তৈমূর আলম খন্দকার : পৃথিবীর সব কিছুই রাজনীতির আওতায়। অথচ রাজনীতিই এখন রাষ্ট্রযন্ত্র কর্তৃক তো বটেই, বিচার বিভাগ থেকে শুরু ক্ষেত্রে সব ক্ষেত্রেই একটি নাক ছিটকানো অবস্থায় পড়েছে। রাজনীতি ছিল বলেই দেশটি দু’বার স্বাধীন হয়েছে, রাষ্ট্রভাষা বাংলা হয়েছে, ২১ ফেব্রæয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার স্বীকৃতি লাভ করেছে, মূলত আমরা স্বাধীন দেশের একজন নাগরিক হিসেবে একটি পরিচিতি লাভ করেছি।
রাজনীতির উদ্দেশ্য কী? ‘যুক্তির স্বার্বভৌমিকতা’ অর্থাৎ ঝড়াবৎরহরঃু ড়ভ জবধংড়হ বলতে একটি প্রবাদ চালু রয়েছে। যুক্তিকে যুক্তি দিয়ে খÐানোর পরিবর্তে গায়ের জোরে চাপিয়ে দেয়াটাই যদি রাজনীতি হয়ে থাকে তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমরা সঠিক পথেই আছি বলে ধারণা করা ভুল হবে না। কারণ, আইন প্রদত্ত নাগরিক এবং জন্মগত অধিকার যা-ই থাকুক না কেন জনগণ সে অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, তাও আবার রাজনীতির ব্যানারে।
দেশে এখন নিরপেক্ষ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোও রাজনীতির ব্যানারে সরকার তোষণনীতির কারণে বিরোধী দলকে নিগৃহীত, নিষ্পেষিত করছে তাও নীতিকথার মাধ্যমে। সাংবিধানিক চেয়ারে বসে মানুষ যখন খেই হারিয়ে ফেলে শুধু তার চেয়ারকে ঠিক রাখার জন্য তখন জনগণকে মুখ বুঝে সবকিছু সহ্য করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। মিথ্যার বেসাতি শুনতে শুনতে এখন মানুষ টায়ার্ড, বীতশ্রদ্ধ। মুদ্রার ওপিঠ নিয়ে যদি আলোচনায় আসি তবে বলতে হয় যে, গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার জন্য রাজনীতির যে লড়াই তাও একটি পর্যায়ে টায়ার্ড হয়ে পড়েছে। কারণ সরকারে যারা থাকে তারা তো গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে তাদের নিজেদের স্বার্থে, কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে দলগুলোর ভেতর থেকে গণতন্ত্র বা রাজনীতির চর্চা প্রাধান্য না পেয়ে তোষণনীতিই বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে। অন্যদিকে টাকার প্রভাবে রাজনীতিবিদদের নাভিশ্বাস উঠে গেছে। টাকাওয়ালাদের হাতে চলে গেছে রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ। রাজনীতির চর্চার অভাব এবং তোষণনীতির প্রভাবে টাকাওয়ালারা দলের নিয়ন্ত্রক হওয়ায় তৃণমূল থেকে উঠে আসা রাজনীতিবিদরা এখন কোণঠাসা। অন্যদিকে গোয়েন্দাদের পছন্দ-অপছন্দ রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে।
রাজনীতিতে ‘নীতি’ বলতে এখন কোনো বিষয় নেই। ‘নীতিহীনতাই’ এখন রাজনীতিবিদ হওয়ার যোগ্যতার মাপকাঠি; যদি টাকার সাথে তোষামোদি করার গুণাগুণে তিনি পরিপক্ব হয়ে থাকেন।
রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণভাবে বদলে গেছে। কোনো কোনো দল তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের কদাচিৎ মতামতকে মূল্যায়ন করলেও অধিকাংশ দলই নিজ মতকে চাপিয়ে দেয়, ফলে সফলতা যদি আসে তবে যারা ফল ভোগ করার তারাই ফল ভোগ করে, কিন্তু ব্যর্থতা যদি আসে তবে ঘানি টানতে হয় তৃণমূলকে যারা মাঠে-ময়দানে থেকে জীবনের রিস্ক গ্রহণ করে। রাজনৈতিক দল থেকে বারবারই বলা হয় যে, কর্মের মূল্যায়ন হবে, কিন্তু মূল্যায়িত হয় তারাই যারা টাকা ঢালতে পারে। টাকার কাছে কর্মীর মূল্যায়ন ঢাকা পড়ে যায়।
রাজনীতি যদি জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে না পারে তবে সে রাজনীতি আর এগোতে পারে না। জনগণই রাজনীতির চালিকাশক্তি। অথচ রাজনীতিতে জনগণই উপেক্ষিত। সরকার এখন রাজনীতিকে রাজনীতি দিয়ে মোকাবেলা করে না। ‘সরকার’ দিনে দিনে তার নিজস্ব চরিত্রের ‘পরিস্ফুটন’ ঘটিয়েছে যার তীব্রতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার ফলে স্টিমরোলার গড়াচ্ছে প্রতিপক্ষের ওপর; যার ছোঁয়া থেকে সাধারণ জনগণ রক্ষা পাচ্ছে না। ‘সরকার’কে এখন জনগণনির্ভর থাকতে হয় না। দলকে বর্তমানে কর্মীনির্ভর থাকতে হয় না। দলগুলোর অনৈতিক বিবর্তনের কারণে কর্মীরা কর্মচারীতে পরিণত হচ্ছে। ঘুরেফিরে টাকাওয়ালাদের প্রভাবে কর্মীরা কর্মচারী বনে যাচ্ছে। দলের নেতৃত্বের প্রশ্নে পূর্বে একজন কর্মী বা নেতার ইধপশমৎড়ঁহফ বিবেচনায় আসত; কিন্তু বর্তমানে বিবেচনা হয় টাকা ও টাকা। এ টাকাওয়ালা শেয়ার মার্কেট লুটেরা না ব্যাংক লুটেরা তা দেখার ফুরসত হাইকমান্ডের নেই। কোনো কারণে যদি দলের বিপর্যয় নেমে আসে তখন টাকাওয়ালাদের আর খুঁজে পাওয়া যায় না, যার নির্মম অভিজ্ঞতা স্বনামধন্য দলগুলোর রয়েছে, তবে শিক্ষা হয়নি।
রাজনীতি কতটুকু জনগণ গ্রহণ করল তার যাচাই হয় ‘নির্বাচন’ নামক পরীক্ষার মাধ্যমে। আভিধানিক ভাষা বা আইনের ভাষার সাথে বাস্তবতার কোনো মিল পাওয়া যাচ্ছে না। যেমন বাংলাদেশের সংবিধানে আর্টিকেল ৬৫(২)-তে বলা হয়েছে যে : ‘একক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকাসমূহ হইতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে আইনানুযায়ী নির্বাচিত তিন শত সদস্য লইয়া এবং এই অনুচ্ছেদের (৩) দফার কার্যকরতাকালে উক্ত দফায় বর্ণিত সদস্যদিগকে লইয়া সংসদ গঠিত হইবে; সদস্যগণ সংসদ সদস্য বলিয়া অভিহিত হইবেন।’
‘প্রত্যক্ষ ভোট’ বলতে এত দিন আমরা যা বুঝতাম তা হচ্ছে একটি স্বচ্ছ ভোট, যাতে ভোটার তথা জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটে; যার ব্যত্যয় হওয়ায় অনেক আন্দোলন-সংগ্রামের ফলশ্রæতিতে সংবিধানে নির্দলীয় তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ধারা সংযোজন করা হয়েছিল। কিন্তু ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জয় লাভ করে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেই বিভিন্ন ছল-চাতুরির মাধ্যমে সংবিধান থেকে উক্ত ধারাটি মুছে দিয়েছে। ফলে সংবিধানের ৬৫(২) ধারায় নির্বাচনী ব্যাখ্যা এখন আর বাস্তবে নেই। হোন্ডা, গুÐা, মাসলম্যান ও অর্থের নিকট নির্বাচনী ব্যবস্থা বন্দী হয়ে যাওয়ায় প্রকৃত রাজনীতিবিদরা দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছেন, যার শূন্যস্থান পূরণ করছে কালো টাকাওয়ালারা। দলগুলোও প্রার্থী খোঁজার সন্ধানে টাকাওয়ালাদের প্রতি ঝুঁকে পড়েছে। অন্যদিকে জনগণের একটি অংশ নগদে বিশ্বাসী বিধায় রাজনৈতিক দলগুলো টাকাওয়ালাদের কদর করতে বাধ্য হচ্ছে।
তবে দলগুলো যদি রাজনীতিবিদদের গÐির মধ্যেই দলীয় পদ পদবি সীমাবদ্ধ রাখতে পারত তবে রাজনীতিতে মাফিয়া চক্র প্রবেশ করতে পারত না। এ মাফিয়ারা জনগণকে শোষণ করে মুনাফাখোর, মজুদদারি, টেন্ডার শিকার, ব্যাংক লুট, স্বর্ণ চোরাচালান করে অগাধ টাকার মালিক হয়ে গেলে তখন ফুলের মালা গলায় পরার শখ তাদের পেয়ে বসে। এ ‘শখের’ বশবর্তী হয়ে টেন্ডার শিকারের মতো তখন দলের পদ-পদবি ও নমিনেশন শিকারে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। নমিনেশনবাণিজ্যে সফল হলেই মন্ত্রীবাণিজ্য চেষ্টা করে সফল হোক না হোক জনগণকে শোষণ করার যাবতীয় সুযোগ এমপির হাতে থাকে। তখন এমপিই হয়ে যায় থানার ওসি। জনস্বার্থে আইন প্রণয়নের সচেষ্ট হওয়ার পরিবর্তে প্রতিপক্ষকে মামলা দিয়ে হয়রানি এবং নিজ দলীয় অনুগত নেতাকর্মীদের ‘দখল’ বাণিজ্য করার অবৈধ লাইসেন্স দেয়াই হয় এমপির মুখ্য ভ‚মিকা। সাম্প্রতিককালে ২০১৪ সালে বিনা ভোটে নির্বাচিত এমপিদের বিরুদ্ধে খুন, গুম, চোরাচালান, ইয়াবা ব্যবসাসহ প্রভৃতি জঘন্য অপরাধের অভিযোগও রয়েছে।
রাজনীতিবিদদের হাতে যদি রাজনীতি থাকত এবং অর্থের প্রভাব যদি এত প্রকট না হতো তবে ‘রাজনীতির’ এ বীভৎস চেহারা জনগণকে দেখতে হতো না। রাজনীতিকে কলুষিত করার পেছনে অর্থের প্রভাবের পাশাপাশি দলীয় নীতিনির্ধারক, দলীয় নেতাকর্মী ও জনগণের একটি অংশের ভ‚মিকা কম নয়; এটাই দেশবাসীর জন্য একটি দুঃসংবাদ।
রাজনীতির ভারসাম্য দিন দিন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কারণ সরকারি দল তাদের ভাগ্য নির্ধারণ জনগণের ওপর ছেড়ে না দেয়ার মানসিকতা থেকে বিরোধী দলকে আটকানোর সকল ফন্দি-ফিকির করে জটিল থেকে জটিলতর করার আইন পাস করে পার্লামেন্টকে জটিল আইন তৈরির একটি ফ্যাক্টরিতে পরিণত করেছে। সরকার এখন একটি নতুন ¯েøাগান চালু করেছে, তা হলো উন্নয়ন আগে, না গণতন্ত্র আগে। গণতন্ত্র আর ব্যক্তিতন্ত্র এক কথা নয়। যেখানে রাজতন্ত্র রয়েছে, কোথাও কোথাও সেখানে গণতন্ত্র রয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে চলছে না গণতন্ত্র, না রাজতন্ত্র, চলছে এখন ব্যক্তিতন্ত্র।
শেখ হাসিনার সরকার রাজনীতিকে ভারসাম্যহীন করার জন্য নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। শোনা যাচ্ছে যে, বেগম খালেদা জিয়াসহ বিএনপি শীর্ষ নেতাদের সাজা দিয়ে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করেই নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে। সরকার যদি তাদের ইচ্ছা পূরণ করতে পারে তবে রাজনীতির ভারসাম্যহীনতা আরো গভীর থেকে গভীরতর হবে। যেমন- ১৫ আগস্টের ঘটনার সময় কোনো রাজনৈতিক দল এর প্রতিবাদ করেনি বলে বিভিন্ন মহল থেকে বারবার কথা উঠেছে। কিন্তু বাস্তবতা এটাই ছিল যে, বাকশাল অর্থাৎ একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম হওয়ার কারণে সব রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত হয়ে যায়। ফলে বিলুপ্তকৃত কোনো সংগঠনের পক্ষে ১৫ আগস্টের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বক্তব্য দেয়ার সুযোগ ছিল না। এমনিভাবে বিরোধী দলকে ধ্বংস করে সরকারি দল দীর্ঘস্থায়ী হবে তাও ভাবা বাস্তবতার পরিপন্থী।
দেশনেত্রী খালেদা জিয়া বা বিরোধী দল বা ২০ দলীয় ঐক্যজোট এখন রাজনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করছেন। এভাবে ভারসাম্যকে বাধাগ্রস্ত করলে রাজনীতি যখন ভারসাম্যহীন হয়ে যাবে তখন সরকারি দলটি কি রাজ্য শাসনের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত পেয়ে যাবে?
সরকার এখন দুর্বার গতিতে চলছে। তারা রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে রাজনীতির পরিবর্তে অপপ্রয়োগের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে, এর দায়দায়িত্ব সরকারকে কোনো দিন ভোগ করতে হবে না?
ভারসাম্য এমন একটা বিষয় যা প্রয়োজন শুধু অন্যের চেয়ে নিজেকে রক্ষা করার জন্য। যখন কোনো দল বা গোষ্ঠী বা শাসক নিরঙ্কুশ ক্ষমতা পেয়ে বসে তখনই সমাজ ও রাজনৈতিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে, আমাদের হয়েছে সে অবস্থা। ফলে দেশের জনগোষ্ঠীর একটি অংশ (শাসক দল) রাষ্ট্রের সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে। রাতারাতি বিপুল সম্পদের মালিক বনে যাচ্ছে। অথচ জনগোষ্ঠীর বৃহত্তর অংশটি আজ দিনের পর দিন অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনীতিকভাবে নিগৃহীত হচ্ছে। কোথাও কোনো ইনসাফ বা বিচার পাওয়া যাচ্ছে না। সব জায়গাতেই অসন্তুষ্টি। এ অসন্তুষ্টি জাতিকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। মানুষ যখন একক ক্ষমতার মালিক হয়ে যায় তখন তার পাশে তেলের বাটি নিয়ে বসে থাকার মানুষের অভাব হয় না, তোষামোদি ও প্রশংসা সবাই খোঁজে, কিন্তু এ বিষয়টা যখন মাত্রা অতিক্রম করে তখনই মানুষ ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। নিজের কোনো অপরাধ বা ব্যর্থতা তখন চোখে পড়ে না, নিজের বিবেকও তখন প্রশংসার সাগরে ডুবে গিয়ে নিজেকে কখন নিমজ্জিত করে তা নিজেই উপলব্ধি করতে পারে না।
টিকে থাকার যোগ্যতার মাপকাঠি যখন বিপথগামী হয় তখন জাতি তার সঠিক নেতৃত্ব নির্ধারণে দিশেহারা হয়ে পড়ে এটাও ভারসাম্যহীনতার একটি কারণ বটে।
‘উন্নয়ন’ হচ্ছে জনগণের অর্থে সরকারের একটি রুটিন ওয়ার্ক। এ রুটিন ওয়ার্কে যে যতটুকু পারদর্শী এবং স্বচ্ছতার পরিচয় দেবে সে ততটুকু জনগণের সমর্থন পাবে; কিন্তু উন্নয়ন কীভাবে হবে, কোথায় হবে, কোন পদ্ধতিতে হবে তা নির্ধারণ করার এখতিয়ার জনগণের, যার প্রকাশ পাবে স্বচ্ছ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে। এখন সরকার চলছে রাজতন্ত্রের আদলে। জনগণের মতামত পরিস্ফুটনের এখন কোনো অবকাশ নেই।
লেখক : কলামিস্ট ও বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন