আবুল কাসেম হায়দার : দেশে এখন শেয়ারবাজার বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। মানুষের আগ্রহ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ আগ্রহ কম। অধিকাংশ বিনিয়োগকারী স্বল্প সময়ের মধ্যে অধিক লাভ করতে চায়। ১৯৯৮ সাল ও ২০০৯ সাল এই দুইবার শেয়ারবাজারে ধস নামে। তাতে অনেক বিনিয়োগকারী বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেকে শেয়ারবাজার থেকে নিজকে গুটিয়ে নিয়েছেন। ইদানীং শেয়ার ব্যবসা কিছুটা তেজী ভাব হওয়াতে কিছু কিছু বিনিয়োগকারী আবারও ফিরে এসেছেন। তবে এই ব্যবসায় দীর্ঘমেয়াদি টিকে থাকার জন্য সরকারকে কৌশলগত সুবিধা দিতে হবে।
কিন্তু কিছু কিছু তালিকাভুক্ত কোম্পানির আচরণ তেমন ভালো নয়। ইদানীং শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত বেশিরভাগ কোম্পানিই শেয়ারবাজার থেকে টাকা নিয়ে ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করছে। এর মাধ্যমে উদ্যোক্তারা নিজেদের ব্যাংক ঋণের দায় বিনিয়োগকারীদের ওপর চাপাচ্ছেন। গত তিন বছরে অনুমোদন পাওয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে ২৩টি কোম্পানি শেয়ারবাজার থেকে প্রায় ৬শ কোটি টাকা নিয়ে ব্যাংক ঋণ শোধ করেছে। এ সময়ে কোম্পানিগুলো শেয়ারবাজার থেকে ১ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে। অর্থাৎ বাজার থেকে সংগ্রহ করা মূলধনের প্রায় অর্ধেকই ব্যাংকের দায় পরিশোধে ব্যয় হয়েছে। এতে যে উদ্দেশ্যে শেয়ারবাজার থেকে মূলধন সংগ্রহ করা অর্থাৎ কোম্পানিগুলোর আয় বৃদ্ধি- তা হয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের কাজ যৌক্তিক নয়। ফলে বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
দেশে শিল্পায়নের জন্য আইপিও (প্রাথমিক শেয়ার) অনুমোদন জরুরি। কিন্তু শেয়ারবাজার থেকে টাকা নিয়ে ব্যাংক ঋণ পরিশোধের বিষয়টি গ্রহণযোগ্য নয়। তার মতে, যেসব কোম্পানি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বছরের পর বছর শোধ করতে পারছে না, ওই কোম্পানিই শেয়ার বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ করছে। এর মাধ্যমে উদ্যোক্তারা তাদের ঋণের দায় বিনিয়োগকারীদের ওপর চাপাচ্ছে। এটা বন্ধ হওয়া উচিত। ব্যাংক ঋণ পরিশোধে আইপিওর অনুমোদন না দিতে স্টক এক্সচেঞ্জের পক্ষ থেকে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কাছেও অনুরোধ জানানো হয়েছে।
শেয়ার বিক্রি করে পুঁজি সংগ্রহের উদ্দেশ্য হলোÑ কোম্পানির ব্যবসায়িক কার্যক্রম সম্প্রসারণের মাধ্যমে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি। শেয়ারবাজারে আসার আরেকটি উদ্দেশ্য হলো- কোম্পানির আর্থিক সক্ষমতা বাড়িয়ে বিনিয়োগকারীদের ভালো লভ্যাংশ দেয়া। বিশ্বব্যাপী এ ধারণা থেকেই শেয়ারবাজারের জন্ম। কিন্তু বাংলাদেশে এর ব্যতিক্রম ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। পুঁজি বা মূলধন সংগ্রহের পর বেশিরভাগ কোম্পানিই ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করে। অর্থাৎ উদ্যোক্তারা আগে ঋণ নিয়ে যে দায় সৃষ্টি করেছেন, তা চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের ওপর। এতে কোম্পানিগুলো বিনিয়োগকারীদের ভালো লভ্যাংশ দিতে পারছে না।
আর আইনি বাধ্যবাধকতা না থাকায় গত তিন বছরে শেয়ারবাজার থেকে টাকা নিয়ে ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করেছে এ ধরনের কোম্পানির সংখ্যা ২৩টি। এসব কোম্পানি প্রিমিয়ামসহ বাজার থেকে ১ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে। এরমধ্যে ব্যাংক ঋণ পরিশোধে ব্যয় করেছে ৫৯৩ কোটি টাকা। কোম্পানিগুলোর মধ্যে শেফার্ড ইন্ডাস্ট্রি ৪ কোটি ৪৫ লাখ টাকা, প্যাসেফিক ডেনিমস ২৫ কোটি টাকা, ডরিন পাওয়ার ১৯ কোটি টাকা, ইনফরমেশন টেকনোলজি ৪ কোটি, কেডিএস এক্সেসরিজ ৭ কোটি, আমান ফিড ৫ কোটি, বাংলাদেশ স্টিল রি-রোলিং ২০ কোটি ৪০ লাখ, শাশা ডেনিম ১৮ কোটি ২২ লাখ, সি অ্যান্ড এ টেক্সটাইল ৪৫ কোটি ৩১ লাখ, হামিদ ফেব্রিকস ৩১ কোটি, খান ব্রাদার্স পিপি ২ কোটি, ওয়েস্টার্ন মেরিন ১৩০ কোটি, রতনপুর স্টিল রি-রোলিং ৭৫ কোটি টাকা, সুরিদ ইন্ডাস্ট্রিজ ৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা, ফারইস্ট নিটিং ৫৪ কোটি ২ লাখ টাকা, মোজাফফর হোসেন স্পিনিং মিল ২৬ কোটি ১৪ লাখ টাকা, তুং হাই নিটিং ১৬ কোটি, খুলনা প্রিন্টিং ৩০ কোটি টাকা, শাহজিবাজার পাওয়ার ৩১ কোটি ৭০ লাখ, পেনিনসুলা চিটাগং ১৩ কোটি ৩২ লাখ টাকা এবং এমারেল্ড অয়েল ২০ কোটি ১২ লাখ টাকা ঋত পরিশোধে ব্যবহার করেছে।
আইপিওর সব টাকা দিয়ে ঋণ পরিশোধ সঠিক নয়। এটি বিএসইসিকে নজরদারি করতে হবে। অনেক কোম্পানি আছে আইপিওর টাকা অন্য খাতে খরচ করে। এতে কোম্পানির আয় বাড়ে না। বিষয়টি তদন্ত করে বিএসইসিকে ব্যবস্থা নিতে হবে। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির পর অনেক কোম্পানিরই আয় কমছে। ২০১১ সালে মবিল যমুনা তালিকাভুক্ত হয়। ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের শেয়ারে প্রিমিয়ামসহ ১১৫ টাকা নেয়া হয়। তালিকাভুক্তির আগে ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) ছিল ৩ টাকা ৬২ পয়সা। পরের বছর অর্থাৎ ২০১১ সালে রিস্টেট ধরেই প্রতিষ্ঠানটির ইপিএস ৩ টাকা ৭ পয়সায় নেমে আসে। ২০১২ সালে ইপিএস ছিল ২ টাকা ৭৩ পয়সা এবং ২০১৩ সালে ২ টাকা ৯৩ পয়সা। এছাড়া একই বছরে ১০ টাকার শেয়ার ১০১ টাকায় বাজারে তালিকাভুক্ত হয় এমআই সিমেন্ট। ওই বছর প্রতিষ্ঠানটির ইপিএস ছিল ৪ দশমিক ০৭ টাকা। পরের বছর তা ১ টাকা ৮৭ পয়সায় নেমে এসেছে। ২০১২ সালে ১০ টাকার শেয়ারে আরও ৫০ টাকা প্রিমিয়ামসহ ৬০ টাকায় বাজারে তালিকাভুক্ত হয় ওরিয়ন ফার্মা। ওই বছর প্রতিষ্ঠানটির ইপিএস ছিল ৬ টাকা ২ পয়সা। পরের বছর অর্থাৎ ২০১৩ সালে তা কমে ৪ টাকা ৬ পয়সায় নেমে এসেছে।
২০১১ সালে বাজারে আসে আমরা টেকনোলজি। ওই বছর কোম্পানিটির ইপিএস ছিল ২ টাকা ৬৩ পয়সা। কিন্তু ২০১২-তে ২ টাকা ৪৬ পয়সায় নেমে আসে। ২০০৭ সালে কোম্পানিটির ইপিএস ছিল ১৪ টাকা ১৯ পয়সা। পরের বছর নেমে আসে ১০ টাকা ৫৫ পয়সায়। আর্গন ডেনিমের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা। ২০১১ সালের ৫ টাকা ৪৬ পয়সার ইপিএস ২০১২ সালে নেমে এসেছে ৪ টাকা ৫১ পয়সায়। বেঙ্গল উইন্ডসর থার্মো প্লাস্টিকের ২০১১-১২ সালের ইপিএস ছিল ৩ টাকা ৫৬ পয়সা। ২০১২-১৩ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে এর ইপিএস দাঁড়িয়েছে ২ টাকা ৩১ পয়সা। তালিকাভুক্তি নিয়ে নানা ঘটনার জন্ম দেয় অ্যাপোলো ইস্পাত। কোম্পানিটি ১২ টাকা প্রিমিয়ামসহ ২২ টাকা আইপিও মূল্যে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। কিন্তু তালিকাভুক্তির পরপরই কোম্পানির ইপিএস কমতে থাকে। একইভাবে কমছে মোজাফ্ফর হোসাইন স্পিনিং মিলস, খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং এবং এমারেল্ড অয়েলের ইপিএস।
কারণ ব্যাংক ঋণ শোধের পর কোম্পানির আর্থিক অবস্থা অবশ্যই ভালো হওয়ার কথা। ঋণ শোধ হলে তার দায় কমে। এতে মুনাফা বাড়ে। কিন্তু আয় কমলে তা গ্রহণযোগ্য নয়।
যা করণীয় : ১. বিএসইসিকে আরও শক্তিশালী সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে দৃঢ়তার পরিচয় দিতে হবে। বিশেষ করে আইপিও আসার সময় কোম্পানিগুলোকে প্রিমিয়াম নিয়ে আইপিও আসার নিয়ম বন্ধ করতে হবে। অবিলম্বে এই নিয়মটি আইনের মাধ্যমে বন্ধ করা প্রয়োজন। তা না হলে বিনিয়োগকারীগণ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষা করার দায়িত্ব বিএসইসির ওপর বর্তায়।
২. ব্যাংক ঋণ শোধ করে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর এই প্রবণতা ও কার্যক্রমকে অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। বিএসইসি যখন আইপিও অনুমতি দিবেন তখন ব্যাংক ঋণ পরিশোধ না করার বিধান অবশ্যই শর্ত হিসেবে যুক্ত করবেন। বর্তমানেও বিএসইসি অফিসিয়াল আদেশের মাধ্যমে কোম্পনিগুলোর এই খারাপ কার্যক্রমকে বন্ধ করতে পারেন।
৩. শেয়ারবাজারকে স্থিতিশীল, গতিময় ও বিনিয়োগকারীগণের অনুক‚লে নেয়ার জন্য বিএসইসিকে নতুন নতুন কৌশল, উদ্যোগ ও নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। স্বচ্ছতার সঙ্গে কার্যক্রম পরিচালনা খুবই জরুরি। দেশের এই খাতকে শক্তিশালী করতে পারলে শিল্প-বাণিজ্যে প্রসার ঘটবে। নতুন নতুন শিল্প স্থাপনে ও সম্প্রসারণে শেয়ারবাজার ছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই। জাতির বৃহত্তর স্বার্থে এই খাতের উন্নয়ন অপরিহার্য।
৪. আমাদের দেশে দুর্নীতি, অনিয়ম ও অস্বচ্ছতা একটা নিয়মে পরিণত হয়েছে। এই জন্য সকলকে সমান ও সক্রিয় হতে হবে। বিশেষ করে বাংলাদেশ সিকিউরিটি এক্সচেইঞ্জ এন্ড কমিশন (বিএসইসি)-কে দুর্নীতির ঊর্ধ্বে থাকতে হবে। সকল প্রকার অনিয়ম, দুর্নীতি থেকে বিএসইসিকে মুক্ত থাকতে হবে।
য় লেখক : সাবেক সহসভাপতি এফবিসিসিআই, বিটিএমএ, বিজেএমইএ, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন