এ কে এম শাহাবুদ্দিন জহর : প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন ভারত সফরে ভারতের অনুক‚লে অনেক চুক্তি হবে বলে শোনা যাচ্ছে। তবে বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থে কোনো চুক্তি হবে বলে মনে হয় না। এমনটি হলে তো শুধু তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়নের জন্যই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী দিল্লি সফরে যেতেন। বহু লুকোচুরি খেলার পরে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর এই সফরে তিস্তা চুক্তি হচ্ছে না। তিস্তা চুক্তি না হওয়ার অর্থ তিস্তা তীরের মানুষ মাছের জন্য, সেচের জন্য, নৌ পরিবহনের জন্য তিস্তা নদীর পানি পাবে না। তিস্তা তীরের মানুষ তিস্তার বুকে গোসল করতে, পাট জাগ দিতে সক্ষম হবে না।
শুধু তিস্তা নয়, তিস্তার পানি গড়িয়ে গিয়ে যেসব নদীতে পড়েছে সেই যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা এবং তাদের শাখা নদীগুলোর তীরের মানুষেরাও দেখবে মনুষ্য-সৃষ্ট মরা নদ-নদী। এই মানুষগুলো ফসলের অভাবে, সুপেয় পানির অভাবে, সস্তা নৌ যোগাযোগের অভাবে কাঁদছে। তাদের এই কান্নার সাথে শরিক হয়ে আসুন আমরা গোটা দেশবাসীও কাঁদি। আমরা শুধু তিস্তার জন্যই কাঁদব না, আমরা কাঁদব ফারাক্কার কারণে গঙ্গা ও টিপাইমুখের কারণে মেঘনার জন্যও। আমরা কাঁদব ভারত কর্তৃক নিষ্ঠুর আক্রমণ ও পানি লুণ্ঠনের শিকার ৫৪টি অভিন্ন নদনদীর জন্যও। কী অন্যায় করেছিলাম যে, আমি আমার মাতৃসম নদ-নদীর বুকে জলকেলি করতে পারব না, নৌকা বাইচ দিতে পারব না এবং পারব না মাছ ধরতে?
ভারত কেন্দ্র ও রাজ্যের মতভেদের অজুহাত দেখিয়ে তিস্তার চুক্তি করছে না।
চুক্তি না হলে তো এটাই বোঝায় যে নদীর প্রবাহ প্রকৃতিগতভাবে যে রকম আছে সেরকমই থাকবে। কিন্তু না আমাদের নেতারা শিক্ষা নিলেন যে, চুক্তি না হওয়া মানে নদীর সমস্ত পানি আটকিয়ে দিয়ে একটি পক্ষ এককভাবে ব্যবহার করবে এবং সে পক্ষ হবে শুধুই ভারত। তিস্তা ইস্যু ছাড়াই আমাদের কর্তাদের একটি দেশ সফর এবং উদ্ভট সব চুক্তি করতে যাওয়ার মানে গানের ভাষায় হয়তো বলা যাবে, “প্রেম করেছ তুমি, আর মন দিয়েছি আমি।” কিংবা “মেরেছিস কলসি কানা, তাই বলে কি প্রেম দেব না?”
তিস্তা চুক্তির বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে আছে। তবে তিস্তা চুক্তি নিয়ে অনেক নাটক হয়েছে। হয়েছে অনেক প্রহসন। ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময়ে তিস্তা চুক্তি যেন হয়েই গেছে এমন ভাব দেখানো হলো। কিন্তু চুক্তি হলো না। অজুহাতস্বরূপ বলা হলো পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি বেঁকে বসেছেন। এখন বেঁকে বসে আছেন পশ্চিমবঙ্গের সাথে সিকিমের মুখ্যমন্ত্রীও। কারণ তিস্তার উৎপত্তিস্থল সিকিম। সিকিম থেকে তিস্তা পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি জেলার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে পড়েছে এবং এর পানি বাংলাদেশের সর্ব উত্তর থেকে প্রবাহিত হয়ে নানা নদ-নদীর মধ্য দিয়ে বেয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। মনমোহনের সাথে তিস্তা চুক্তি নাটক মঞ্চস্থ হলো এবং নাটকের বঢ়রষড়মঁব-এ বলা হলো ঘড় ঞববংঃধ, ঘড় ঞৎধহংরঃ। এর কিছু দিন পরেই প্রকাশ পেলো যে, ট্রানজিট চুক্তি ঠিকই হল, কিন্তু হলো না তিস্তা চুক্তি। এই পর্বেও প্রথমে দেশবাসীকে জানান দেওয়া হলো যে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময়ে সামরিকসহ নানান চুক্তির সাথে তিস্তা চুক্তিও সম্পাদিত হবে। কিন্তু সফরের সময় যেই পাকা হয়ে গেল তখনি বীরবিক্রমে ঘোষণা দেওয়া হলো যে এই সফরে তিস্তা চুক্তি নিয়ে কোনো এজেন্ডা নেই।
বাংলাদেশ তিস্তা চুক্তি নিয়ে জাতিসংঘে অভিযোগ দায়ের করতে পারত। এতে তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়নে ভারতের ওপরে চাপ বাড়ত। বাংলাদেশ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে ভারতের সাথে ক‚টনৈতিক সম্পর্ক শিথিল করতে পারত। কিন্তু সে তা করছে না। কারণ বাংলাদেশের প্রভাবশালী ও ক্ষমতা কুক্ষিগতকারীদের স্বার্থ জনগণকেন্দ্রিক নয়, দলগত।
নদীর পানি প্রবাহের সাথে মাটির নিচের পানি সমান্তরালে অবস্থান করে। ভারত কর্তৃক এদেশের পানি লুণ্ঠনের ফলে দেশের নদ-নদী হয় শুকিয়ে গেছে অথবা নদীর পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। ফলে মাটির নিচের পানির স্তরও বহু নিচে চলে গেছে। আগে অগভীর নলক‚প থেকেই সারা বছর পানি পাওয়া যেত। এখন পানির স্তর গভীরে যাওয়ায় ঘরে ঘরে শুধুই চোখে পড়ে ব্যয়বহুল গভীর নলক‚প।
বাংলাদেশের নদ-নদীগুলোকে ভারতের নাগপাশ থেকে মুক্ত করার জন্য জনগণকে নতুন করে রাজনৈতিক ভাবনা ভাবতে হবে। দেশকে সত্যিকারের স্বাধীন ও সার্বভৌম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
লেখক : কলামিস্ট ও শিক্ষাবিদ
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন