গোলাম আশরাফ খান উজ্জ্বল : আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি, ছেলে হারা শত মায়ের অশ্রুগড়ায়ে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি\” পৃথিবীতে একমাত্র বাংলা ভাষার জন্যই মানুষই আন্দোলন করে। যা পৃথিবীর ইতিহাসে এটি এক বিরল ঘটনা। শুধুমাত্র বাঙালিরাই ভাষার জন্য রাজপথে জীবন দিয়েছেন। মো. আলী জিন্নাহর ১৯৪৪ সালের পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু ঘোষণার সাথে সাথে বাংলার প্রতিটি অঞ্চলের মতো মুন্সীগঞ্জেও হয় আন্দোলন, হয় নানা ধরনের সভা-সমাবেশ। ঢাকার অতি নিকটের জেলা মুন্সীগঞ্জ। ঢাকার ভাষা আন্দোলনের ঢেউ মুন্সীগঞ্জেও লেগেছিল। ১৯৪৮ সাল থেকে রাষ্ট্র ভাষা বাংলার দাবিতে সোচ্চার মুন্সীগঞ্জবাসী। ভাষা আন্দোলনের দু’টি মূলস্থান ছিল সরকারি হরগঙ্গা কলেজ ও মুন্সীগঞ্জ হাই স্কুল।
১৫ ফেব্রæয়ারি ১৯৫২ সাল। ভাষার দাবিতে মুন্সীগঞ্জ হয়ে পড়ে উত্তাল। মফস্বল শহরের প্রতিটি রাস্তা হয়ে পড়ে মিছিলে উত্তাল। ঘর ছেড়ে মানুষ ভিড় জমায় সদর রাস্তায়। ছাত্র, শিক্ষক, কৃষক, শ্রমিক সবাই মিছিল করতে থাকে “রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই। আমাদের দাবী মানতে হবে।” বেলা ১১টার দিকে সরকারি হরগঙ্গা কলেজের ছাত্র নেতা সৈয়দ খোকার নেতৃত্বে একটি বিশাল মিছিল শহর প্রদক্ষিণ করে। মিছিলটি কলেজ থেকে শুরু হয়ে পুরাতন কাচারী, জমিদার পাড় মোড়, বাজার রোড, মুন্সীগঞ্জ থানার সম্মুখ হয়ে, থানার পুল, দর্পনা এলাকা দিয়ে লঞ্চঘাট পর্যন্ত যায়।
সেখান থেকে ফেরার পথে মিছিলটি যখন গোয়াল পাড়া অতিক্রম করছিল তখন বিরোধীরা মিছিলে আক্রমণ করে। সে সময় তেজস্ক্রিয় অস্ত্র, সোডার বোতল মিছিলে নিক্ষেপ করা হয়। এতে অনেক আন্দোলনকারী মারাত্মক আহত হয়। তাদের মধ্যে যাদের নাম পাওয়া যায় এরা হলেন বজলুর রহমান রবি, এডভোকেট মোতাহার হোসেন চৌধুরী ও মোবারক হোসেন। এদের পুরাতন কাচারীস্থ তৎকালীন মুন্সীগঞ্জ মহকুমা হাসপাতালে চিকিৎসা করা হয়। এ মিছিলটিতে অংশগ্রহণ করেছিলেন সরকারি হরগঙ্গা কলেজের সেই সময়ের ছাত্র বর্তমানে অবসর প্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা লুৎফর রহমান। তিনি বলেন এ আকস্মিক হামলায় মিছিলকারীরা দমে যায়নি। তারা দ্বিগুণ শক্তিতে বলিয়ান হয়ে মিছিল সহকারে মুন্সীগঞ্জ হাই স্কুলে জমায়েত হয়। স্কুল, কলেজ ও সুধী সমাজ মিলে হাজার খানেক লোকের এক বিশাল সমাবেশে পরিণত হয় মিছিলটি।
মিছিল শেষে সমাবেশে বক্তব্য রাখেনÑ সৈয়দ খোকা, জিতেন মোক্তার, জ্ঞান মোক্তার, রুহিনী বাবু ও হিরালাল মোক্তার। এর পর থেকে মুন্সীগঞ্জ আরো উত্তপ্ত হতে থাকে। ভাষার দাবিতে মুন্সীগঞ্জ হতে থাকে উত্তাল। এর পরের ঘটনা সবারই জানা। ২১ ফেব্রæয়ারি ১৯৫২ সাল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মিছিলে গুলিবর্ষণ করা হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে পুলিশ গুলি চালালে সালাম, রফিক, জব্বার, বরকত শহীদ হয়। এ খবর বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো মুন্সীগঞ্জেও ছড়িয়ে পড়ে। তীব্র ক্ষোভে রাস্তায় নেমে পড়ে সর্বস্তরের জনগণ। হরগঙ্গা কলেজের ছাত্ররা তাৎক্ষণিক একটি মিছিল বের করে এবং একটি প্রতিবাদ সভা হয় কলেজ চত্বরে। প্রতিবাদ সভায় বক্তব্য রাখেন হরগঙ্গা কলেজের সুরবিন্দ সেন, মোয়াজ্জেম হোসন খান ও হারুন অর রশিদ। মুন্সীগঞ্জ, গজারিয়া, টঙ্গীবাড়ী, লৌহজং, সিরাজদিখান ও শ্রীনগরেও ভাষা আন্দোলনের সময় মিছিল, সভা-সমাবেশ করা হয়েছে অনেক। মুন্সীগঞ্জের সন্তানরা বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভ‚মিকা পালন করেন। এদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. একিউএম বি করিম। ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি ছিলেন ফজলুল হক মুসলিম হলের হাউস টিউটর। তিনি ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন এবং মুন্সীগঞ্জের আন্দোলনকারীদের সার্বিক সহযোগিতা করেন।
ভাষা আন্দোলনে মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার সন্তান প্রখ্যাত সাংবাদিক শফিউদ্দিন আহম্মেদ (শফি)-এর অবদানও বিশেষভাবে স্মরণীয়। তিনি বঙ্গ-ভারতের লোকেরা শফি সাংবাদিক নামেই বেশি পরিচিত। ১৯৫২ সালে শফিউদ্দিন আহমেদ ছিলেন জগন্নাথ কলেজের জিএস। তার নেতৃত্বে জগন্নাথ কলেজের ছাত্র-শিক্ষকরা পুরান ঢাকায় মাতৃভাষা আন্দোলন বেগবান করে তোলেন। ঢাকার বিভিন্ন সভা-সমাবেশে ভাষা আন্দোলনের স্বপক্ষে বক্তৃতা করেন। ভাষা আন্দোলনের জন্য ঢাকার ফজলুল হক হল হতে ১৯৫৪ সালে গ্রেফতার হয়েছিলেন মুন্সীগঞ্জের সন্তান আফজাল হোসেন ভ‚ঁইয়া। ভাষা আন্দোলনের জন্য তিনি একমাস ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক থাকেন। বর্তমানে তিনি মুন্সীগঞ্জ হরেন্দ্র লাল পাবলিক লাইব্রেরির সাধারণ সম্পাদক।
প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রফেসর ড. ইয়াজউদ্দীন আহমদও ভাষা সৈনিক ছিলেন এবং সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। আফজাল হোসেন ভ‚ঁইয়া আরো বলেন আব্দুল মতিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের ভিপি ছিলেন। ১৯৫-১৯৫৪ সাল পর্যন্ত ভাষা আন্দোলনের তার ছিল দুর্দান্ত অংশগ্রহণ। তার গ্রামের বাড়ি টঙ্গীবাড়ীর স্বর্ণগ্রাম। ভাষা আন্দোলনে মুন্সীগঞ্জের দু’জন মহিলার নাম জানা যায়। এরা হলেন দু’বোন ফরিদা ইয়াসমিন ও মমতাজ বেগম। তাদের এক ভাই আশরাফ-উ-দৌলা। তারা মধ্য কোর্টগাঁও- এ ভাড়া থাকতেন। মজনু সরকার শহরের কোর্টগাঁও গ্রামের সন্তান। ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন মঞ্চে তিনি সংগীত পরিবেশন করতেন। ভাষা আন্দোলনে কারাবরণকারীদের মধ্যে মুন্সীগঞ্জ সদরের বড় কেওয়ার গ্রামের এডভোকেট মোতাহার হোসেন চৌধুরী ও অধ্যাপক সাহাব উদ্দিন হিরু অন্যতম। মোতাহার হোসেন চৌধুরী ১৫ ফেব্রæয়ারি ’৫২ সালে মিছিল করার সময় আহত ও গ্রেফতার হন। ব্যাংক কর্মকর্তা লুৎফর রহমান ও একেএম খোরশেদ ভাষা আন্দোলনের সময় সক্রিয় ভ‚মিকা পালন করেন।
শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন বাংলাদেশের প্রাক্তন উপ-প্রধানমন্ত্রী। তিনি ঢাকার সেন্ট গ্রেগরী স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র থাকা অবস্থায় ভাষা আন্দোলনে অংশ নেন এবং জীবনের প্রথম গ্রেফতার হন। আরো একজন প্রবীণ রাজনৈতিক নেতা, মন্ত্রী গ্রেফতার হয়েছিলেন তিনি হলেন কোরবান আলী। তিনি মুন্সীগঞ্জের লৌহজং এলাকার সন্তান। আব্দুল করিম বেপারী, রিকাবী বাজারের সন্তান। তিনিও ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন এবং ছাত্রদের উৎসাহ দিতেন। কামরুদ্দিন আহমেদ ষোলঘর এলাকার সাহসী এক নাম। তিনি ঢাকার আরমানিটোলা স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। মো. আব্দুল হাই মাস্টার ভাষা আন্দোলনের সময় ঢাকা বিশ্ববদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। ভাষা আন্দোলনের সময় সক্রিয় অংশগ্রহণের কারণে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। সে কারণে তিনি আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করতে পারেননি। ভাষার দাবিতে ’৫২ সালে ঢাকার রাজপথে মিছিল করেন। আজিজুল হক খান লৌহজং নাগের হাটের লোক। তিনি ঢাকা কলেজের ছাত্র নেতা। ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।
মুন্সীগগেঞ্জর সন্তান যারা ভাষা আন্দোলনে ঢাকায় অংশগ্রহণ করেন এদের মধ্যে মো. মোশারফ হোসেন শ্রীনগরের পশ্চিম মুন্সিয়া গ্রামের সন্তান, লৌহজং মেদিনীমÐলের আব্দুর রশিদ মিয়া। যিনি ভাষা আন্দোলনের সময় গ্রেফতার ও কারাবরণ করেন। হাওলাদার নুরুল ইসলাম গ্রামের বাড়ির শ্রীনগর দোগাছি। তিনি ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে সরকারি চাকরি ছেড়ে দেন। তিনি সরকারি কলেজের অধ্যাপক ছিলেন। ভাষা আন্দোলনে মুন্সীগঞ্জ শ্রীপল্লীর আব্দুন নূর ১৯৫৫ সালে গ্রেফতার হয়েছিলেন। ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত ভাষার জন্য মুন্সীগঞ্জে অনেক আন্দোলন, সভা সমাবেশ হয়। এ পর্যন্ত সে সকল তথ্য পাওয়া যায়। তা হল : ৩ মার্চ ১৯৪৮ সালে মুন্সীগঞ্জের স্কুলসমূহে হরতাল ও বিক্ষোভ হয়। শ্রীনাথ ক্লাব মাঠে মিটিং হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক আমির হোসেন। বক্তব্য রাখেন মিনহাজ উদ্দিন মৃধা, দুদু মিয়া, সত্য রঞ্চন বসু ও মোহিত লাল চ্যাটার্জী। ১৯৫২ সালের ২৮ ফেব্রæয়ারি মুন্সীগঞ্জে ভাষা আন্দোলনের শহীদদের শ্রদ্ধা জানিয়ে একটি প্রতিবাদ সভা হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন এসাক চাকলাদার। তথ্য ও ইতিহাস সংরক্ষণের অভাবে অনেক ভাষা সৈনিকের নাম পাওয়া যায়নি। কিন্তু তাদের নাম সংরক্ষণ করা যে অতি জরুরি। অন্যথায় হারিয়ে যাবে ইতিহাসের একটি অধ্যায়।
লেখক : সাংবাদিক ও ইতিহাস গবেষক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন