শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

জনসচেতনতা ও জাতীয় ঐক্যের বিকল্প নেই

| প্রকাশের সময় : ২৪ মার্চ, ২০১৭, ১২:০০ এএম

সাম্প্রতিক কয়েক মাসে দেশে জঙ্গি হামলার কোন ঘটনা না ঘটলেও হঠাৎ করেই আবারো জঙ্গিবাদ বা জঙ্গি তৎপরতা গণমাধ্যমের প্রধান আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে। গত সপ্তাহে চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে কথিত জঙ্গি আস্তানায় র‌্যাবের অভিযান এবং সেখানে অন্তত ৫ জনের মৃত্যু এবং হাতে তৈরী গ্রেনেডসহ বেশ কিছু বিস্ফোরক দ্রব্য উদ্ধার করা হয়েছে। গত শুক্রবারে রাজধানীর আশকোনায় প্রস্তাবিত র‌্যাব হেডকোয়ার্টারে কথিত আত্মঘাতী জঙ্গির অনুপ্রবেশের চেষ্টা এবং বিস্ফোরণে সন্দেহভাজন জঙ্গির নিহত হওয়ার ঘটনা এবং খিলগাঁয়ে র‌্যাবের চ্যাকপোস্ট অমান্য করে কথিত সশস্ত্রজঙ্গি সদস্যের পলায়নের চেষ্টার সময় গুলিতে নিহত হওয়ার ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। পর পর কয়েক দিনে সংঘটিত এসব ঘটনাবলীকে পুঁজি করে গণমাধ্যম, সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলো জঙ্গিবাদের ব্লেইম গেমে মেতে উঠেছে। র‌্যাবসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তরফ থেকে দেশে জঙ্গিবাদী তৎপরতার হুমকি সম্পর্কে গতানুগতিক বক্তব্য বিবৃতি দেয়া হলেও অতি প্রচারণার কারণে জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে। বিশেষত সরকার এসব ঘটনাকে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের হাতিয়ারে পরিণত করছে বলে সাধারণ মানুষের মধ্যে একটি ধারণার জন্ম হয়েছে। জঙ্গিবাদ ইস্যুকে সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকার একটি রাজনৈতিক ইস্যু বানাতে চাইছে বলে বিএনপি নেতৃবৃন্দ সরাসরি অভিযোগ করেছেন।
রাজনৈতিক ব্লেইম গেম যা’ই থাক, দেশ যে জঙ্গিবাদী নাশকতার হুমকিতে আছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। জঙ্গিবাদ এখন একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা হিসেবেও চিহ্নিত। যে নামে যে গোষ্ঠিই জঙ্গিবাদী তৎপরতা চালাক, এর ফলে দেশ-বিদেশে যে আতঙ্ক তৈরী হয়, তা’ দেশের বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক কর্মকা-ে বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করে। একই কারণে দেশে প্রত্যাশিত সামাজিক-রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠাও অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। তবে জঙ্গিবাদী হুমকি মোকাবেলায় যে ধরনের সামাজিক-রাজনৈতিক ঐক্য ও কর্মপন্থা থাকা জরুরী তা’ এই মুহূর্তে বাংলাদেশে নেই। গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারীতে জঙ্গি হামলার পর থেকে বিভিন্ন সময়ে বিরোধীদল বিএনপি’র পক্ষ থেকে জাতীয় ঐক্য ও সংলাপের আহ্বান জানানো হলেও সরকার বরাবরই বিএনপি’র আহ্বানকে অগ্রাহ্য করে ভিন্ন সুরে কথা বলেছে। এমনকি প্রত্যক্ষ-পরোক্ষে জঙ্গিবাদের সাথে বিএনপি-জামায়াতের সম্পৃক্ততার অভিযোগ তোলা হয়েছে। অন্যদিকে জঙ্গিবাদ দমনের নামে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান এবং বিনা বিচারে হত্যার ঘটনা এবং কোন কোন নিহতের পরিবারের অভিযোগ নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। জঙ্গিবাদী নাশকতার সাথে যারাই জড়িত থাক তাদের বিচারের সম্মুখীন করা এবং মদদ দাতাদের মুখোশ উন্মোচন করে ঘটনার পুনরাবৃত্তি বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ হিসেবে সরকার ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী যে কোন উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে। এ ক্ষেত্রে দ্বিমত প্রকাশের কোন সুযোগ নেই। তবে ঘটনাকে পুঁজি করে কোন রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টা অথবা এ ধরনের অভিযোগ তোলার সুযোগ সৃষ্টি করা সংশ্লিষ্ট সকলের জন্য বুমেরাং হতে পারে। মোদ্দা কথা হচ্ছে, জঙ্গিবাদী তৎপরতার মত স্পর্শকাতর ইস্যুকে ব্লেইম গেম বা রাজনৈতিক ইস্যু হিসেবে ব্যবহারের তৎপরতা থেকে সকলকে বিরত থাকতে হবে।
 এক সময় সরকারের সংশ্লিষ্টরা যথেষ্ট জোর দিয়ে বলেছিলেন, তারা অত্যন্ত সফলভাবে দেশের জঙ্গিবাদী হুমকি মোকাবেলায় সক্ষম হয়েছেন। সত্য মিথ্যা যা’ই হোক, কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থা যখন বাংলাদেশের জঙ্গিবাদী নাশকতার ঘটনাগুলোর সাথে আইএস সংশ্লিষ্টতার দাবী তুলেছে, সরকার এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তা’ নাকচ করে দিলেও হুমকি মোকাবেলায় যে ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক ও রাজনৈতিক তৎপরতা বা পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন তা’ কখনো দেখা যায়নি। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করেন, ব্যাপক আতঙ্ক সৃষ্টি করা এবং আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা জঙ্গি গোষ্ঠিগুলোর অন্যতম লক্ষ্য। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশে সরকার এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে কথিত জঙ্গিবাদ বিরোধী যে সব বিবৃতি ও প্রচারণা চালানো হচ্ছে, তা বাংলাদেশ সম্পর্কে বিশ্বের কাছে ভুল বার্তা চলে যাচ্ছে। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক জনসচেতনতা গড়ে তোলার গুরুত্ব সকলেই স্বীকার করেন। সেই সাথে সামাজিক-রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তোলাও অনেক বেশী প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। গত কয়েক বছর ধরে রাজনৈতিক দমন-দলন, হামলা-মামলা এবং গুম, অপহরণ ও গুপ্তহত্যা উদ্বেগজনক হারে বেড়ে চলেছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হওয়ার পর জঙ্গি হামলা বা জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার সন্দেহভাজন হিসেবে নিহত হওয়ার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এ ধরনের অভিযোগ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পুরো জঙ্গিবাদ বিরোধী তৎপরতাকেই জনগণের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে। বিশেষত সন্দেহভাজন জঙ্গিদের বিচার বহির্ভূত হত্যাকা-ের শিকার হওয়ার কারণেই নানা প্রশ্নের জন্ম হচ্ছে। সরকার, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, বিরোধী রাজনৈতিকদলসহ সকলেই জঙ্গিবাদ মোকাবেলায় জনসচেতনতা গড়ে তোলার কথা বলছে। ব্লেইম গেম ও বিরোধীদল দমনের তৎপরতা বাদ দিয়ে রাজনৈতিকভাবে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার পাশাপাশি দেশের আলেম সমাজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সব সামাজিক, পেশাজীবী ও ব্যবসায়ী সংগঠনের মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলার কোন বিকল্প নেই। জঙ্গিবাদের আতঙ্ক ও প্রচারণা যেন দেশের বিনিয়োগ, ব্যবসায়-বাণিজ্যসহ সামগ্রিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কর্মকা-কে ক্ষতিগ্রস্ত করতে না পারে সে দিকেই বিশেষ নজর দেয়ার আবশ্যকতা প্রশ্নাতীত।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন