ব্রিটিশ পার্লামেন্ট চত্বর ও পার্শ্ববর্তী ওয়েস্ট মিনিস্টার সেতুতে পৃথক সন্ত্রাসী ঘটনায় ৪ জন নিহত এবং পুলিশ সদস্যসহ কমপক্ষে ২০ জন আহত হয়েছে। গত বুধবার স্থানীয় সময় বিকেলে এ ঘটনা ঘটে বলে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম জানিয়েছে। আঁততায়ী পার্লামেন্ট চত্বরের রেলিংয়ে আছড়ে পড়ার পর পার্লামেন্টের নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশ সদস্যদের ছুরিকাঘাত করে। পরে পুলিশ কর্মকর্তাদের গুলিতে সে আহত হয়। হাসপাতালে নেবার পর তার মৃত্যু ঘটে। এর আগে সে ওয়েস্টমিনিস্টার সেতুতে পথচারী ও সাইকেল আরোহীদের ওপর সে গাড়ি চালিয়ে দেয়। এ সময় গাড়ি চাপায় ঘটনাস্থলেই একজন মহিলার মৃত্যু ঘটে এবং আরো অন্তত ১০ জন পথচারী আহত হয়। পার্লামেন্ট চত্বরে এক পুলিশকর্মী নিহত এবং আরো ৩ কর্মী মারাত্মক আহত হওয়ার পরপরই আশপাশের লোকজন এলাকা থেকে সরে যাবার সময় অন্তত ৪টি বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। পার্লামেন্ট অধিবেশন চলাকালে এ ঘটনায় পার্লামেন্ট ভবন বন্ধ এবং অধিবেশন স্থগিত করা হয়। লন্ডনের মেট্রোপলিটন পুলিশ এই ঘটনাকে ‘সন্ত্রাসী ঘটনা’ বলে আখ্যায়িত করেছে। যে বা যারাই এই ঘটনা ঘটিয়ে থাকুক না কেন, আমরা এই হামলার তীব্র নিন্দা করছি। যারা নিহত হয়েছে আমরা তাদের আত্মার শান্তি কামনা করছি এবং যারা আহত হয়েছে তাদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করছি। এই ঘটনার রেশ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে এবং কাদের দায়ী করা হবে সেটা আমরা জানি না। তবে ইতোমধ্যেই বলা শুরু হয়ে গেছে যে, একজন মাত্র ব্যক্তি এই হামলা চালিয়েছে এবং যে হামলা চালিয়েছে টেলিভিশন ফুটেজ থেকে নাকি দেখা যায় যে, তার মুখে দাড়ি রয়েছে। আমরা আশা করি, গণতন্ত্রের সূতিকাগার ইংল্যান্ডে এই হামলার নিরপেক্ষ তদন্ত অনুষ্ঠিত হবে এবং প্রকৃত অপরাধীকে খুঁজে বের করা হবে।
এ কথা এই জন্যই বলতে হচ্ছে যে, পশ্চিমা দুনিয়ায় দেখা গেছে যে, যখনই তাদের কোনো স্থানে হামলা হয়েছে সাথে সাথেই সে হামলার জন্য শুধুমাত্র সন্ত্রাসীদেরই দায়ী করা হয়নি, সেই সন্ত্রাসীদের পিঠে ইসলামী জঙ্গির তকমা এঁকে দেয়া হয়েছে। বস্তুত সমগ্র পশ্চিমা দুনিয়ায় আজ জঙ্গিবাদের নাম করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও বিদ্বেষ সৃষ্টির অভিযান শুরু হয়েছে। ব্রিটেনের সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা করার সাথে সাথে একথাও বলতে হয় যে, পশ্চিমা দুনিয়া এই ধরনের সন্ত্রাসী হামলা দমনের জন্য যত ক্ষিপ্র গতিতে তৎপর হয়ে ওঠে, মুসলিম জাহানে যখন মুসলমানদের গণহারে হত্যা করা হয় তখন তাদের কোনো তৎপরতা তো দেখাই যায় না বরং তাদেরকে সেই ব্যাপারে উদাসীন বলেই প্রতীয়মান হয়। সিরিয়ায় সন্ত্রাস দমনের নামে হাজার হাজার বেসামরিক নাগরিকদেরকে হত্যা করা হচ্ছে। মাত্র ৩ কোটি লোকের দেশে ৫০ লাখ মানুষ আজ উদ্বাস্তু ও গৃহহারা। দুনিয়া ব্যাপী তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোথাও তাদের ঠাঁই নাই। একমাত্র তুরস্ক তাদেরকে যতটুকু সম্ভব আশ্রয় দিচ্ছে। পশ্চিমা কোনো কোনো দেশ দুই চার ১০ হাজার উদ্বাস্তুকে আশ্রয় দিয়েছে। কিন্তু সংখ্যা যেখানে ৫০ লাখ বা তারও বেশী সেখানে দুই চার ১০ হাজার মানুষকে আশ্রয় দান সমুদ্রে বারি বিন্দুর সমান। সিরিয়া ছাড়াও ইরাক, আফগানিস্তানসহ মুসলিম জাহানের বহু দেশে মুসলমানদের ওপর যে হত্যা-নির্যাতন চলছে, তার মূলে রয়েছে পশ্চিমা বিশ্ব। মুসলিম জাহানের শত কোটির ও বেশী মুসলমানের মধ্যে ধীরে ধীরে পুঞ্জীভূত হচ্ছে হতাশা ও ক্ষোভ। তাই বলে ঐ পুঞ্জীভূত ক্ষোভের সাথে সন্ত্রাসী হামলার সম্পর্ক খোঁজা মোটেই উচিত হবে না। অথচ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পশ্চিমারা সেই কাজটিই করছে। কোথাও কোনো সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটলেই মুসলমানদের প্রতি আঙ্গুল তোলা হচ্ছে। এই ব্যাপারে অত্যন্ত নিরপেক্ষ এবং সঠিক পর্যালোচনা করেছেন শ্রীলঙ্কার সন্ত্রাস বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. গুণরতনে। ঢাকায় অনুষ্ঠিত একটি সেমিনারে তিনি বলেছেন যে, পৃথিবীর কোথাও কোনো সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটলেই মুসলমানদের নাম জড়িত করা অত্যন্ত অন্যায়। শ্রীলঙ্কায় যে সন্ত্রাসী কা- ঘটছে সেখানে জড়িত ছিলো বৌদ্ধ এবং হিন্দু। আয়ারল্যান্ডে কয়েক বছর ধরে সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। সেটি করেছে আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি। সেখানে কোন মুসলমান ছিলো না। পাকিস্তানের জনসংখ্যার আটানব্বই শতাংশ মুসলমান। তারপরেও সেখানে সন্ত্রাসী হামলা হচ্ছে। সেই হামলাকারীদের কী ইসলামী জঙ্গি বলা যায়? একই অবস্থা আফগানিস্তানের ক্ষেত্রেও। সেখানকার শতকরা এক শতভাগ মানুষই মুসলমান।
সন্ত্রাস দমনের নাম করে মুসলমানদের ওপর দমন নীতি চালালে এই ভয়াবহ সমস্যার সমাধান হবে না। এই সমস্যার যদি সমাধান করতে হয় তাহলে কেন এসব ঘটনা ঘটছে, তার গোড়ায় যেতে হবে। কারা এগুলো ঘটায়, কারা তার মাস্টারমাইন্ড, কারা সেই সব সন্ত্রাসী তৎপরতায় অর্থায়ন করে, তাদেরকে নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে চিহ্নিত করতে হবে এবং তারপর তাদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। মুসলিম জাহানের যেসব দেশ রাশিয়া এবং পশ্চিমা দুনিয়ার প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ হামলার শিকার তাদের মধ্যে সমতা, ন্যায় বিচার এবং সম্প্রীতির একটি বাতাবরণ তৈরি করতে হবে। তাহলেই ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সাধারণ মানুষ সন্ত্রাসীদেরকে প্রতিরোধ করার জন্য এগিয়ে আসবে। শান্তিপূর্ণ, গণতান্ত্রিক এবং বিদেশী আধিপত্য মুক্ত পরিবেশ সন্ত্রাস নির্মূলের আবশ্যকীয় পূর্বশর্ত।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন