বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

আদিগন্ত

অযৌক্তিক ধর্মঘট এবং আদালত অবমাননা

| প্রকাশের সময় : ৪ মার্চ, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মীর আব্দুল আলীম : আমাদের সড়ক-মহাসড়কে প্রতিদিন হরেদরে মানুষ মরছে। এর প্রতিকার নেই। আইন থাকলেও প্রয়োগ নেই। প্রয়োগ করতে গেলে ধর্মঘট আন্দোলন হয়। সম্প্রতিকালে দুই খুনি চালককে বাঁচাতে দেশব্যাপী যে আন্দোলন হয়েছে, সে আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নাকি হয় এক মন্ত্রীর বাসায়। আজ (যেদিন লিখছি ১ মার্চ) দৈনিক প্রথম আলোর প্রধান শিরোনামতো এমনই- ‘মন্ত্রীর বাসায় ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত!’ এইতো সাধের বাংলাদেশ! বাহ্! কি দেশে বাস করি যে দেশে খুনিদের বাঁচাতে আদালতের বিরুদ্ধে ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত হয় মন্ত্রীর বাসায়। অপরাধী পরিবহন দুই শ্রমিককে সাজা দেয়ায়ই এ ধর্মঘট ডাকা হয়। এমন ঘটনায় দেশের দৃশ্যমান উন্নয়ন আর সমৃদ্ধির বিষয়টি ¤øান করবে বৈকি!
আমরা বরাবরই দেখছি, দেশের পরিবহন ক্ষেত্রে সীমাহীন নৈরাজ্য চলে আসছে। এ সেক্টরটিতে সবচেয়ে কম আইন মানার প্রবণতা রয়েছে। এরা অপরাধ করলেও আন্দোলন করে পার পেয়ে যায়। তাই এ সেক্টরে অপরাধ করেও আইনের ঊর্ধ্বে থাকার প্রবণতা বাড়ছে। তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরকে বহনকারী মাইক্রোবাসকে চাপা দেয়া বাসচালক জামির হোসেনের যাবজ্জীবন সাজার বিরুদ্ধে অনির্দিষ্টকালের পরিবহন ধর্মঘট ডাকা হয়েছিল দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১০ জেলায়। ধর্মঘটটি প্রত্যাহার করা হলেও অযৌক্তিক এ ধর্মঘটে কেবল ওই অঞ্চলের মানুষ ভোগান্তিতে পড়েছিলেন তাই নয়, এ ধর্মঘট আদালত অবমাননারও শামিল। সরকারের মন্ত্রী যেভাবে কান্ডজ্ঞানহীন বক্তব্য দিয়েছেন, যেভাবে আদালতের রায়ের প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন, তাতে করেই শ্রমিকরা রুদ্রমূর্তি ধারণ করার সাহস পেয়েছে। সরকারের আশ্রয়-প্রশ্রয়েই তারা প্রশাসনের নাকের ডগায় জনগণকে জিম্মি করে চরমভাবে নাজেহাল করেছে। এ দায়ভার কার?
যাত্রীদের জিম্মি করে তবেই আদালতের রায় বদলানোর কৌশল নেয় পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলো। এটা তারা বরাবরই করে থাকে। কষ্টটা এখানেই এবার এই কৌশল বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নাকি আসে সরকারের একজন মন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে বসে। আর এই সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়ায় সরাসরি জড়িত একজন মন্ত্রী, একজন প্রতিমন্ত্রী এবং সরকার-সমর্থক পরিবহনমালিক-শ্রমিক সংগঠনের নেতারা! আকস্মিক এই ঘোষণার শিকার হয় সাধারণ মানুষ। নৌমন্ত্রীর এ ধর্মঘটে জড়িত থাকার বিষয়টি চাউড় হওয়ার পর দেশজুড়ে হৈচৈ শুরু হয়। পরিবহন ধর্মঘটে সমর্থন দেওয়ার কারণে নৌ পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানকে মন্ত্রীপদ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে। স্মারকরিপিতে বলা হয়, নৌমন্ত্রী মন্ত্রী হয়েও এরকম একটি অবৈধ ধর্মঘটে সমর্থন দিয়েছেন এবং ধর্মঘটকে প্রভাবিত করেছেন। প্রশ্ন রাখা হয়, কী করে সরকারের একজন মন্ত্রীর বাসায় এই ধর্মঘট নিয়ে বৈঠক হয়েছে? মন্ত্রিপরিষদে থাকা অবস্থায় এ রকম একটি অবৈধ ধর্মঘটে সমর্থন দেওয়া সংবিধান পরিপন্থী। শুধু তাই নয়, মন্ত্রী হিসেবে তিনি যে শপথ নিয়েছেন, এটি তারও পরিপন্থি। তাই নৌমন্ত্রীকে মন্ত্রীর পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার জন্য স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে।
আমরা কী দেখেছি? অযৌক্তিক ধর্মঘটের মাধ্যমে আদালতের রায়ের প্রতি অসম্মান দেখানো হয়েছে। আদালতের যে কোনো রায়ের বিরুদ্ধে বাদী-বিবাদী বা যে কেউ সংক্ষুব্ধ হলে উচ্চ আদালতে যেতে পারেন। এটা তার অধিকার। তিনি প্রতিকার চাইতে পারেন; কিন্তু রায়ের বিরুদ্ধে ঘোষণা দিয়ে ধর্মঘট কিছুতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তাছাড়া যে দাবিতে এ ধর্মঘট ডাকা হয়েছিল, তা নৈতিকভাবেও সমর্থনযোগ্য নয়। নিজের স্বার্থের বিরুদ্ধে গেলেই সংঘবদ্ধ পেশাজীবী থেকে শুরু করে রাজনৈতিক দলগুলো সাধারণ মানুষকে জিম্মি করার অসুস্থ প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠেন, এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এ অপসংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজতে হবে সবাইকে। আমরা বরাবরই দেখে আসছি, পরিবহন খাতের লোকেরা দেশের ট্রাফিক সংক্রান্ত আইনগুলো ও আদালতের রায় মানতে চাচ্ছেন না। একাধিক আইন ভঙ্গ করে বেপরোয়া গতিতে বাস চালিয়ে ২০১১ সালে দুর্ঘটনায় চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদসহ পাঁচ ব্যক্তির মৃত্যুর কারণ হওয়ার অপরাধে এক বাসচালকের যাবজ্জীবন কারাদÐাদেশের প্রতিবাদে পরিবহন শ্রমিক-মালিকরা যে অরাজকতা সৃষ্টি করে তার মোটেও যৌক্তিকতা নেই।
এছাড়া সাভারের মামলাটি কোনোভাবেই সড়ক দুর্ঘটনা নয়। ২০০৩ সালে একজনের ব্যক্তিগত জমির ওপর দিয়ে ট্রাকে মাটি নিতে নিষেধ করায় ট্রাকচালক হুমকি দিয়ে পথরোধকারী এক নারীকে চাকার নিচে পিষে মারে। এই খুনের কি কোন বিচার হবে না? আদালত যথাযথ বিচার করেছে। তাহলে খুনির পক্ষ নিয়ে ধর্মঘটের হেতু কী? আর এমন ধর্মঘটের সাথে যারা যুক্ত তাদের দেশের শৃঙ্খলা ভঙ্গ এবং আদালত অবমাননার দায়ে সাজা দেয়া উচিৎ বলেও মনে করি। এরা তথ্য-বিভ্রান্তি ঘটিয়ে সাধারণ শ্রমিকদের খেপিয়ে তোলে। এতে বিনা নোটিশে বেআইনি ধর্মঘট করায় দেশের মানুষকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। সরকারের মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য পর্যায়ের ব্যক্তিরা শ্রমিকদের নৈরাজ্য সৃষ্টিতে উসকানি দিয়েছেন বলে স্পষ্ট হওয়ার বিষয়টি আমাদের ব্যথিত করে বৈকি।
সারাদেশেতো সড়ক দুর্ঘটনার মড়ক লেগেছে। কথাটা আমার নয়, এটি একটি জাতীয় পত্রিকায় হেডলাইন হয়েছে। ১৭ ফেব্রæয়ারি থেকে ১ মার্চ পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনায় ১৭ দিনে আমাদের সড়ক কেড়ে নিয়েছে ১৮১ তাজাপ্রাণ। আহত হয়েছেন আরো শতাধিক ব্যক্তি। রাস্তায় মানুষের জীবন বদ হবার এই পরিসংখ্যানটি আমাদের আতঙ্কিত করে বৈকি! প্রশ্ন হলো, এভাবেই কি দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলোতে মানুষের মৃত্যুর বিভীষিকা চলতেই থাকবে? এখানেই শেষ নয়। সড়ক দুর্ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেই রাস্তায় নামে পরিবহন শ্রমিকরা। অপরাধ করবে আর সাজা দেয়া যাবে না তা কী করে হয়? সরকার জঙ্গিদমন করতে পারঙ্গম কিন্তু পরিবহন সেক্টরে অসহায় কেন? প্রায় ক্ষেত্রেই পরিবহন শ্রমিকদের অন্যায় দাবিদাওয়া মেনে নিতে দেখি। এবারও হয়তো তাই হবে। সেই আলেঅচিত নৌমন্ত্রীর ডাকে শ্রমিকরা ধর্মঘট প্রতাহার করে নিয়েছে। তাদের আশ্বস্থ করার পরই নাকি ধর্মঘট প্রত্যাহার হয়। এবারও হয়তো কোন রফাদফা হলো!
সচরাচর সড়ক দুর্ঘটনার বিষয়ে সাজা খুব কমই হয়। তারেক মাসুদ এবং মিশুক মনিরের নিহত হওয়ার ঘটনাটি আলোচিত ছিলো বিধায় হয়তো মামলাটি সঠিক গতিতে এগিয়েছে। এবং অভিযুক্ত ড্রাইভারের সাজা হয়েছে। আর তাতেই এতো কিছু! দেশে জঙ্গীরা এ যাবত হাতে গোনা গুটি কয়েক প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। কিন্তু তারাও রক্ষা পায়নি। সরকার জঙ্গীদের দমনে বেশ সক্ষমতা দেখিয়েছে। দেশবাসীও তাতে খুশি। কিন্তু জঙ্গীরা সব মিলিয়ে যত প্রাণ হরণ করেছে আমাদের সড়কে মহাসড়ক গত ১৭দিনেই তার চেয়ে বেশি প্রাণ গেছে। দুর্ঘটনায় প্রতিদিনই মানুষের অস্বাভাবিক মৃত্যু হচ্ছে।
আমরা এমন ঘটনার পর সরকারে নিষ্ক্রিয়তা আশা করি না। মন্ত্রীর বাসায় বৈঠকের পর ধর্মঘট আর দেশ জুড়ে এমন নৈরাজ্যে সরকারের কঠোর হওয়া প্রয়োজন ছিলো। দেশে দৃশ্যমান উন্নয়ন এবং অগ্রগতি চোখে পরারর মতো। নানা সেক্টরেই সরকার সক্ষমতা দেখাচ্ছে। তাই পরিবহন ধর্মঘটের বিষয়টিতে সরকারের সক্রিয়তা আশা করেছিলাম। সরকারের নিষ্ক্রিয়তার পটভূমিতে একজন মানবাধিকার আইনজীবী রিট করলে হাইকোর্ট ১ মার্চ দুপুরে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যান চলাচল শুরুর নির্দেশ দেন ও আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হরতাল-ধর্মঘট কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না, সে মর্মে সরকারের জবাব চেয়ে রুল জারি করেন। এটি কেন একজন দেশের নাগরিককে করতে হলো? দেশের একজন সাধারণ মানুষকে শাসন ও আইন-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত একটি সাধারণ বিষয়ে আদালতের দ্বারস্থ হতে হবে কেন? এটাতো সরকারেরই করার কথা। আমারা স্পষ্টতই দেখেছি, নৌমন্ত্রী যান চালানোর আহŸান জানানোর পরই যানচলাচল চলাচল স্বাভাবিক হতে থাকে। তাহলে, এর আগে যে তাÐব হয়ে গেল তার দায় কার?
তারেক-মিশুককে বহনকারী মাইক্রোবাসকে ধাক্কা দেয়ার সময় তিনি ঘুমের ঝোঁকে ছিলেন, এমনকি তার বৈধ ড্রাইভিং লাইসেন্সও ছিল না। আমরা কি অস্বীকার করতে পারি, ওই বাসচালক দোষী নয়? বিনা দেষো তাকে আদালত তার সাজা সাব্যস্থ করেছে? দোষী ব্যক্তিই সাজা পেয়েছেন। অথচ পরিবহন শ্রমিক সংগঠনগুলো রায়ের বিরুদ্ধে ধর্মঘট শুরু করে দেয়। রাষ্ট্রের সব সুযোগ-সুবিধা নিয়ে এরা দেশের আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে ধর্মঘট করার স্পর্ধা দেখায় কী করে? রায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে আদালত অবমাননা এবং ধর্মঘটের মতো ক্ষতিকর প্রতিবাদের পথ বেছে নেয়ায় পরিবহন শ্রমিক সংগঠনটির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। এদের যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। অন্যথায় দেশের মানুষকে জিম্মি করে অবৈধ সুবিধা আদায়ের সংস্কৃতি চলতেই থাকবে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন