তৈমূর আলম খন্দকার : রাষ্ট্র গঠন বা সভ্যতা বিকশিত হওয়ার বহু পূর্বেই ‘জাতির’ সৃষ্টি হয়েছে এবং জাতির সমষ্টিগত স্বার্থ রক্ষার উপলব্ধি থেকে সৃষ্টি হয় ‘জাতীয়তাবাদ’। মানুষ যখন গাছের ছাল, পশুর চামড়া পরে লজ্জা নিবারণ ও শীতের প্রকোপ থেকে নিজেকে রক্ষা করতো, পাথড়ে পাথড়ে ঘষা দিয়ে আগুন জ্বালাতো, গুহাতে বাস করে হিং¯্র জন্তুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতো তখন থেকেই মানুষের আত্মোপলব্ধি থেকে দিন দিন জাতি থেকে জাতিসত্তা ও জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি। জাতি সৃষ্টির পূর্ব ইতিহাস ভিন্ন। ‘জাতি’ সৃষ্টি হয়েছে সৃষ্টিকর্তার সৃষ্ট প্রাকৃতিক নিয়মেই। তবে জাতিকে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য সৃষ্টিকর্তা সময়ে সময়ে দূত প্রেরণ করেছেন। ভাষার সৃষ্টি হয়েছে অনেক ধীর গতিতে, পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন ভাষার মিশ্রণে তা সমৃদ্ধি লাভ করে। মানুষের প্রয়োজনে জাতি থেকে জাতিসত্তার সৃষ্টি। ভৌগোলিক সীমারেখা, জন্মগত অবস্থান, প্রাকৃতিক অবস্থা, শরীরের গঠন, বর্ণ, ভাষা প্রভৃতি একত্রীকরণ থেকে জাতির সৃষ্টি। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বহু জাতি ধ্বংস হয়েছে এবং জন্মগত অবস্থান ভিন্নতর হলেও জন্মভ‚মি থেকে প্রাকৃতিক কারণে স্থানান্তরিত বা কোন শক্তি দ্বারা বিতাড়িত হয়েও দীর্ঘদিন একত্রে বসবাসের কারণে অনেক জাতির সৃষ্টি হয়েছে। প্রকৃতির অবদান জাতি ও মূল্যবোধ এবং এর মূল্যায়নের প্রয়োজনের তাগিদে সৃষ্টি হয়েছে জাতিসত্তা। বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে টিকে থাকার উপলব্ধি থেকে সৃষ্টি হয়েছে জাতীয়তাবাদ।
গোটা বিশ্ব এখন জাতীয়তাবাদের দিকে ঝুঁকছে, বিশেষ করে ভোটের রাজ্যে ভাগ বসানোর জন্য জাতীয়তাবাদের ধোয়া বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে, প্রকৃত জাতীয়তাবাদ যাই হোক না কেন? যেমন আমেরিকার ট্রাম্প, রাশিয়ার পুতিন, ভারতের নরেন্দ্র মোদি তাদের নিজ নিজ রাষ্ট্রের সংখ্যালঘুদের (মুসলিম) বিরুদ্ধে সংখ্যাগুরুদের (অমুসলিম) লেলিয়ে দিয়ে নিজেকে জাতীয়তাবাদী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে ক্ষমতার শীর্ষ স্থানে আরোহণ করেছে বা টিকে আছে। তবে এটি প্রকৃত ‘জাতীয়তাবাদ’ কিনা তাও পর্যালোচনা এবং বিশ্লেষণের দাবি রাখে। এটা মূল জাতীয়তাবাদ নয় বরং বকধর্মী জাতীয়তাবাদ যাতে রং মাখিয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে মার্কেটিং করা হচ্ছে।
অন্যদিকে রাষ্ট্র থেকে জাতির উৎপত্তি নয় বরং জাতি থেকে জাতিসত্তা ও পরে রাষ্ট্রের উৎপত্তি। ভিন্ন ভিন্ন জাতি নিয়ে একটি রাষ্ট্র গঠিত হতে পারে কিন্তু তাতে জাতিসত্তা বিলীন হয়ে যায় না। ভিন্ন ভিন্ন জাতি নিয়ে গঠিত রাষ্ট্রের সমষ্ঠিগত চিন্তার গ্রহণযোগ্য নির্দিষ্ট চেতনা থেকেই জাতীয়তাবাদের উৎপত্তি। ‘জাতীয়তাবাদী’ চিন্তাচেতনা ও আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীক ও প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে নিজেদের টিকে থাকা ও অবস্থান সৃষ্টি করার উপাদান যা সময়ের বিবর্তনে পরিবর্তন হতে পারে এবং ইতিহাস পর্যালোচনা করলে যার প্রমাণ পাওয়া যায়।
জাতীয়তাবাদের উৎস্য কি? অথবা জাতীয়তাবাদের ব্যাকরণ বা আক্ষরিক বা সাহিত্যের ভাষার যদি পর্যালোচনা করা হয় তবে এর ক‚লকিনারা পাওয়া যাবে না। তবে দ্রæব সত্য যে, দেশপ্রেম থেকেই জাতীয়তাবাদের উৎপত্তি। দেশপ্রেম একটি ভিন্ন বিষয় যা পুঁথিগত বিদ্যা বা ডক্টরেট ডিগ্রী নিয়েলেই অর্জন করা যায় না। অন্তরের অন্তঃস্থল ও বিবেকই জাতীয়তাবাদের উৎস। পদ, পদবি, অর্থ, ক্ষমতা থেকে ‘দেশপ্রেম’-এর উপলব্ধি আসে না। ইতিহাস পর্যালোচনায় অনেক সময় এমনও দেখা যায় যে, একজন পতিতার দেশপ্রেমের পরিচয় পাওয়া যায়, কিন্তু দেশ রক্ষায় প্রধান দায়িত্ব যার সে সেনাপ্রধানের তা (দেশপ্রেম) থাকে না। যেমনটি ঘটেছিল বাংলার শেষ নবাব সিরাজদৌল্লার বেলায়। নর্তকি আলেয়া ও গোমোস্তা (নি¤œপদস্থ কর্মচারী) গোলাম হোসেন দেশপ্রেমের প্রশ্নে যে পরীক্ষা দিয়েছিল, সেনাপ্রধান মীরজাফর আলী সে ভ‚মিকা রাখতে পারেনি। মহীশূরের যুদ্ধে টিপু সুলতানের প্রধান সেনাপতি মীর সাদিক দেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ফিরিঙ্গি সাদা চামড়াদের হাতে দেশের স্বাধীনতা বিকিয়ে দিয়েছিল। অনেক সময় ক্ষমতার লোভ ‘দেশপ্রেম’কে বিলীন করে দেয়। অন্যদিকে ‘দেশপ্রেমই’ ব্যক্তি ইচ্ছাকে বিলীন করে দিয়ে স্বচ্ছ মনমানসিকতা নিয়ে দেশ ও জাতির সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করার জন্য প্রস্তুত করে। দেশপ্রেমের বিকল্প নেই এবং ভবিষ্যতে তা হবেও না। দেশপ্রেমের প্রধান শর্ত দেশের জনগণের স্বার্থকে উপলব্ধি করা।
রাজনৈতিক কারণে আমাদের দেশে ‘জাতীয়তাবাদ’ দু’ভাগে বিভক্ত। যথা- (১) বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ ও (২) বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। বাংলাদেশের বাঙ্গালী ও পশ্চিম বাংলার বাঙ্গালী চলনে, বলনে, গড়নে এবং ভৌগোলিক অবস্থান এক হতে পারে কিন্তু জাতিসত্তার প্রশ্নে এক নয়। জাতিসত্তা একটি ভিন্ন বিষয় যা চেতনানির্ভর, সংশ্লিষ্ট জাতির শনাক্তকরণের বিষয় বস্তু। এখন প্রশ্ন হলো বাঙ্গালী হউক বা বাংলাদেশী হউক ‘জাতীয়তাবাদীদের’ মর্মার্থ কী? ক্ষমতার দাপটে সামনে যা পেলাম তাই খেয়ে ফেললাম বা যা পাবো তাই গিলে খাবোÑ এ চিন্তাচেতনাই কি জাতীয়তাবাদ? জাতীয়তাবাদের প্রধান শক্তি দেশপ্রেম। ভিন দেশের অনুকম্পার দিকে তাকিয়ে থাকা বা অনুকরণ করা জাতীয়তাবাদ নয়। শিক্ষার জন্য যেখানে খুশী যাওয়া যায় কিন্তু অনুকরণের জন্য নয়। নিজস্ব সাংস্কৃতিকে ধারণ ও প্রতিষ্ঠা করা জাতীয়তাবাদ, অন্য সংস্কৃতিকে ধার করার নাম জাতীয়তাবাদ নয়। বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে ঘরে এখন ভারতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসন চলছে। ভারতের প্রায় চ্যানেলগুলি বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে কিন্তু বাংলাদেশের কোন চ্যানেল ভারতের মাটিতে বসে দেখা যায় না। এর কারণটি অবশ্যই বিশ্লেষণের দাবি রাখে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ নিজেও হিন্দিকে ভারতের রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে মতামত ব্যক্ত করেছিলেন, এর কারণ কী ছিল? ঢাকাতে বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) প্রতিষ্ঠার (১৯২০) তিনি বিরোধিতা করেছিলেন, তার নেতৃত্বে শুধু প্রতিবাদ সভা হয়নি, বরং বড় লাটের নিকট যে স্মারকলিপি দেয়া হয়েছিল সেখানেও তিনি স্বাক্ষর দিয়েছিলেন। এর পিছনে কারণ কী?
জাতি, জাতিসত্তা, জাতীয়তাবাদ ও রাষ্ট্র একই ধারাবাহিকতায় প্রবাহিত না হলে সেখানে জাতীয় ঐক্য ও একটি শৃঙ্খলাবোধ গড়ে উঠে না। ক্ষমতায় যারা অধিষ্ঠিত থাকেন তারা মনে করেন যে, দেশটি শুধুমাত্র ‘তাদের’, তবে দেশটি যে ‘সকল দেশবাসীর’ এ চিন্তাচেতনার বহিঃপ্রকাশ না হলে জাতিসত্তার সূচনা হবে না। ক্ষমতায় থেকে প্রতিপক্ষকে নিগৃহীত-নিপীড়ন, প্রচলিত আইন দু’ভাগে প্রয়োগ (অর্থাৎ একই আইন ক্ষমতাসীনদের ক্ষেত্রে একরকম, ক্ষমতাহীন ও সাধারণ নাগরিকদের প্রশ্নে অন্যরকমভাবে প্রয়োগ), মুনাফার জন্য খাদ্যে ভেজাল প্রয়োগ যা ¯েøা পয়োজন হিসেবে শরীরে কাজ করে, ব্যাংকে জনগণের গচ্ছিত আমানত কলমের মাধ্যমে কর্তৃপক্ষ কর্তৃক লোপাট অর্থাৎ আমানতের খেয়ানত, ব্যাংকে গচ্ছিত জনগণের টাকা ফেরত না দেয়ার উদ্দেশ্য নিয়েই ঋণ গ্রহণ ও আত্মসাৎ, ব্যক্তিগত কারণে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অপচয়, জাতীয় সাংবিধানিক নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানগুলি দলীয়করণ, প্রতিপক্ষকে দলন-নিপীড়নের জন্য বিশেষ আইন প্রণয়ন, রাষ্ট্রীয় সম্পদের আমানতের খেয়ানত, সর্বত্র ক্ষমতার অপব্যবহার ও কর্তৃপক্ষের মনোরঞ্জনের জন্য ন্যায়কে অন্যায় ও অন্যায়কে ন্যায় হিসাবে চালিয়ে দেয়া, ক্ষমতার দাপটে বিচার বিভাগকে কুক্ষিগত করে রাখা, নিজ মর্জিমত ‘গণতন্ত্রের’ ব্যাখ্যা প্রদান, ইতিহাস বিকৃতিকরণ, শুধুমাত্র রাজনৈতিক বিবেচনায় সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতি নিয়োগ, ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য বিদেশী প্রভুদের নিকট নিজেদের বিকিয়ে দেওয়া প্রভৃতি যে জাতির বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে সে জাতির জাতিসত্তা বা জাতীয়তাবাদ মজবুত হবে কীভাবে? তবে কি জাতিসত্তার অন্তরালে বিষাক্ত নিঃশ্বাস বইতেই থাকবে? ভবিষ্যৎ বংশধরদের নিকট এ মর্মে আমাদের জবাব কী?
ক্যারিবিয়ান দীপপুঞ্জের (ওয়েষ্ট ইন্ডিজ-ক্রিকেটের জন্য যা বিখ্যাত) কালো ও মিশ্র বর্ণের মানুষের কণ্ঠস্বর কবি ডেরেক ওয়ালকট বলেছেন ‘হয় আমি কেউ নই অথবা আমিই একটা জাতি।’ কবি ওয়ালকটের ভাষায় যে চিন্তাচেতনা ফুটে উঠেছে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন সে চেতনার উপলব্ধি এবং ‘আমিই একটা জাতি’ আত্মবিশ্বাস থেকে জাতিসত্তা ও জাতীয়তাবাদীদের ভিতকে মজবুত করার প্রত্যাশায় ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতিটি রক্ত বিন্দুতে প্রবাহিত হোক দেশপ্রেমের অগ্নিশিখা। আশার কথা এই যে, যে জাতি রক্ত দিয়ে মাতৃভাষাকে রাষ্ট্র ভাষার স্বীকৃতি আদায় করেছে, যে জাতি মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে সে জাতির জাতিসত্তা ও প্রকৃত জাতীয়তাবাদ একদিন আলোর মুখ দেখবেই, দেখবে, ইনশাআল্লাহ।
লেখক : কলামিস্ট ও বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন