শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

আদিগন্ত

ভারতের সাথে প্রতিরক্ষা চুক্তি নয়

| প্রকাশের সময় : ২৪ মার্চ, ২০১৭, ১২:০০ এএম

আহমেদ জামিল : এ মুহূর্তে বাংলাদেশের রাজনীতির অঙ্গনের অন্যতম আলোচ্য বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশ-ভারত প্রতিরক্ষা চুক্তি। প্রকৃত প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ইতোমধ্যে এই চুক্তির ব্যাপারে প্রবল আপত্তি জানিয়েছে। বিএনপির তরফ হতে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রবিরোধী প্রতিরক্ষা চুক্তি হলে দেশের স্বার্থে জনগণ প্রতিহত করবে। দেশপ্রেমিক বুদ্ধিজীবী এবং সুশীল সমাজের পক্ষ থেকেও চুক্তির বিষয়ে আপত্তি করা হয়েছে। কোনো কোনো প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক ও সচেতন নাগরিক সমাজ মনে করেন, প্রতিরক্ষা চুক্তি কিংবা সমঝোতা স্মারক যাই স্বাক্ষরিত হোক না কেন সেখানে বাংলাদেশের ইচ্ছা বা স্বার্থ নয়, ভারতের একতরফা সামরিক কৌশলগত ইচ্ছা ও স্বার্থই পূরণ করা হবে। বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীকে ভারতের স্বার্থে ব্যবহারের প্রয়াস থাকবে। এক্ষেত্রে ২৫ বছরের বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী চুক্তির কথা স্মরণ করেন অনেকেই।
এ কথা অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা যে, ’৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ চলার সময় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সাথে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সরকারের যে ৭ দফা চুক্তি হয় তাতে বাংলাদেশের নিজস্ব সামরিক বাহিনী না থাকার কথা বলা হয়। বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা নিয়ন্ত্রণ করবে ভারত। শুধু তাই নয়, এই চুক্তিতে বাংলাদেশের উচ্চ পর্যায়ের আমলাতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণও ভারতীয়দের হাতে তুলে দেয়ার কথা বলা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বলিষ্ঠ নেতৃত্বের কারণেই এই ৭ দফা দাসত্বের চুক্তির বাস্তবায়ন হয়নি এবং বাংলাদেশের মাটি থেকে ভারত তার সেনাবাহিনী প্রত্যাহারে বাধ্য হয়।
মনে রাখতে হবে, ’৭১-এ বাংলাদেশের জনগণ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ করেছিল সত্যিকারের স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য। বিপরীতে ভারতের উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানের পূর্বাংশ বিচ্ছিন্ন করে সামরিক দিক দিয়ে পাকিস্তানকে দুর্বল করা এবং ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। সেই সাথে বাংলাদেশকে অঘোষিত উপনিবেশে পরিণত করা। সুতরাং বাংলাদেশের জনগণের মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রত্যাশার সাথে ভারতের শাসকদের স্বার্থগত বৈপরীত্যের বীজ শুরু থেকেই রোপিত হয়েছিল। যা আজ চূড়ান্ত রূপ নিয়েছে। বাংলাদেশের জনগণ এবং এদেশের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী ও আধা সামরিক বিডিআর ভারতের অধীনতামূলক মিত্রতা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে। যে কারণে স্বাধীনতার পর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ফেলে যাওয়া অস্ত্রশস্ত্র ভারতীয় বাহিনী লুটপাট করে ভারতে নিয়ে যাওয়ার সময় স্বাধীন বাংলাদেশের সেনাবাহিনী প্রবলভাবে প্রতিরোধ করেছিল। এক্ষেত্রে বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর জলিলের ঐতিহাসিক ভূমিকার কথা জাতি আজও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে।
বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর দেশাত্মবোধ ও জাতীয়তাবোধ ভারতের শাসকগোষ্ঠী এবং সেদেশের মিলিটারি এস্টাবলিশমেন্টের কখনই পছন্দের ছিল না। যে কারণে ভারতের ইন্ধনে সামরিক বাহিনীর প্যারালাল রক্ষীবাহিনী গঠন করানো হয়। ২৫ ফেব্রুয়ারির পিলখানায় সেনা কর্মকর্তাদের রহস্যজনক হত্যাকা-ের যোগসূত্র সব এক জায়গায়। ইদানীং হঠাৎ করে জঙ্গি হামলা বৃদ্ধির নেপথ্যে ভারতের সাথে প্রতিরক্ষা চুক্তি সম্পাদনের ক্ষেত্র প্রস্তুতের প্রয়াস বলে কারো কারো অভিমত। আর এ কথা অনেকেরই জানা আছে যে, শেখ হাসিনা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর ভারতের সামরিক বাহিনীর এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা মন্তব্য করেছিলেন, এখন থেকে বাংলাদেশকে ভারতের রাডারের বাইরে যেতে দেয়া হবে না। যা হোক, প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, আগামী এপ্রিল মাসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরকালে দুই দেশের মধ্যে সামরিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা। সেই চুক্তির এমওইউ বা সমঝোতা স্মারকের কিছু তথ্য প্রকাশ করেছে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন পত্রিকা ‘দ্যা ইনডিপেন্ডেন্ট’।
বাংলাদেশ-ভারত সম্ভাব্য প্রতিরক্ষা চুক্তিতে যা থাকতে পারে তা হলো ভারতের সাথে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা শিল্প, স্পেস টেকনোলজি, টেকনিক্যাল সহযোগিতা এবং সমুদ্র অবকাঠামো ক্ষেত্রে সহযোগিতা। উভয়েই একে অন্যের দেশে সামরিক প্রতিনিধি দল পাঠানোর বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। উভয় দেশ ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা, সামরিক বিশেষজ্ঞ বিনিময়, ট্রেনার ও পর্যবেক্ষক, সামরিক বিষয়াদি সম্পর্কে তথ্য বিনিময় করবে। সামরিক সরঞ্জাম তদারকি, চিকিৎসা, খেলাধুলার ব্যবস্থা করবে। দুর্যোগ মোকাবেলার ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ ও ত্রাণ ব্যবস্থায় সহযোগিতা করবে। আর্মি, নেভি ও এয়ারফোর্সে স্টাফ পর্যায়ে উভয় দেশ আলোচনার ব্যবস্থা করবে। আলোচনার মাধ্যমে সামরিক বিষয়ে সমস্যার সমাধান করবে। উভয় পক্ষ একই সময়ে সামরিক জাহাজ ও বিমান বাহিনীর সফরের ব্যবস্থা করবে।
আন্তর্জাতিক সীমান্তে যৌথ পাহারা ও নজরদারির ব্যবস্থা করবে। উভয় দেশ যৌথ উদ্যোগে সামরিক শিল্প ক্ষেত্রে সহযোগিতার ব্যবস্থা করবে। উভয় দেশ আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে বিভিন্ন নীতি ও জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ে পরস্পরকে সহযোগিতা করবে। এর সাথে আরো অন্যান্য বিষয় রয়েছে। লক্ষ্যণীয় দিক হলো, এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনী ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় গোপনীয়তা বলে কোনো কিছুই থাকবে না। গোপনীয়তা একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের সামরিক কৌশলেরই অংশ। সর্বোপরি ভারতের একতরফা স্বার্থে চালিত এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে প্রতিরক্ষার দিক থেকে বাংলাদেশকে সম্পূর্ণভাবে ভারতের ওপর নির্ভরশীল করা হবে এবং যা দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করবে। আর এই চুক্তি বাস্তবায়িত হলে চীন ও পাকিস্তানের মতো ভারতের জানি দুশমনের সাথে ভারতের যদি কোনো যুদ্ধ বাঁধে চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশকেও তাতে জড়িয়ে পড়তে হবে।
প্রতিপক্ষের পাল্টা আঘাত ভারতের মধ্যে শুধু সীমাবদ্ধ থাকবে না, বাংলাদেশের ওপরও পড়বে। ভারতের স্বার্থে বাংলাদেশ কেন তার জাতীয় নিরাপত্তা বিঘিœত করবে এ প্রশ্ন তোলাটা অযৌক্তিক নয় কোনোভাবেই। এতে করে বাংলাদেশের কোনো কোনো মিত্র রাষ্ট্র শত্রুতে পরিণত হতে পারে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের পরীক্ষিত মিত্র চীনের কথা বলা যেতে পারে। আর পাকিস্তান এ মুহূর্তে মুসলিম উম্মাহর সামরিক দিক হতে সবচেয়ে শক্তিধর দেশ। বাংলাদেশও বৃহত্তর এই মুসলিম উম্মাহর অংশ। আর জেনে রাখা উচিত বাংলাদেশে স্বার্থপর প্রতিবেশী ভারতের চেয়ে পাকিস্তানের আর্থিক বিনিয়োগ অনেক বেশি। চীনের মতো পাকিস্তান ও বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন সহযোগী। অন্যদিকে দেশবাসী একথা ভালো করেই জানে যে শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়ন নয়, বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীকে শক্তিশালী ও আধুনিককরণের ক্ষেত্রে গণচীনের বিরাট ভূমিকা রয়েছে।
বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর প্রশিক্ষণ প্রদানের পাশাপাশি স্বল্প মূল্যে অত্যাধুনিক সামরিক সরঞ্জামের ৬০ শতাংশই আসে গণচীন থেকে। সম্প্রতি বাংলাদেশের নৌবাহিনীতে ‘নবযাত্রা’ ও ‘জয়যাত্রা’ নামে যে দুটো ডুবোজাহাজ সংযোজিত হয়েছে তা-ও কেনা হয়েছে চীনের কাছ থেকে।
চীনের কাছ থেকে এই ডুবোজাহাজ কেনা নিয়ে ভারতের শাসকদের নাকি ঘুম হারাম হয়ে যায়। তড়িঘড়ি করে বাংলাদেশ সফরে আসেন ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী এবং গোয়ার বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মনোহর পারিকর। ধারণা করা হয়, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তিনি দ্রুত ভারত সফরে যেতে প্রভাবিত করেন। সে মোতাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী এপ্রিল মাসে ভারত সফরে যাবেন। তবে এ কথাও সত্য যে, ভারতের সাথে চূড়ান্তভাবে প্রতিরক্ষা চুক্তি সম্পাদন কাজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য খুব একটা সহজ নাও হতে পারে।
শোনা যায়, এই চুক্তির বিষয়ে আওয়ামী লীগের উল্লেখযোগ্য অংশের মধ্যে প্রবল বিরোধিতা রয়েছে। বিরোধিতা রয়েছে রাষ্ট্রের সবচেয়ে সুসংগঠিত প্রভাবশালী অংশের তরফ হতেও। সেই সাথে তো চীন ফ্যাক্টর রয়েছেই। বিগত কয়েক বছরে চীনের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন এবং উন্নয়নমূলক কর্মকা-ে চীনের সহযোগিতা গ্রহণের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। গত বছরের ১৪ অক্টোবর গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং বাংলাদেশ সফরে এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে বৈঠকের সময় ২৭টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে কয়েক বিলিয়ন ডলার ঋণের দানের প্রতিশ্রুতি দেয় চীন। অন্যদিকে সামরিক চুক্তির সাথে ভারত ৫০ কোটি ডলার ঋণ দেয়ার প্রস্তাব করেছে তাদের কাছ থেকে সামরিক সরঞ্জাম ক্রয়ের জন্য। এতে উচ্চহারে সুদ দিতে হবে।
আর্থিক ঋণদানের ক্ষেত্রে চীনের চেয়ে ভারত অতি নগণ্য। ভারতের চেয়ে চীনের দেয়া ঋণে সুদের হার অনেক কম। সর্বোপরি ভারতের চেয়ে চীনের সমরাস্ত্রের মান অনেক উন্নত। ভারতের নি¤œমানের সমরাস্ত্র বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীকে দুর্বল করে ফেলবে। এটি স্পষ্ট যে সামরিক ক্ষেত্রে চীনা নির্ভরতা কমানোর জন্য প্রতিরক্ষা বিষয়ে নয়াদিল্লি বাংলাদেশকে ভারতনির্ভর করতে চাইছে। আবারো বলা হচ্ছে, এটি বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা এবং স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের পরিপন্থী। এখন যদি ভারতের আশীর্বাদ নিয়ে আরো দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় আসীন থাকার জন্য ভারতের সাথে প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর করা হয় তাহলে তা হবে বাংলাদেশের জন্য আত্মঘাতী কাজ। হয়তো একপর্যায়ে বাংলাদেশ আরেকটি সিকিমে পরিণত হতে পারে। তারপরও দেশবাসী আশা করে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় স্বার্থ তথা দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব এবং জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনা করে ভারতের সাথে বাংলাদেশের জন্য আত্মঘাতী প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর করবেন না। তার চেয়ে বরং তিনি দিল্লি সফরের সময় বাংলাদেশের ন্যায্য দাবি তিস্তার পানি বণ্টনসহ অন্যান্য বিষয়কেই প্রাধান্য দিবেন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Safiq Islam ২৪ মার্চ, ২০১৭, ১২:৫০ পিএম says : 0
Na kora valo
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন