বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আদিগন্ত

পহেলা বৈশাখে জানা-অজানার মাঝে করণীয় ও বর্জনীয়

| প্রকাশের সময় : ৭ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০০ এএম

রিয়াজুল ইসলাম রিয়াজ
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
এদেশের মানুষের জীবনের বাংলা বর্ষপঞ্জি ছিল এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য কৃষি ও কর্ম এ পঞ্জিকা অনুসারেই চলত। এ কারণে পহেলা বৈশাখ হালখাতা বা অনুরূপ কিছু আনন্দ বা অনুষ্ঠান ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু বর্তমানে আমাদের জীবনের কোথাও বঙ্গাব্দের কোনো প্রভাব নেই। কাগজেকলমে যাই লেখা হোক, প্রকৃতপক্ষে আমরা নির্ভর করছি খ্রিস্টীয় পঞ্জিকা তথা গ্রেগরিয়ান পঞ্জিকার ওপর। যে বাংলা বর্ষপঞ্জি আমরা বছরের ৩৬৪ দিন ভুলে থাকি, সে বর্ষপঞ্জির প্রথম দিনে আমরা সবাই ‘বাঙালি’ সাজার চেষ্টা করে এ নিয়ে ব্যাপক হৈচৈ করি। আর এ সুযোগে দেশীয় ও বিদেশি বণিকগণ তাদের ব্যবসা বা আদিপত্য প্রসারের জন্য এ দিনটিকে কেন্দ্র করে বেহায়াপনা-বেলেল্লাপনা, অশ্লীলতা, অনৈতিকতা ও অধার্মিকতার প্রচার করে।
এটাও সত্য যে, পাশ্চাত্য সভ্যতার অনেক ভালো দিক আছে। কর্মস্পৃহা, মানবাধিকার, আইনের শাসন ইত্যাদি অনেক গুণ তাদের মধ্যে বিদ্যমান। পাশাপাশি তাদের কিছু দোষও আছে যা তাদের সভ্যতার ভালো দিকগুলো ধ্বংস করে দিচ্ছে। এ দোষগুলোর অন্যতম হলো মাদকতা, বেহায়াপনা ও অশ্লীলতা। আমরা বাংলাদেশের মানুষের মাঝে পাশ্চাত্যের কোনো ভালো গুণ প্রসার করতে পারিনি বা চাইনি। তবে তাদের অশ্লীলতা, বেহায়াপনা ও মাদকতার ধ্বংসাত্মক দিকগুলো আমরা খুব আগ্রহের সাথে গ্রহণ করতে ও প্রসার করতে চাচ্ছি। এ জন্য খ্রিস্টীয় পঞ্জিকার শেষ দিনে ও প্রথম দিনে থার্টিফার্স্ট নাইট ও নিউ-ইয়ারস ডে বা নববর্ষ উপলক্ষে আমাদের বেহায়াপনার শেষ থাকে না। পক্ষান্তরে আমাদের দেশজ সংস্কৃতির অনেক ভালো দিক রয়েছে। সামাজিক শিষ্টাচার, সৌহার্দ্য, জনকল্যাণ, মানবপ্রেম ইত্যাদি সকল মূল্যবোধ আমরা সমাজ থেকে তুলে দিচ্ছি। পক্ষান্তরে দেশীয় সংস্কৃতির নামে অশ্লীলতার প্রসার ঘটানো হচ্ছে। বেপর্দা, বেহায়াপনা, অশ্লীলতা, মাদকতা, অনৈতিকতা ও অপরাধ একসূত্রে গাঁথা। যুবক-যুবতীদেরকে অবাধ মেলামেশা ও বেহায়াপনার সুযোগ দিবেন, অথচ তারা অশ্লীলতা, ব্যভিচার, মাদকতা ও অপরাধের মধ্যে যাবে না, এরূপ চিন্তা করার কোনো সুযোগ নেই। অন্যান্য অপরাধের সাথে অশ্লীলতার পার্থক্য হলো কোনো একটি উপলক্ষে একবার এর মধ্যে নিপতিত হলে সাধারণভাবে কিশোর-কিশোরী ও যুবক-যুবতীরা আর এ থেকে বেরোতে পারে না। বরং ক্রমান্বয়ে আরো বেশি পাপ ও অপরাধের মধ্যে নিপতিত হতে থাকে। কাজেই নিজে এবং নিজের সন্তান ও পরিজনকে সকল অশ্লীলতা থেকে রক্ষা করার সময় এখনই। আল্লাহতায়ালা বলেছেন : “তোমরা নিজেরা জাহান্নাম থেকে আত্মরক্ষা কর এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা কর”। রাসূল (সা.) বলেছেন : “তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং তোমাদের প্রত্যেককেই তার দায়িত্বাধীনদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা কর হবে।”
তাই নববর্ষ তথা পহেলা বৈশাখ অথবা থার্টিফার্স্ট নাইট কিংবা অন্য কোনো উপলক্ষে সন্তানদেরকে বেহায়াপনা ও বেপর্দা, মাদকতা, জুয়া ও অশ্লীলতার প্রশ্রয় দিব না। তাদেরকে ইসলামের সঠিক জ্ঞান দিয়ে নিয়ন্ত্রণে রাখব। আমি নিজে তাসবি, জায়নামাজ, জামা-টুপি পড়ে মসজিদে ছুটব আর আমার সন্তান নববর্ষ ও থার্টিফার্স্ট নাইট পালনের নামে বেহায়াপনা ও বেলেল্লাপনা, মাদকতা, জুয়া, অশ্লীলতা এবং অনৈতিকতা ও অধার্মিকতায় জড়িয়ে পড়বে, তা কখনো হতে দেয়া যাবে না। তাদের প্রতিটি পাপের দায়ভার আমার ওপর বর্তাবে। কাবিলের আমলনামায় পৃথিবীর প্রতিটি হত্যাযজ্ঞের জন্য একটি পাপ লিখিত হবে। তাই যদি হয় তাহলে কেন আমার সন্তানের পাপের একটি অংশ আমার ওপর বর্তাবে না? ভাববার সুযোগ আছে। সংশোধনের সময় আছে (?)। এখানেই শেষ নয়, অন্য পাপ আর অশ্লীলতার পার্থক্য হলো, যে ব্যক্তি তার স্ত্রী-সন্তানের বেহায়াপনার সুযোগ দেয় তাকে ‘দাইউস’ বলা হয়। রাসূল (সা.) বারবার বলেছেন যে, “দাইউস ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।”
নিজেকে এবং নিজের পরিবার-পরিজনকে রক্ষা করার পাশাপাশি মুমিনের দায়িত্ব হলো সমাজের মানুষদেরকে সাধ্যমতো ন্যায়ের পথে ও অন্যায় বর্জনে উদ্বুদ্ধ করা। কাজেই পহেলা বৈশাখ ও অন্য যে কোনো উপলক্ষে সন্তানের অবাদ মেলামেশা ও বেহায়াপনার ক্ষতি, অন্যায় ও পাপের বিষয়ে সবাইকে সচেতন করুন। যদি আপনি তা করেন তবে কেউ আপনার কথা শুনুক অথবা না শুনুক আপনি আল্লাহর কাছে অফুরন্ত সাওয়াব লাভ করবেন, মুক্তি পাবেন। আর যদি আপনি তা না করেন তবে এ পাপের গজব আপনাকেও স্পর্শ করবে। কোরআন ও হাদিসে বিষয়টি বারংবার বলা হয়েছে। ব্যবসায়িক, প্রশাসনিক, রাজনৈতিক বা সামাজিক কোনো স্বার্থে অনেক মুসলিম পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে ছেলেমেয়েদের অবাধ মেলামেশা ও বেহায়াপনার পথ খুলে দেওয়ার জন্য মিছিল, মেলা, পটকা ও আতশবাজি ইত্যাদির পক্ষে অবস্থান নেয়াটা আপনার ইহকাল ও পরকালের জন্য এরচেয়ে ভয়ঙ্কর আর কিছুই হতে পারে না। অশ্লীলতা প্রসারের ভয়ঙ্কর পাপ ছাড়াও ভয়ঙ্কর শাস্তি সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেন : “যারা চায় যে, মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রচার ঘটুক তাদের জন্য পৃথিবীতে এবং আখিরাতে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। আর আল্লাহ জানেন, তোমরা জান না” (নুর : ১৯)।
তাই কখন কীভাবে আপনার ও আপনার পরিবারের জীবনে ‘যন্ত্রণাদায়ক শস্তি’ নেমে আসবে তা আপনি বুঝতেও পারবেন না। আপনার রাজনৈতিক, সামাজিক, ব্যবসায়িক বা অন্য কোনো স্বার্থ উদ্ধারের জন্য সঠিক পথ অনুসরণ করুন। সঠিকভাবে ইসলামকে জানুন এবং মানুন, তবে কখনই অশ্লীলতা প্রসার ঘটে এরূপ কোনো বিষয়কে আপনার স্বার্থ উদ্ধারের বাহন বানাবেন না। মহান আল্লাহ আমাদেরকে হেফাজত করুন।

বৈশাখ মাসকে নববর্ষের মাস হিসেবে নির্ধারণ করার পূর্বে অগ্রহায়ণ মাসে ধান কাটা শুরু হতো বলে এই মাসকে বছরের প্রথম মাস ধরা হতো। তাই এ মাসের নামই রাখা হয় অগ্রহায়ণ। অগ্র অর্থ প্রথম আর হায়ণ অর্থ বর্ষ বা ধান। স¤্রাট আকবরের সময়ে একটি বিষয় ছিল অত্যন্ত কষ্টসাধ্য, তা হলো মাসের ৩০টি দিনের জন্য আলাদা আলাদা ৩০টি নাম ছিল। যা প্রজাদের মনে রাখা খুবই কষ্ট হতো। তাই সম্রাট শাহজাহান ৭ দিনে সপ্তাহভিত্তিক বাংলায় দিনের নামকরণের কাজ শুরু করেন। ইংরেজি বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় ইংরেজি ৭ দিনের নামের কিছুটা আদলে বাংলায় ৭ দিনের নামকরণ করা হয়। যেমন : সানডে- রবিবার। সান অর্থ রবি বা সূর্য আর ডে অর্থ দিন। এভাবে বর্ষ গণনার রীতিকে বাংলায় প্রবর্তনের সংস্কার শুরু হয় মুঘল আমল থেকেই।
আর বাংলায় বারো মাসের নামকরণ ছিল হিন্দু সৌর পঞ্জিমতে, বাংলায় বারোটি মাস অনেক আগে থেকেই পালন হয়ে আসছে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, বঙ্গাব্দের বারো মাসের নামকরণ করা হয়েছে নক্ষত্র মÐলের চন্দ্রের আবর্তনে বিশেষ তারকার অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে। এই নামসমূহ গৃহীত হয়েছে জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক প্রাচীন গ্রন্থ সূর্যসিদ্ধান্ত থেকে। বাংলা মাসের নামগুলো বিভিন্ন তারকারাজির নাম থেকে নেওয়া হয়েছে। যেমন : বৈশাখ ও জ্যেষ্ঠা নক্ষত্রের নামানুসারে বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাসের নাম। উত্তর ও পূর্ব আষাঢ়া নক্ষত্রের নামানুসারে আষাঢ় মাসের নাম। শ্রবণা নক্ষত্রের নামানুসারে শ্রাবণ মাসের নাম। উত্তর ও পূর্ব ভাদ্রপদ নক্ষত্রের নামানুসারে ভাদ্র মাসের নাম। আশ্বিনী নক্ষত্রের নামানুসারে আশ্বিন মাসের নাম। কৃত্তিকা নক্ষত্রের নামানুসারে কার্তিক মাসের নাম। মৃগশিরা নক্ষত্রের নামানুসারে অগ্রহায়ণ মাসের নাম। পুষ্যা নক্ষত্রের নামানুসারে পৌষ মাসের নাম। মঘা নক্ষত্রের নামানুসারে মাঘ মাসের নাম। উত্তর ও পূর্ব ফাল্গুনী নক্ষত্রের নামানুসারে ফাল্গুন মাসের নাম এবং চিত্রা নক্ষত্রের নামানুসারে চৈত্র মাসের নাম।
তবে স¤্রাট আকবর কর্তৃক প্রবর্তিত তারিখ-ই-ইলাহীর মাসগুলোর নাম ছিল ফার্সি ভাষায় যেমন : ১. ফারওয়াদিন, ২. আর্দি, ৩. ভিহিসু, ৪. খোরদাদ, ৫. তির, ৬. আমারদাদ, ৭. শাহরিয়ার, ৮. আবান, ৯. আযুর, ১০. দাই, ১১. বহম এবং ১২. ইসকানদার মিজ। (শেষ)
য় লেখক : পিএইচডি গবেষক ও প্রাবন্ধিক
ৎবধুরঁশ@মসধরষ.পড়স

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
ইবরাহীম ফরহাদ ১২ এপ্রিল, ২০১৯, ৬:৪৬ এএম says : 0
উপরের অর্ধের লেখা "ডঃ খোন্দোকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহিমাহুল্লাহ)" এর বই থেকে কপি করা। নিচের বাকিটুকু কার বই থেকে নেয়া??
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন