আল ফাতাহ মামুন : ছোটবেলার কথা। ভাত খেতে চাইতাম না বা পড়তে বসতাম না অথবা অসময়ে বাইরে বেরুব- এমন সব অপরাধের জন্য মা কোনো শাস্তি দিতেন না। শুধু বলতেন, এটা করো, না হয় ছেলে ধরা এসে নিয়ে যাবে। ব্যস! অসাধ্যও সাধন করে ফেলতাম ছেলে ধরার ভয়ে। ছেলে ধরা দেখিনি কখনো। শুধু এইটুকু জানতাম, ওরা ছোটদের ধরে নিয়ে যায়। মাথা কেটে নদীতে ফেলে দেয়। ছোটবেলার সেই ছেলে ধরার গল্প এখন আর গল্প নেই। গেল শনিবার ১১ ফেব্রæয়ারির সংবাদপত্রে চোখ বুলাতেই আঁতকে ওঠলাম। এ কী দেখছি? ছোটবেলায় যে গল্প শুনে ভয়ে জড়সড় হয়ে থাকতাম আজ তাই সত্যি হয়ে ওঠে এসেছে খবরের পাতায়! এও কী সম্ভব! কোমলমতি শিশুদের অপহরণের পর তাদের পেট কেটে, দেহ থেকে মাথা আলাদা করে ভাসিয়ে দেওয়া হয় বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা নদীতে। টাকার জন্য মানুষ কী না করতে পারে ভাবতেই গা শিউরে ওঠে।
৯ ফেব্রæয়ারি বৃহস্পতিবার ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ থেকে আন্তর্জাতিক পাচার চক্রের ৬ সদস্যকে গ্রেফতার করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটলিয়ন টিম। গ্রেফতাকৃতদের মধ্যে চারজন পুরুষ, দু’জন নারী। পুরুষ চারজন হলেন, জাকির হোসেন (দলনেতা), মোহাম্মদ হোসেন সাগর ওরফে বেলু ওরফে দেলু, টিটু ও আসলাম আল আমিন। নারী দুজন, জাকিরের স্ত্রী মর্জিনা বেগম ওরফে বানেছা ও জেসমিন বেগম। গ্রেফতারের সময় তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় তিন রাউন্ড গুলি, একটি ম্যাগাজিনসহ একটি পিস্তল, দুটি চাকু, একটি চাপাতি, ১ হাজার ২০ পিস ইয়াবা, অপহৃত শিশুদের অজ্ঞান করার জন্য ব্যবহৃত ২৫টি চেতনানাশক ইনজেকশন, ১৪টি সিরিঞ্জ ও ১৭টি মোবাইল ফোন সেট। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃতরা স্বীকার করেছে, তারা সংঘবদ্ধ শিশু অপহরণ ও পাচারকারী সিন্ডিকেটের সদস্য। শিশু অপহরণের উদ্দেশ্যে যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, নারায়ণগঞ্জ, চিটাগং রোডের বিভিন্ন বাসস্ট্যান্ড, কমলাপুর রেলস্টেশন এবং ঢাকা সদরঘাট এলাকায় এরা ছদ্মবেশে মাইক্রোবাসে ঘুরে বেড়ান। সুযোগ বুঝে জনসমাগম এলাকায় কোনো শিশু পরিবার থেকে সামান্য বিচ্ছিন্ন হতে দেখলেই সেই শিশুকে ছো মেরে মাইক্রোবাসে তুলে নেন। মুহূর্তেই ওই শিশুর শরীরে চেতনানাশক ওষুধ প্রয়োগ করলে অজ্ঞান হয়ে পড়ে শিশুটি। পরে তাদের আস্তানায় নিয়ে ওই শিশুকে জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায় করেন। আবার অনেক শিশুর পাসপোর্ট করে অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে কিংবা শিশুকে নানা ধরনের ভয়ভীতি দেখিয়ে পাচারের জন্য বিদেশে নিয়ে যান। প্রতি শিশুর জন্য তারা ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা পান বলে জানিয়েছেন অপহরণকারীর সদস্যরা।
গত ২৭ ডিসেম্বর অপহরণকারীরা নারায়ণগঞ্জের বন্দর এলাকায় অবস্থান করছিল। উদ্দেশ্য সুযোগ বুঝে কোনো শিশুকে গাড়িতে তোলা। ওই সময় বাড়ির সামনের রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করছিল আট বছরের শিশু বায়েজিদ। অপহরণকারীদের টার্গেট বায়েজিদকে গাড়িতে তোলা। প্রশিক্ষিত সদস্যরা বায়েজিদের মুখে চেতনানাশক দ্রব্যমিশ্রিত রুমাল চেপে ধরে গাড়িতে উঠিয়ে নেয়। পরে বায়েজিদকে নিয়ে যায় গ্রেফতারকৃত জাকিরের সিদ্ধিরগঞ্জ নিমাই কাশারীর বাড়িতে। এরপর অপহরণকারীরা তার পরিবারের কাছে ৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে বলে, মুক্তিপণ না দিলে ওই শিশুকে মেরে ফেলা হবে। একপর্যায়ে ৮ জানুয়ারি তার বাবা ডালিম বন্দর থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। নম্বর-৩৭১। একই সঙ্গে এ বিষয়টি র্যাব-১১-কে জানান তিনি। সর্বশেষ ৭ ফেব্রæয়ারি র্যাবের একাধিক টিম রাজধানীর সায়েদাবাদ, চিটাগং রোড এবং নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থেকে অপহরণকারী চক্রের দলনেতা জাকির হোসেনসহ ছয়জনকে গ্রেফতার করে। উদ্ধার হওয়ার আগ পর্যন্ত বায়েজিদকে জাকিরের বাড়িতেই চেতনানাশক ওষুধ দিয়ে রাখা হতো। র্যাব-১১-এর অধিনায় লে. কর্নেল কামরুল হাসান একটি জাতীয় দৈনিককে বলেন, ‘এরা সত্যিই পাষাÐ। এ চক্রের ২০ থেকে ২৫ জন সদস্য রয়েছেন। গত দুই বছরে ১৭ জনকে অপহরণ করেছেন বলে তারা জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন। এরমধ্যে দুই শিশুকে খুন করে নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছেন। মুক্তিপণ নিয়ে আট শিশুকে ছেড়ে দিয়েছেন। ছয়জনকে বিদেশে পাচার করেছেন।’
জানা গেছে, অপহরণের পর কখনো কখনো মুক্তিপণ দেওয়ার পরও ভিকটিমকে হস্তান্তরের সময় ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে তারা শিশুদের হত্যা করে লাশ গুম করে ফেলতো। সাইনবোর্ড থেকে অপহৃত শিশু আকাশ এবং নারায়ণগঞ্জের ভুলতা থেকে অপহৃত শিশু নাজমুলকে পেট কেটে ইটের বস্তায় করে শীতলক্ষ্যা নদীতে ভাসিয়ে দেওয়ার কথা ইতোমধ্যেই স্বীকার করেছেন গ্রেফতারকৃতরা। তারা বলেছে, ওই দুই শিশুর শরীরে অতিরিক্ত মাত্রায় চেতনানাশক ওষুধ প্রয়োগের কারণে তাদের জ্ঞান ফিরছিল না। ধরা পড়ার ভয়ে তারা শিশু দুটির পেট কেটে কাঁচপুর ব্রিজসংলগ্ন শীতলক্ষ্যা নদীতে ফেলে দেয়। র্যাব সূত্র বলছে, এ চক্রটি অপহৃত শিশুদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিক্রির ব্যবসার সঙ্গেও জড়িত রয়েছে বলে তাদের কাছে তথ্য এসেছে। সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য ওমানে অবস্থানকারী শাহাবুদ্দিনের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে তারা শিশু পাচার করে। এজন্য শাহাবুদ্দিনের বিশ্বস্ত মনির, জহির ও জেসমিনের কাছে শিশুদের হস্তান্তর করা হয়। এ চক্রের সদস্যরা সাধারণত নিজেদের পরিচিত ও আত্মীয়-স্বজনকেই দলে ভেড়ায়। তারা জল-স্থলসহ বিভিন্ন রুটে যাত্রীবেশে শিশুদের অপহরণ করে।
অপহরণ থেকে শিশুদের রক্ষা করতে অভিভাবকেদের আরো বেশি সচেতন হতে হবে। অপহরণকারীরা বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে অপহরণ করে থাকে। কয়েক বছর আগের পত্রিকা ঘেটে দৈনিক প্রথম আলোর একটি নিউজ দেখলাম। সেখানে বলা হয়েছে, অপহরণকারী অতিথি সেজে শিশু অপহরণ করেছে। মা কিংবা বাবাকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে শিশু অপহরণের একাধিক সংবাদও চোখে পড়েছে। তাই অপরিচিত কাউকে বিশ্বাসের ক্ষেত্রে খুবই সতর্ক থাকতে হবে। একটি নাটকে দেখেছি, শিশু অপহরণ করার জন্য অপহরণকারী দীর্ঘদিন বিভিন্ন উপায়ে পরিবারের বিশ্বাস অর্জন করে। একটা সময় পরিবারের লোকেরা ওই ছদ্মবেশীকে বিশ্বাস করে। এভাবে ঘাতক শিশুকে অপহরণ করার সুযোগ পেয়ে যায়। অপহরণকারী অনেক সময় ফেরিওয়ালা সেজেও শিশু অপহরণ করে থাকে। বিভিন্ন ধরনের খেলনা দেখিয়ে শিশুদের আকৃষ্ট করে আর সুযোগ বুঝে সে বা তার দলের সদস্যরা আপনার আদরের সন্তানকে অপহরণ করে ফেলে। তথ্য-প্রযুক্তির যুগে যেকোন অপরাধ এখন সহজ থেকে আরো সহজ হয়ে গেছে। কঠিন হয়ে পড়েছে মানুষের নিরাপত্তা। বয়স্করা যেখানে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন সেখানে শিশুদের নিরাপত্তার দুর্গ কতটা দুর্বল তা সাধারণ মানুষের বোধগম্যের বাইরে। এ অবস্থায় সরকার এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর পদক্ষেপই রোধ করতে পারে শিশু অপহরণকারীদের দৌরাত্ম্য।
গত বছরের ফেব্রæয়ারি মাসে দৈনিক কালের কণ্ঠ শিশু অপহরণ রোধে করণীয় বিষয়ে পাঠকদের বাছাই করা মন্তব্য প্রকাশ করে। সেখান থেকে দুটি মন্তব্য হুবহু তুলে দিয়েই শেষ করছি আজকের লেখা। মুন্সীগঞ্জ জেলার তালতলা বাজার থেকে শেখ মুহাম্মাদ আলী লেখেন- ‘শিশু অপহরণ ও হত্যা বেড়ে যাওয়ায় আমরা অভিভাবকরা খুবই উদ্বিগ্ন। যে পরিবারের শিশু হারিয়ে যায় সেই পরিবারই বোঝে এর কী জ্বালা। শিশু অপহরণ, শিশু নির্যাতন বা শিশুহত্যা সবই সমাজের অবক্ষয়ের চিত্র ধারণ করে। এর আগে শিশু অপহরণ বা শিশু নির্যাতনকারীদের অনেকে ধরা পড়লেও তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হয়নি। অপরাধীরা ক্ষমতার জোর বা অর্থ দিয়ে বের হয়ে এসেছে। পরবর্তী সময় তারাই আবার এসব অপরাধের সঙ্গে জড়িত হয়েছে। তাই প্রথমেই দরকার অপরাধীদের চিহ্নিত করা এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া। সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদিচ্ছা এ ক্ষেত্রে একান্ত কাম্য।’ পিরোজপুর জেলার ভাইজোড়া থেকে নাদিম খান লেখেন- ‘শিশু অপহরণকারীরা মূলত সন্ত্রাসী ও বড় ধরনের পাচারকারীদের সঙ্গে জড়িত। প্রতিটি জেলায় একজন বা একাধিক গডফাদার আছে, যারা এসব অপরাধ করে থাকে। এসব গডফাদারকে প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও এমপি বা মন্ত্রীরা চিনবেন না তা হতে পারে না। তাই অপরাধ নির্মূল করতে প্রথমে প্রশাসনকে সক্রিয় হতে হবে।’
লেখক : শিক্ষার্থী, ডিপ্লোমা ইন অ্যারাবিক ল্যাঙ্গুয়েজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন