শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আদিগন্ত

উপমহাদেশের মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন

| প্রকাশের সময় : ১১ মার্চ, ২০১৭, ১২:০০ এএম

এ কে এম শাহাবুদ্দিন জহর : একজন বৃদ্ধ লোক ও তার পাঁচ ছেলের গল্প আমরা সবাই জানি। ছেলেরা সারাক্ষণ ঝগড়াবিবাদে লিপ্ত থাকত। কোনো উপদেশে কাজ না হওয়ায় অবশেষে বৃদ্ধ তার পাঁচ সন্তানকে এক সাথে ডাকলেন। তিনি পাঁচটি কঞ্চি নিয়ে একটি আঁটি তৈরি করে উক্ত আঁটি ভাঙার জন্য ছেলেদের নির্দেশ দিলেন। পাঁচ ছেলের সবাই আঁটি ভাঙার জন্য একে একে চেষ্টা করল। কিন্তু কেউই তা ভাঙতে পারল না। তখন বৃদ্ধ আঁটি খুলে দিয়ে কঞ্চিগুলো আলাদা আলাদা ভাঙতে নির্দেশ দিলেন। ছেলেরা অনায়াসে কঞ্চিগুলো ভেঙে ফেলল। তখন বৃদ্ধ বললেন, ‘তোমরা যদি একত্রে থাক, তোমাদের কেউই ভাঙতে অর্থাৎ ক্ষতি করতে পারবে না। কিন্তু আলাদা আলাদা হয়ে থাকলে যে কেউ এই কঞ্চিগুলোর মতো তোমাদের সবাইকে ভেঙে ফেলতে পারবে।’ গল্পটি যেমন পরিবারের জন্য প্রযোজ্য, তেমনি প্রযোজ্য জাতিসত্তার জন্যও।
আমরা যদি সমগ্র উপমহাদেশের মুসলমানদের একক জাতি হিসেবে গণ্য করি, তবে দেখতে পাব যে এই জাতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নানা শাখায় বিভক্ত হয়ে পড়েছে এবং বিভক্তির অনিবার্য পরিণতিতে হচ্ছে নানাভাবে দলিত, নিগৃহীত এবং অপমানিত। তাই তো দেখতে পাই ভারত বাংলাদেশের নদ-নদীগুলোকে শুষ্ক মৌসুমে পানিশূন্য করে এবং বন্যার সময়ে অতি-প্লাবিত করে দিয়ে তাদের ভাগাড় করে রেখেছে। পাকিস্তানের সিন্ধু ও সিন্ধুর উপনদীগুলোর ওপরও তারা হাত বাড়িয়েছে। সারা বিশ্বের অধিকাংশ মানুষের আপত্তি সত্তে¡ও কাশ্মীরকে জোর করে তার অঙ্গ রাজ্য করে রেখেছে। ভারত তার নিজ দেশের মুসলমানদেরকেও হত্যা-নির্যাতনসহ নানা কায়দায় দমন-পীড়ন করে থাকে। তারা মুসলমানদের জীবনের মূল্য গরুর জীবনের মূল্যের চেয়েও গৌণ মনে করে। অন্যদিকে মিয়ানমার রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপরে এমন কোনো নির্যাতন নেই যা প্রয়োগ করছে না। মুসলমানদের ভোটাধিকার, সম্পত্তি-লাভের অধিকার, চাকরি লাভের অধিকারসহ সব অধিকার ছিনিয়ে নেওয়া এবং বিবাহ ও সন্তান লাভের অধিকার সীমিত করে দেওয়ার পরেও রোহিঙ্গাদের হত্যা, ধর্ষণ, গুম, জেলে নিক্ষেপ প্রভৃতি কুকর্ম নিরবচ্ছিন্নভাবে চালিয়ে যাচ্ছে।
উপমহাদেশের মুসলমানদের ওপরে অমুসলিম জাতিসমূহের এই জুলুমের প্রধান কারণ হলো একদিকে মুসলমানদের মধ্যকার অনৈক্য এবং অন্যদিকে বিজাতীয়দের ঐক্যবদ্ধতা এবং একই পতাকার নিচে সমবেত থাকা। ধর্ম যদি তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ না করত তবে ভারত তার নানা ভাষার ওপর ভিত্তি করে বেশ কিছু রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে পড়ত। শুধু ভাষা নয়, ভারতবাসী অর্থাৎ অনার্য, দ্রাবিড়, মঙ্গোলীয় প্রভৃতি বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীতেও বিভক্ত। বাংলা, আসাম, তামিলনাড়–, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা, কর্ণাটক, কেরালা প্রভৃতি অঙ্গরাজ্যগুলো ভারতের মূল ভূখÐ থেকে যেমন দূরে, তেমনি তাদের রয়েছে নিজস্ব সুসমৃদ্ধ এবং হিন্দি ভাষা থেকে পুরোপুরি বৈসাদৃশ্যপূর্ণ ভাষাসমূহ। তবু তারা হিন্দিকেই রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে মেনে নিয়ে হিন্দির চর্চা করছে। তাদের ঐক্যবদ্ধ থাকার ভিত্তি হলো ধর্ম- হিন্দু বা সনাতন ধর্ম। হিন্দুদের মধ্যে একতার মনোভাব এত বেশি তীব্র যে, তারা জম্মু ও কাশ্মীরে সংখ্যালঘু হওয়া সত্তে¡ও রাজ্য সরকারের শরিক হিসেবে হিন্দুত্ববাদী বিজেপিকে দাঁড় করাতে পেরেছে। আসামে হিন্দুদের সংখ্যা ৬০ শতাংশ হওয়া সত্তে¡ও তারা মুসলিম, খ্রিস্টান ও ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদীদের হটিয়ে বিজেপিকেই রাজ্যে ক্ষমতাসীন করেছে।
ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিশ্বের বহু সংখ্যালঘু জাতি বা ক্ষুদ্র গোষ্ঠী সা¤্রাজ্য স্থাপন করে গেছে। ভারত উপমহাদেশে শিখদের সংখ্যা ২ শতাংশেরও কম। তারপরেও তারা তাদের মধ্যকার একতার কারণে ব্রিটিশ-পূর্ব সময়ে ভারতের একটি বিশাল অংশে সা¤্রাজ্য স্থাপন করতে পেরেছিল। ইহুদিরা বিশ্বের এক অতি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী। এরপরেও শুধু ঐক্যবদ্ধতার কারণে তারা বিশ্বের এক পরাক্রমশালী জাতি। ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইলের দাপটে আত্মকলহরত সুবিশাল আরব নাকানি-চুবানি খাচ্ছে। এই ইহুদিরা খ্রিস্টান অধ্যুষিত রাষ্ট্র বিশ্বমোড়ল যুক্তরাষ্ট্রকে নিজেদের অন্যায্য স্বার্থ সিদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে।
অথচ, এই উপমহাদেশের মুসলমানরা নানা মতে বিভক্ত হওয়ার কারণে প্রতিটি অংশই একটি বিশেষ রাষ্ট্র দ্বারা শোষিত, লুণ্ঠিত ও অপমানিত হচ্ছে। এই অত্যাচারী শক্তি আমাদের আত্মকলহ, ক্ষমতার প্রতি লোভ ও পার্থিব সুযোগ-সুবিধা লাভের প্রবল ইচ্ছা থাকার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বিভক্তিকে যেমন ক্রম প্রসার ঘটাচ্ছে তেমনি চালাচ্ছে লুণ্ঠন ও জিঘাংসা। মুঘল ও ব্রিটিশ রাজত্বের মধ্যবর্তী সময়ে হিন্দু মারাঠারা উপমহাদেশের এক বিরাট এলাকা লুণ্ঠনের ক্ষেত্রে পরিণত করেছিল। পরিশেষে মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে মারাঠাদের মোকাবেলা করে এবং আফগানিস্তানের বাদশাহ আহমদ শাহ আবদালীর নেতৃত্বে পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে তাদের পরাজিত করে।
মুসলমানদের এই অঞ্চলে টিকে থাকার জন্য ঐক্যবদ্ধ হওয়া যেখানে জরুরি সেখানে মুসলিম সেন্টিমেন্টকে হতাশ করে দিয়ে আমাদের নেতারা কথিত সেই অশুভ শক্তিটির পদলেহনে ব্যস্ত। আমরা নানা দেশ ও নানা শাখা জাতিতে বিভক্ত হয়ে নিজেদের স্বাধীন ও সার্বভৌম অনুভব করে উল্লাসে মেতে উঠি। অপর পক্ষে প্রবল শক্তিধর প্রতিবেশীটি তার শক্তি ও ক‚টকৌশলের সফল প্রয়োগ দ্বারা আমাদের বিভক্ত করে এবং লুণ্ঠনের ক্ষেত্র বানিয়ে আরও বেশি সুখ বোধ করে। প্রত্যেক ক্রিয়ার সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া থাকে। কিন্তু আমরা এমনি নির্বোধ জাতি যে, শত অত্যাচার সত্তে¡ও আমাদের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়ার মনোভাব জাগ্রত হয় না।
 লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (4)
Abdur Rashid ১১ মার্চ, ২০১৭, ১১:১৩ এএম says : 0
উপমহাদেশে সকল মুসলমানদের মাঝে ঐক্য হওয়া খুব জরূরী,
Total Reply(0)
Monir Chowdhury ১১ মার্চ, ২০১৭, ১১:১৩ এএম says : 0
সময়ের দাবি।
Total Reply(0)
Mohammad Sobahan ১১ মার্চ, ২০১৭, ১১:১৪ এএম says : 0
এটা আরও আগে হওয়া উচিত ছিল ।
Total Reply(0)
md samiul alam ২২ এপ্রিল, ২০১৭, ৬:৩৬ পিএম says : 0
we r now concious
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন