মুহাম্মদ রেজাউর রহমান : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরে যাচ্ছেন ৭ এপ্রিল। দুবার পিছিয়ে দেয়া এই সফর বিভিন্ন কারণে রাজনৈতিক দল, গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের মধ্যে এমন এক আগ্রহ ও প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে, যা শেখ হাসিনার নিজের ও এর আগে অন্য কোনো প্রধানমন্ত্রী বা প্রেসিডেন্টের ভারত-সফরের সময়ে এতটা আগ্রহ ও প্রশ্নের সৃষ্টি করেনি। ভারত সরকারও শেখ হাসিনার এপ্রিল সফরের ওপর এতটাই গুরুত্ব দিয়েছে যে, এই প্রথমবারের মতো তার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে ভারতের প্রেসিডেন্ট ভবনে- যা এর আগে অন্য কোনো রাষ্ট্রীয় মেহমানের জন্য করা হয়নি। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে যে গুরুত্বসহকারে ভারতের রাজধানীতে স্বাগত জানানো হচ্ছে, তার সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের মধ্যে বিরাজিত সমস্যাগুলো যেগুলো দীর্ঘদিন যাবৎ অমীমাংসিত রয়েছে, সেগুলো সমাধানের কথা শোনা যাচ্ছে না। এসব সমস্যার মধ্যে রয়েছে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি, অসংখ্যবার গৃহীত সীমান্তে গুলি করে বাংলাদেশিদের হত্যা বন্ধের সিদ্ধান্ত না মেনে হত্যা করা চালিয়ে যাওয়া ও দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান ঘাটতি। এসব বিষয়ে সমাধানের কোনো আলোচনা শোনা যাচ্ছে না, বরং অন্যান্য বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময়ে দুই দেশের মধ্যে একাধিক চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের সম্ভাবনা রয়েছে।
তিস্তা পানি চুক্তি দীর্ঘদিন যাবৎ স্বাক্ষরিত না হওয়ায় বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে শুষ্ক মৌসুমে একেবারেই পানিশূন্যতা ও বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত পানি প্রবাহে বন্যা নিয়মিত ঘটনা হয়ে পড়েছে। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং ২০১১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। তার সফরের সময়েই তিস্তা পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের সময়ে তুচ্ছ অজুহাতে ঢাকায় আসেননি। শুধু তাই নয়, খসড়া চুক্তিতে পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থরক্ষা হয়নি বলে তিনি আপত্তি উত্থাপন করলে চুক্তি স্বাক্ষরের কর্মসূচি স্থগিত হয়ে যায়। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই সুদীর্ঘ ছয় বছরেও কেন্দ্রীয় সরকারের দ্বারা তৈরি করা চুক্তি পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থের অনুক‚ল কিনা, তা পরীক্ষা করতে পারেননি। ২৪ মার্চ বিভিন্ন সংবাদপত্রের প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায়, মমতা একটি টেলিভিশন চ্যানেলকে বলেছেন, আগামী ২৫ মে তিস্তা পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে বলে তিনি জানতে পেরেছেন। তবে কেন্দ্রীয় সরকার তাকে এ বিষয়ে কিছু জানায়নি। মমতা আবারও বলেছেন, চুক্তিতে পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থরক্ষা হয়েছে কিনা, তা তাকে দেখতে হবে। তিনি বাংলাদেশকে ভালোবাসেন, কিন্তু তিস্তা চুক্তিতে পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থ তাকে দেখতে হবে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বাংলাদেশকে এতটাই ভালোবাসেন যে, ছয় বছর যাবৎ তিস্তা চুক্তি কেন্দ্রীয় সরকারের হিমঘরে পড়ে রইলেও পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থ প্রস্তাবিত চুক্তিতে রক্ষা করা হলো কিনা তা দেখে চুক্তির ব্যাপারে তার আপত্তি প্রত্যাহার করতে তিনি আর কত বছর সময় নেবেন- তা অবশ্য বলেননি।
বিশ্ব পানি দিবস উপলক্ষে ২২ মার্চ আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের পানিসম্পদ মন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেছেন, তিস্তা চুক্তি অবশ্যই হবে, তবে ঠিক কবে হবে- তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তিস্তা চুক্তি সম্পাদনকে স্থগিত রেখে বাংলাদেশকে পানির ন্যায্য হিস্যা না দিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন ভারত সফরের সময়ে অন্যান্য সহযোগিতার ক্ষেত্রে প্রায় দুই ডজন চুক্তি বা সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের জন্য ভারতের উদ্বেগ, উদ্যোগ ও পদক্ষেপের যেসব প্রচেষ্টা দেখা যায়, তাতে এটা অত্যন্ত পরিষ্কার হয়ে ধরা পড়ে যে, তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষর তাদের অগ্রাধিকারের তালিকায় নেই। বিদ্যুৎ, জ্বালানি, বাণিজ্য, নৌ-চলাচল, সীমান্ত ও নিরাপত্তা খাতে সমঝোতা স্মারক বা চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য ভারত সরকার বিরাট প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। তবে বাংলাদেশের সাথে প্রতিরক্ষা খাতে একটি চুক্তিতে উপনীত হওয়ার ব্যাপারে ভারতের আগ্রহ ও উদ্যোগের কথাই সর্বাধিক আলোচিত হচ্ছে বাংলাদেশের নাগরিক সমাজে। বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারকটি সই হলে ভারত থেকে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা মূল্যের সমরাস্ত্র কিনবে বাংলাদেশ। পঞ্চাশ কোটি ডলারের সমপরিমাণ এই অর্থঋণ হিসেবে দেবে ভারত। সংবাদ মাধ্যম জানতে পেরেছে যে, প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফরের সময়ে সইয়ের জন্য ৪৯টি চুক্তি বা সমঝোতা স্মারক চ‚ড়ান্ত করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে তিস্তা চুক্তি নেই। পঞ্চাশ কোটি ডলার মূল্যের সমরাস্ত্র কেনা সম্পর্কিত চুক্তিটি ছাড়া প্রতিরক্ষা খাতে রয়েছে আরও নয়টি সমঝোতা স্মারক।
তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা বাংলাদেশকে যথাশীঘ্র দেয়ার জন্য ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে জোর তাগিদ দিয়েছেন ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার। ২৩ মার্চ আগরতলায় এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখার সময় তিনি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের আগেই প্রতিবেশী বাংলাদেশের সাথে সকল সমস্যা মিটিয়ে ফেলার আহŸান জানিয়েছেন। এর আগে ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ৯৭তম জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে কলকাতায় বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু বলেছেন, তিস্তা চুক্তি সই করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। ভারতের রাজনৈতিক দলগুলোর অনেক নেতাই তিস্তা চুক্তি সম্পাদনের জন্য ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি আহŸান জানালেও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তির কারণেই ড. মনমোহন সিং এবং নরেন্দ্র মোদির গত ছয় বছরের আমলেও চুক্তিটি স্বাক্ষর করা হয়নি।
অথচ প্রস্তাবিত চুক্তিটির কোন কোন ধারা পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থবিরোধী তা খুলে বলেননি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অন্যদিকে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারও তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকারের সাথে যোগাযোগ করে তাদের মতামত নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সাথে চুক্তি স্বাক্ষরের কোনো উদ্যোগও গ্রহণ করেনি। চূড়ান্তভাবে প্রস্তুত করা তিস্তা পানি বণ্টন চুক্তি কয়েক বছর যাবৎ পড়ে আছে স্বাক্ষরের অপেক্ষায়। আর পানির অভাবে বাংলাদেশের উত্তরের কয়েকটি জেলায় কৃষকদের মধ্যে হাহাকার চলছে। উত্তরের ওই কয়েকটি জেলাই আবার বর্ষায় অতিরিক্ত পানি ছেড়ে দেয়ায় বন্যাপ্লাবিত হয়ে যাচ্ছে প্রতি বছর। তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা পাওয়ার দাবিতে আর বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত পানি ছাড়ার প্রতিবাদে বাংলাদেশের প্রতিটি রাজনৈতিক দল বিক্ষোভ প্রতিবাদ-সমাবেশ, মানববন্ধন, লংমার্চ ইত্যাদি করেছে। ২৫ মার্চ সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায়, ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখ্যপাত্র গোপাল বাগলে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে আশ্বস্ত করে বলেছেন, রাজ্য সরকারের সাথে পরামর্শ করেই তিস্তা পানি বণ্টন চুক্তি পুনরায় চ‚ড়ান্ত করা হবে।
অর্থাৎ গত ছয় বছর যাবৎ ভারতীয় কেন্দ্রীয় ও রাজ্য কর্তৃপক্ষ তিস্তা চুক্তি যা ছিল কেবল দুই প্রধানমন্ত্রীর স্বাক্ষরের অপেক্ষায়Ñ সেটি নিয়ে কোনো চিন্তাভাবনাই করেননি। অথচ তিস্তার পানি ছাড়া বাংলাদেশের কয়েকটি জেলায় কোনো ফসল ফলানো যাচ্ছে না, তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি না থাকা সত্তে¡ও ভারতকে অন্যান্য ক্ষেত্রে সহযোগিতা দানের জন্য প্রধানমন্ত্রীর সফরের সময়ে মোট ৪৯টি সমঝোতা স্মারক বা চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য ভারত সরকারের প্রয়াস যেসব প্রশ্নের জন্ম দিয়েছেÑ সেটি হলো ভারত কি কেবল নেবেÑ কিছুই দেবে না? একটি জাতীয় দৈনিকের উদ্যোগে ২৭ মার্চ অনুষ্ঠিত গোলটেবিল বৈঠকে এ সম্পর্কে প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত শামীম আহমদ বলেন, ‘তিস্তা একটি বড় সমস্যা। সাধারণ মানুষ যারা বাণিজ্য বোঝে না, কানেকটিভিটি বোঝে নাÑ তারা কিন্তু পানি বণ্টনের বিষয়টি বোঝে। প্রতিরক্ষা চুক্তি হোকÑ সমঝোতা হোক, যাই হোক না কেন, পানি না পেলে মানুষ সত্যি হতাশ হবে। তিস্তার ব্যাপারে এই সফরে কোনো প্রক্রিয়া বা সমঝোতার সুযোগ নেইÑ কারণ একটা পানি চুক্তি এভাবে হয় নাÑ এখানে কোনো উদ্যোগ নেই।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক ও কলাম লেখক আসিফ নজরুল বিবিসিকে বলেছেন, ‘আসন্ন সফরে ভারত থেকে প্রধানমন্ত্রী যদি কিছু নিয়ে না আসতে পারেন, বিশেষ করে তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে, তাতে করে দেশের রাজনীতিতে এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে যে, তিনি ভারতের কাছে সবকিছু সমর্পণ করে এসেছেন।’
বাস্তবিকপক্ষেই তিস্তাসহ ৫৪টি নদীÑ যেগুলো এসেছে ভারত থেকে আর বয়ে গেছে বাংলাদেশের ভেতর দিয়েÑ সেগুলোর পানি সুষম বণ্টনের মধ্যে বাংলাদেশের কৃষি, পরিবেশ, জলবায়ু পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকার নিশ্চয়তা নির্ভর করে। এই কথাটি বোঝার ব্যাপারটায় কোনো পানি বা পরিবেশ বিজ্ঞানীর প্রয়োজন হয় না। সবচেয়ে পরিতাপের বিষয় এই যে, ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর থেকে তিস্তা পানি চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য অপেক্ষমাণ। এখন তাকে অপেক্ষমাণ রেখেই অন্যান্য ক্ষেত্রে ৪৯টি সমঝোতা স্মারক বা চুক্তি স্বাক্ষরিত হতে যাচ্ছে বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। কী পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ একাধিক ক্ষেত্রে এসব সমঝোতা বা চুক্তির ব্যাপারে সম্মত হয়েছে, তা সাধারণ জনগণের কাছ বোধগম্য নয়। তারা বোঝে আমরা কী দিলাম আর কী পেলাম। সরকারের অবস্থা হচ্ছে এমন যে, ‘কৃষকের ধান ক্ষেত নষ্ট করে হাঁটছে একজন। কৃষক দৌড়ে এসে বললো আর হাঁটবেন না, ফসল নষ্ট হবে। ক্ষেতের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি বলল- তাহলে সোজা বেরিয়ে যাই। কৃষক বলল- উহু! শস্য নষ্ট হবে। লোকটি বলল, তাহলে ডান দিক দিয়ে বেরিযে যাই। কৃষক বলল- তাহলেও ফসলের ক্ষতি হবে। লোকটি বলল- তাহলে বাঁ দিক দিয়ে বেরিয়ে যাই। কৃষক বলল- তাহলেও ফসল নষ্ট হবে। লোকটি বলল, তাহলে যেভাবে ঢুকেছি সেভাবেই বেরিয়ে যাই। কৃষক সজোরে মাথা নেড়ে বলল- তাতে নতুন করে আরো ক্ষতি হবে। তখন লোকটি বলল- তাহলে কী করব- কৃষক মহাবিরক্ত হয়ে বলল, আপনি কিছুই করবেন না।’
লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন