আল ফাতাহ মামুন : শুধু বাংলাদেশ নয় পুরো বিশ্বে আলোচিত ইস্যুর নাম ‘জঙ্গীবাদ’। বিশ্বমোড়লদের ‘বদ’ চিন্তার বাস্তবায়নেই আত্মপ্রকাশ হয়েছে জঙ্গী সংগঠনগুলোর। সম্পদশালী ও তুলনামূলক দুর্বল মুসলিম রাষ্ট্রকে নিজেদের করায়ত্বে আনতেই মোড়ল রাষ্ট্রগুলোর লোভের শিকার হয়েছে ওই সব দেশ ও সাধারণ জনগণ। অজুহাত ছিলো ‘সন্ত্রাসদমন ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় বিশেষ অভিযান’। সেই লক্ষ্যে ওই সব দেশে পরিকল্পিতভাবে নানান জায়গায় কৃত্রিম সন্ত্রাসী হামলা(!) চালিয়ে নিজেদের বক্তব্যকে জোরাল করেছে ক্ষমতাধররা। তারপর শুরু হয়েছে সন্ত্রাস দমনের নামে ত্রাসের রাজত্ব। চলেছে শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে মৃত্যুর হোলিখেলা। ইরাক-আফগান্তিান-সিরিয়া-ফিলিস্তিনের দিকে তাকালে এর প্রমাণ মিলবে হাতে হাতে। ওই সব দেশে এখনো মানুষ পুড়ছে অশান্তির দাবানলে। নিজের ভিটে-মাটি ফিরে পাওয়া তো দূরের থাক দিনে বিশ্রাম, রাতে ঘুম, পেটে ক’টি দানাপানি- এও জুটছে না অধিকংশ মানুষের ভাগ্যে। হে বিশ্বমোড়ল! এমন শান্তিই কি চেয়েছিলো শান্তিপূজারীরা?
সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের আগ্রাসন শুধু মুসিলমদেশেই ঘটে থাকে। তাও আবার ইসলামের নাম করেই। আর এ আগ্রাসন থামাতে এগিয়ে আসেন মানবতার বুলি আওড়ানো মুখোশপড়া মানবতার শত্রæরা। মাঝখান থেকে হারিয়ে যায় লাখো বনি আদম। নিঃস্ব হয়ে পড়ে কোটি কোটি মানুষ। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে বেড়ে ওঠে অসংখ্য শিশু-কিশোর। যারা জানেই না এ নির্মম জীবনের গøানি টানতে হবে কোন অপরাধে? কী দোষে সমুদ্রের বেলাভ‚মিতে কিংবা ধান ক্ষেতের কাদামাটিতে নিজের খেলার সাথী আয়লানরা মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে? কার সঙ্গে তাদের অভিমান? খেলায় না নেওয়ায় খেলার সাথীদের সঙ্গে না-কি জীবন-খেলা থেকে বাদ দেওয়া বিশ্বের ভদ্রমুখোশধারীদের সঙ্গে? যারা সুন্দর জীবন নিশ্চিত করার কথা বলে অসুন্দরের উল্লাসে মেতে ওঠে মানবতা ভুলে, তাদের সঙ্গেই অভিমান করে আয়লানরা পড়ে থাকবে মুখ থুবড়ে!
আমাদের প্রিয় মাতৃভ‚মিতে জঙ্গী-জঙ্গী রব উঠেছে বিএনপি সরকারের আমল থেকে। আবদুর রহমান বাংলা ভাইসহ অনেকে দেশব্যাপী শক্তিশালী জঙ্গী নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছিলো তখন। তাদেরকে ধরে ফাঁসিতে ঝুলানোর পাশাপাশি একাধিক জঙ্গী সংঘটনকে নিষিদ্ধও করেছে বিএনপি সরকার। মজার ব্যাপার হলো, এতসব অর্জন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের চোখে ‘নাটক’ ছাড়া কিছুই মনে হয়নি। তখন তারা গলা ফাটিয়ে বারবার বলেছে, এসব নাটক! নাটক! আজ যখন আওয়ামী লীগ সরকারের সময় জঙ্গী ও সন্ত্রাসী হামলা শুরু হয়েছে, এখনো একদল মানুষের কাছে, বিশেষ করে বিএনপি-জামায়াত ঘরানাদের কাছে বিষয়টি নাটকই মনে হচ্ছে। তবে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করলে এ সত্য অস্বীকারের উপায় নেই, সাম্প্রতীক সময়ে প্রতিটি জঙ্গী হামলায় এমন কিছু প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে যার কোন সদুত্তর পাওয়া যাচ্ছে না। যেমন র্যাবের ব্যারাকে নিহত যুবক সম্পর্কে বলা হচ্ছে, তাকে আগেই বাড়ি থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে। গুলশানের হামলার পর প্রায় সব কাগজেই এক ব্যক্তির সন্দেহজনক আচরণ নিয়ে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে। এছাড়া আরো অনেক প্রশ্ন যা সাধারণ জনগণ ও বিশ্লেষকদের কাছে রহস্য হয়েই থেকে যাচ্ছে।
সবচেয়ে বড় কথা হল, এখন পর্যন্ত জঙ্গীবাদসহ কোন ঘটনারই কুল কিনারা করতে পারেনি সরকার। বøগার হত্যা, প্রকাশক হত্যা, এমপিকে খুন, পাদ্রীসহ বিদেশি নাগরিককে খুন- এমন কত আলোচিত ইস্যু নিষ্পত্তিহীনভাবে প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশের মানচিত্রে তার সঠিক পরিসংখ্যান জানা নেই আমাদের। একের পর এক ঘটনা ঘটছে কিন্তু সমাধান হচ্ছে না। যেটা হচ্ছে তার নাম ‘বেøম গেম’। একদল আরেক দলের ওপর দোষ চাপাতে পারলেই যেন সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে- এমনটিই ভাবেন আমাদের রাজনীতিবিদরা। তা না হলে, দোষারোপের রাজনীতি থেকে বেরুতে পারছেন না কেন আমাদের কর্ণধাররা? অন্যের ঘাড়ে দায় চাপানোর রাজনীতি আমাদের দেশে নতুন নয়। আগেও ছিলো, এখনও চলছে। কিন্তু কথা হলো, এর কি কোন প্রতিকার হবে না? দিন বদলে হাওয়া কি রাজনীতিদিবদের গায়ে লাগবে না? এভাবে যদি চলতেই থাকে তবে অল্প সময়ের মধ্যেই ‘নাটক’ রূপ নেবে কঠিন বাস্তবে। তখন ক্ষমতাধর প্রতিবেশী মান-অভিমানের সুযোগে ঘরে ঢুকবে। ভেগে যাবে আম-ছালা সব নিয়ে। যেমন ভেগে গেছে প্রতিবেশী চোর, অভিমানী দম্পতির গয়না-গাটি, হাড়ি-পাতিলসহ সব কিছু ব্যাগে ভরে। গল্পটা শুনুন তাহলে।
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যে আগে কথা বলবে তার ভালোবাসা কম। শুধু তাই নয় সম্পর্ক আছে অন্য কোথায়ও। এর পর এক শর্ত দিল স্ত্রী। মেনে নিল স্বামীও। নিজেদের ভালোবাসা ও নিরাপরাধের প্রমাণ দিতে দু’জনই পণ করল, অন্যজন কথা না বলা পর্যন্ত অপরজন কথা বলবে না। এই অবস্থা চলল এক সপ্তাহ। সুযোগ বুঝে একদিন প্রতিবেশী ঘরে ঢুকে সব নিয়ে চলে যাচ্ছে। কিন্তু কেউ কোন কথা বা চিৎকার চেঁচামেচি করছে না। পরে সব হারিয়ে একে অপরকে দোষারোপ করতে লাগল। গল্পটা এখানেই শেষ। আমাদের অবস্থাও হয়েছে তেমন। যে কোন ঘটনাই ঘটুক এ দোষ দিবে ওকে, ও দোষ দিবে একে। কিন্তু কোন কার্যকরী উদ্যেগ নেবে না কেউই। মাঝথেকে অপরাধীর সুবিধা। আর অপরাধী যদি হয় পড়শি, তবে তো সোনায় সোহাগা।
জঙ্গীবাদ একটি জাতীয় সমস্যা। এ সমস্যায় আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ না করলে ইরাক-ফিলিস্তিনের ভাগ্য বরণ করতে আর বেশি সময় লাগবে না বাংলাদেশের। এ সরকারের আমলে একাধিক জঙ্গী হামলার ঘটনা ঘটেছে। সব ঘটনার পরই আওয়ামীলীগ-বিএনপি স্ব স্ব দলের ব্যানারে কর্মসূচী-মিছিল-মিটিং পালন করেছে। আওয়ামী লীগের আহŸানে দেশের বিভিন্ন যায়গায় সন্ত্রাসবিরোধী কমিটিও গঠন হয়েছে। কিন্তু এসব কিছুই ফলপ্রসু হচ্ছে না। দিন দিন সন্ত্রাসী ঘটনা বেড়েই চলছে। শুধু তাই নয় অপ্রতিরোধ্য হয়ে পড়ছে। আর সেজন্য গল্পের সেই প্রতিবেশীর উপস্থিতিও অনিবার্য্য হয়ে পড়েছে। এসব ঘটনা বাংলার আকাশে গভীর কালো মেঘের ইঙ্গিত দিচ্ছে। যে মেঘ কেটে সূর্যের দেখা পাওয়া কষ্টসাধ্যই নয় মূল্য সাধ্যও হবে। যেমন মূল্য দিয়েছি দু’শ বছর ব্রিটিশদের গোলামী করে।
সরকার এবং বিরোধী দলের কাছে আমাদের আবেদন, আপনারা দোষারোপের রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসুন। জঙ্গীবাদ নির্মূলে এক সঙ্গে কাজ করুন। সঙ্গে আলেম-ইমাম-খতিবদেরও রাখুন। আমাদের সোনার বাংলাদেশের তরুণ সমাজ এখনো ততটা বিগ্রে যায়নি। তারা এখনো ধর্মভিরু। ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই যে কোন সমস্যার সমাধানে তাদের কাছে ধর্মের সঠিক দৃষ্টিভঙ্গী তুলে ধরুন। তাদের মধ্যে মানবতাবোধ জাগিয়ে তুলুন। তাহলে অল্প সময়ের ব্যবধানে আবারো আমরা জঙ্গীবাদমুক্ত বাংলাদেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবো। পাশাপাশি আরেকটি কথা বলতে চাই। জঙ্গীবাদসহ যেকোন সমস্যায় সরকারের আন্তরিকতা ও সদিচ্ছা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কোন ঘটনার পর তা খতিয়ে দেখছি, এটি অমুকের কাজ, তমুকের ষড়যন্ত্র এসব না বলে সমাধানের জন্য সঠিক পথে এগুতে হবে। সমস্যা সমাধানে দীর্ঘ মেয়াদী, স্বল্প মেয়াদী ও চলমান প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে হবে। তবেই এদেশ মুক্ত হবে সন্ত্রাসীর কালো থাবা এবং হিংসুকের মুখ বাঁকানো থেকে। মুক্তি পাবে পাড়াপড়শির অনাকাক্সিক্ষত আক্রমণ ও কু-নজর থেকেও।
লেখক : শিক্ষার্থী, ডিপ্লোমা ইন অ্যারাবিক ল্যাঙ্গুয়েজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন