্ষার স্বার্থে মূর্তি ও অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে কঠিন আন্দোলনের ইংগিত দিয়েছেন। ঈমানের দাবি পূরণে হেফাজতে ইসলামের আন্দোলনের সাথে দেশবাসীকে সোচ্চার হওয়া একান্ত প্রয়োজন। শতকরা ৯২ ভাগ মুসলমানের বাংলাদেশে সুপ্রিমকোর্টসহ দেশের কোথাও কোনো মূর্তি স্থাপন ও সংরক্ষণ করতে দেয়া যাবে না। অবিলম্বে সব মূর্তি অপসারণ করার দাবিকে আরো জোরদার করতে এবং মূর্তি স্থাপনের ষড়যন্ত্রের সাথে যারা জড়িত, তাদেরকে বিচারের আওতায় আনতে ইসলামী দলসমূহ এবং সর্বস্তরের ওলামা-পীর মাশায়েখ ও তৌহিদী জনতার সুদৃঢ় ঐক্য সময়ের অপরিহার্য দাবি।
লেখক : কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ
azizislamabadi@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন