হোসেন মাহমুদ : দেশে জঙ্গি দমনে সরকারের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টায় একটি জঙ্গি আস্তানায় পরিচালিত অভিযানে ৪ শিশু, ২ নারী ও ১ পুরুষসহ ৭জন জঙ্গি নিহত হওয়া; সরকার দলীয় নন এমন তিন জন মেয়রকে বরখাস্ত করা, এ বরখাস্ত বিষয়ে সরকার প্রধান কিছু জানেন না বলে সরকারী দলের অন্যতম প্রধান নেতা ও গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর মন্তব্য এবং পরবর্তী দু’দিনে উচ্চ আদালত কর্তৃক বরখাস্তের আদেশ স্থগিত, একজনের পুনর্বহালের আদেশের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল দায়েরের মতো বিষয় যখন সংঘটিত হয়ে চলেছে, সেই প্রেক্ষাপটে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়ন বা আইপিইউ-র সম্মেলন। সরকার, সরকারের কর্মকর্তাগণ এবং সরকার সমর্থকরা আইপিইউ সম্মেলনের মতো বিশাল একটি আয়োজন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করে যখন খুশি ও পরিতৃপ্ত তখন দেশের জনগণের অনেকের মনেই প্রশ্ন জেগেছে যে এ সম্মেলন আয়োজনের আদৌ কোনো প্রয়োজন ছিল কিনা। কারো কারো মনে আরো প্রশ্ন জেগেছে যে পার্লামেন্ট মানেই গণতন্ত্র। যে সব প্রতিনিধি এসেছিলেন তারা গণতন্ত্র অনুসারী, কিন্তু তারা যে দেশে সম্মেলনে যোগ দিতে এলেন সে দেশটিতেই গণতন্ত্র আছে কিনা সে খবর কি তারা নিয়েছেন? আর যে দেশে গণতন্ত্র নেই কিংবা জালে আটকা পড়া মাছের মত খাবি খাচ্ছে সেখানে বিশে^র গণতান্ত্রিক দেশগুলোর জনপ্রতিনিধিদের সম্মেলনে গণতন্ত্রের কোন মহান দিগন্ত উন্মোচিত হল? আর এ সম্মেলনের মাধ্যমে জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদের আতংকে কম্পমান বিশ^কে বাংলাদেশ সরকার কি এ বার্তাই দিল যে আরো কোনো কোনো ক্ষেত্রে যেমন দাবি করা হয় তেমনি গণতন্ত্রের বেলাতেও বাংলাদেশ বিশ^মডেল?
গত শনিবার থেকে বুধবার (১-৫ এপ্রিল) পর্যন্ত ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় ১৩৮ বছর বয়সী সংগঠন আইপিইউ-র ১৩৬তম সম্মেলন। বিশে^র ১৩১টি দেশের পার্লামেন্ট স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার ও পার্লামেন্ট সদস্যসহ প্রায় দেড়হাজার প্রতিনিধি এ সম্মেলনে অংশ নেন। বাংলাদেশে আইপিইউ-র এটিই প্রথম সম্মেলন। এর যৌথ উদ্যোক্তা ছিল বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ ও আইপিইউ। সম্মেলনের আগে ৩১ মার্চ বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের স্পিকার ও কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি এসোসিয়েশনের (সিপিএ) চেয়ার পারসন ড. শিরিন শারমিন চৌধুরী জানান, ‘এবারের সম্মেলনের মূল প্রতিপাদ্য বৈষম্যের প্রতিকার; সকলের জন্য মর্যাদা ও কল্যাণ। এবারের আইপিইউ সম্মেলনটি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অভিপ্রায়ের জন্য একটি মাইলফলক, যা বাংলাদেশের জন্য বয়ে আনবে বিরাট সম্মান।’ আর সংসদ সদস্য ও আইপিইউ প্রেসিডেন্ট সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশের ইতিহাসে আন্তর্জাতিক পরিসরে এটা সর্ববৃহৎ আয়োজন।’
উল্লেখ্য, যে কয়েকবার দেশ পরিচালনাকারী দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল ও যাদের প্রতি দেশের ন্যূনতম ৩০ শতাংশ ভোটদাতার সমর্থন আছে বলে মনে করা হয় সেই বিএনপি আইপিইউ সম্মেলনে যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ পায়নি। কারণ, বর্তমান সংসদে দলটির কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই। কিন্তু বিএনপির মতো সাবেক শাসক দলের সংসদে প্রতিনিধিত্ব নেই কেন, আগত দেশগুলোর সংসদীয় প্রতিনিধিরা তা জানার কোনো চেষ্টা করেছেন কিনা তা জানা যায়নি। যে সব দেশ এ সম্মেলনে যোগ দিয়েছে তাদের প্রতিনিধিরা আসার আগে বাংলাদেশ সম্পর্কে কিছু হোমওয়ার্ক করে আসেননি তা বিশ^াসযোগ্য নয়। তা যদি তারা নাও করে থাকেন তাহলেও যে সব দেশের বাংলাদেশে দূতাবাস আছে তাদের তো তা না-জানার কথা নয়। যাহোক, এ সম্মেলনে অস্ট্রেলিয়া, পাকিস্তানসহ ৬টি সদস্য দেশ যোগদান করেনি বলে জানানো হয়। আইপিইউ-র সদস্য সংখ্যা ১৭১। তাদের মধ্যে ১৩১টি দেশ যোগ দিয়েছে বলা হয়েছে। ৬টি দেশ যোগ দেয়নি। বাকি ৩৪টি দেশের অবস্থা সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। এ সম্মেলনে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন শান্তিতে যুগ্মভাবে নোবেল বিজয়ী ভারতের মানবাধিকার কর্মী কৈলাস সত্যার্থী। সম্মেলনের উদ্বোধন জাতীয় সংসদ প্লাজায় হলেও পরবর্তী ইভেন্টগুলো হয়েছে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে।
প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালে আইপিইউ’র ১৩১তম অ্যাসেম্বলিতে প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে সংস্থাটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন সাবের হোসেন চৌধুরী এমপি। ১৯৭২ সালে রোমে অনুষ্ঠিত আইপিইউ সম্মেলনে অংশ নেয়ার মাধ্যমে সংস্থাটিতে যোগ দেয় বাংলাদেশ। বুধবার সার্বভৌম দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ নয়সহ ১৮টি প্রস্তাব গ্রহণপূর্বক ৮ দফা ঢাকা ঘোষণার মধ্য দিয়ে আইপিইউ সম্মেলন শেষ হয়।
আইপিইউ সম্মেলনের খবরাখবর শনি-বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বাংলাদেশের সকল মিডিয়াতেই বেশ গুরুত্ব পেলেও সর্বোচ্চ গুরুত্ব পায়নি বলেই দেখা যায়। এ সম্মেলন থেকে বাংলাদেশের বাস্তব অর্জন কি তা এখনো নিরূপিত হয়নি। বিশ্লেষকরা তা নিয়ে হয়ত ব্যস্ত। তবে প্রায় দেড় হাজার পার্লামেন্ট প্রতিনিধিকে নিয়ে আয়োজিত এ সম্মেলন নিয়ে দেশে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। সরকার পক্ষ থেকে সম্মেলনের পক্ষে ব্যাপক গুণ-গান গাওয়া হবে এটাই স্বাভাবিক। তার প্রমাণও পাওয়া গেছে। স্পিকার ড. শিরিন শারমিন চৌধুরী বলেছেন, এ সম্মেলন বাংলাদেশ সংসদের প্রতি বিশে^র সমর্থনের প্রমাণ। ৫ এপ্রিল সম্মেলন পরবর্তী প্রেস ব্রিফিংয়ে তাঁর বক্তব্য উদ্ধৃত করে ৬ এপ্রিল একটি শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্র জানায়, ড. শিরিন শারমিন চৌধুরী বলেন যে ‘এবারের সম্মেলনের সবচেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের উপর বিশ্ব গণতান্ত্রিক সম্প্রদায়ের স্বীকৃতি। বিশ্বের সর্বোচ্চ দুটি সংসদীয় ফোরাম কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি এসোসিয়েশন-সিপিএ এবং আইপিইউ’র প্রধান পদে বাংলাদেশ থেকে নির্বাচিত করার মধ্য দিয়েও এটা প্রমাণ হয়েছে। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে এদেশে গণতন্ত্র বিদ্যমান সেটিও আমরা প্রমাণ করতে পেরেছি।’
সাধারণভাবে তাঁর এ কথা থেকে অনেকেই এ সম্মেলন আয়োজনের প্রকৃত উদ্দেশ্য অনুমান করেছেন। তাদের কথা মতে, ২০১৪ সালের পর বৈধতা নিয়ে অস্বস্তিতে ভুগতে থাকা সরকার এ পথ গ্রহণ করে সকল অস্বস্তি এখন ঝেড়ে-মুছে ফেলে দিতে পেরেছে। সে হিসেবে এ সম্মেলন শতভাগ সফল। আরেকটি ক্ষেত্রেও সফল এ সম্মেলন। তাহল ব্যাপক আন্তর্জাতিক যোগাযোগ। ১৩১টি দেশের কাছে বাংলাদেশ সরকারকে গণতন্ত্রের সুদৃশ্য সজ্জায় তুলে ধরা গেছে। তাতে এত আলো জ¦লেছে যে কেউই সে আলোর নিচে কোনো আঁধার খুঁজতে যায়নি। সে আলোর বন্যায় ভেসে গেছে ২০১৪ সালের কথিত প্রহসনের নির্বাচনের কথা, জাতীয় সংসদের ৩শ’ আসনের ১৫৩ জনেরই বিনা প্রতিদ¦›িদ্বতায় নির্বাচিত হওয়ার কথা, সংসদে বিরোধী দল না থাকা ও নির্বাচনী জোটেরই একটি দলকে বিরোধী দলে পরিণত করে সে দলের দ্বিতীয় প্রধানকে বিরোধী দলীয় নেতা বানিয়ে এক নজিরবিহীন নজির সৃষ্টির কথা। এ সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী সকল দেশের সংসদ সম্পর্কে অনেকেরই জানার কথা নয়। তবে সে সব দেশে যদি বাংলাদেশের মতো গণতন্ত্র চালু থাকে তাহলে আলাদা কথা। কিন্তু যদি প্রকৃত গণতন্ত্র চালু থাকে এবং নিশ্চয়ই আছে (যেমন ফ্রান্স, বেলজিয়াম, জার্মানি প্রভৃতি দেশ) তাহলে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের প্রকৃত কি অবস্থা, এদেশে কেন অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল সংসদে নেই, কারা বিরোধী দল ও কাদের বিরোধী দল হওয়ার কথা প্রভৃতিও তাদের জানার কথা। যেহেতু এটা পার্লামেন্ট তথা গণতন্ত্রের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের ব্যাপার অতএব এ সম্মেলনে গণতন্ত্র নিয়ে কথা উঠতেই পারত। কিন্তু আশ্চর্য যে পাঁচদিনের এ সম্মেলনের কোনো পর্যায়েই বিশে^র ১৩১টি দেশের একজন গণতন্ত্রীর মুখ থেকেও এ ব্যাপারে একটি কথাও উচ্চারিত হয়নি। এমনকি আমাদের প্রতিবেশী দেশের মানবাধিকার কর্মী শান্তিতে সহ-নোবেল পুরস্কার বিজয়ী কৈলাস সত্যাথী, যিনি এ সম্মেলনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছেন, যদিও তিনি কোনো পার্লমেন্টারিয়ান নন, অন্য সবার চেয়ে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি-পরিবেশ সম্পর্কে বেশি ওয়াকিবহাল। তার কাছ থেকেও এ ব্যাপারে কোনো কথা শোনা যায়নি বলে সচেতন ব্যক্তিরা লক্ষ করেছেন।
এদিকে টিভি চ্যানেলের টক শো’গুলোতে এ সম্মেলন নিয়ে টুকিটাকি আলোচনা হয়েছে। সব চ্যানেলের সব আলোচনা শোনা সম্ভব নয়। একটি আলোচনায় একজন আলোচক এইচএসসি পরীক্ষার সময় এ ধরনের বড় মাত্রার অনুষ্ঠান আয়োজনের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করেন। আরেক আলোচক আগত প্রতিনিধিদের সাথে জনগণের সম্পৃক্ততার কোনো সুযোগ না থাকার সমালোচনা করেন। তবে এবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এ সম্মেলন নিয়ে কোনো মন্তব্য লক্ষ করা যায়নি। এ থেকে মোটামুটি অনুমান করা হয় যে এত বড় একটি সম্মেলনের বিষয় জনজীবনের বৃহত্তর অংশেই কোনো সাড়া জাগায়নি। আবার সরকারের পক্ষ থেকেও এ ব্যাপারে প্রচার-প্রচারণার ব্যাপক উদ্যোগ নেয়া হয়নি বলেই দেখা যায়। কেউ কেউ তাই বলতে চেয়েছেন যে সরকার কি এত বড় একটি সম্মেলনের বিষয়টিকে অপেক্ষাকৃত লো প্রোফাইলে রাখতে চেয়েছিল?
এদিকে এ সম্মেলনের ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে বিএনপি। দলটি বলেছে, আইপিইউ সম্মেলনে জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধিত্ব নেই। তাদের মতে, যে দেশে গণতন্ত্র নেই সে দেশে আইপিইউ সম্মেলন প্রহসন। বাংলাদেশে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানে আইপিইউ›র ভূমিকা চেয়েছে দলটি। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘যে দেশের পার্লামেন্ট জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে না, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে, নাগরিকদের মানবাধিকার লুণ্ঠিত, হত্যা, গুম, গ্রেফতার ও মিথ্যা মামলায় জনগণ জর্জরিত, সেই দেশে আইপিইউ সম্মেলন প্রহসন ছাড়া কিছুই নয়।’ বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক স্পিকার জমিরউদ্দিন সরকার বলেন, দেশে অনুষ্ঠিত সংসদীয় রাজনীতির এই মহাসম্মেলনে বাংলাদেশের জনগণের প্রকৃত কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই। তিনি বলেন, বাংলাদেশের সংসদ সদস্য নামে যারা এ সম্মেলনে অংশ নিচ্ছেন, তারা সবাই ভুতুড়ে ভোটারদের প্রতিনিধিত্ব করছেন। তিনি ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে প্রহসনমূলক অভিহিত করেন। তিনি বলেন, ওই নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩ জনকে বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতায় ও বিনাভোটে নির্বাচিত বলে ঘোষণা করা হয়েছে। বাকি আসনে মাত্র ৫ শতাংশ মানুষ ভোট দিয়েছেন। বাংলাদেশে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিনিধিত্বকারী সংসদীয় ব্যবস্থা গড়ে তুলতে আইপিইউ সদস্যদের নৈতিক অবস্থান গ্রহণের জন্য তিনি আহŸান জানান। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ আইপিইউ›র সভাপতি পদে বাংলাদেশের সাবের হোসেন চৌধুরীর নির্বাচিত হওয়ার বিষয়ে বলেন, ‘যারা তাকে ভোট দিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করেছেন, তারা জানতেন না তিনি বিনাভোটে নির্বাচিত একজন। জানলে তাকে নির্বাচিত করতেন না।’
উল্লেখ করা যেতে পারে যে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর সে নির্বাচনকে বিএনপি প্রহসনের নির্বাচন বলে আখ্যায়িত করে। অন্যদিকে ইইউ একে ত্রæটিপূর্ণ নির্বাচন ও যুক্তরাষ্ট্র একে সকলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নয় বলে অভিমত ব্যক্ত করে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সে নির্বাচনের উপর দাঁড়িয়ে সরকার গঠন করে দায়িত্ব পালন অব্যাহত রাখলেও বিএনপি তার বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ না করে, গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে না তুলে এক বছর নিশ্চুপ বসে থাকে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এ সময়ের মধ্যে ভারতের সক্রিয় সমর্থন এবং বিশ^ গণতন্ত্রের তথাকথিত বড় ও মেজোকর্তা যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের নির্লিপ্ত ভূমিকার কারণে আওয়ামী লীগের অবস্থান শক্ত হয়ে ওঠে ও বিএনপির ধাক্কা ঠেকানোর অবস্থায় পৌঁছে যায়। বিএনপি যদি সেসময় নিশ্চুপ দিনযাপন না করে জনগণকে পাশে নিয়ে জোর আন্দোলন গড়ে তুলতে পারত তাহলে বাংলাদেশকে আজকের এ মুমূর্ষু গণতন্ত্রের প্রত্যক্ষদর্শী হতে হত না। তাদের এ বিশ্লেষণ নিয়ে সবাই একমত নাও হতে পারেন। তবে লক্ষণীয় যে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া তিন বছর পর এসে গত ১ এপ্রিল নিজেই স্বীকার করেছেন যে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর আন্দোলন স্থগিত করা ভুল ছিল।
সরকার বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ও ক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার করে গণতন্ত্র সম্পর্কে নিজের একটি অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে। রাজনৈতিকভাবে সে অবস্থানের বিরোধিতা করা কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে বলে অনেকেই লক্ষ করছেন। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, সরকারের এ গণতান্ত্রিক অবস্থানের প্রকৃত রূপের প্রকাশ ঘটেছে সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী, রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল ও হবিগঞ্জ পৌরসভার মেয়র জি কে গউছকে বরখাস্তের নাটকীয় ঘটনার মধ্যে। শুধুমাত্র বিএনপি সমর্থক হওয়ার কারণে মেয়র হওয়ার পর তারা কেউ দায়িত্ব পালনের সুযোগই পাচ্ছেন না। মামলার পর মামলা এবং জেল আর জেলই হচ্ছে তাদের বিধিলিপি। একই অবস্থা গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র অধ্যাপক আবদুল মান্নানের ক্ষেত্রেও। মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর সে চেয়ারে তিনি থিতু হতে পারেননি। মামলার পর মামলায় তিনি দিশাহারা, জেলই হয়ে উঠেছে তার স্থায়ী বাসস্থান। তিতিবিরক্ত হয়ে এখন তিনি আর মেয়রের চেয়ারে বসার চেষ্টা করবেন না বলে নাকি জানিয়েছেন। বিএনপি দলীয় খুলনার মেয়র মনিরুজ্জামানও প্রায় একই অবস্থার শিকার। আজ কারো এ প্রশ্ন করার সাহস নেই যে সারা বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের শত শত মেয়র। তাদের কারো নামে মামলা নেই, হয় না। তারা সবাই ফেরেশতার মত। আর যেখানে বিএনপির মেয়র তারা সবাই অপরাধী, হত্যাসহ নানা আজগুবি মামলার আসামী, আবার জনগণ জেলে থাকা অবস্থায়ও তাদেরই ভোট দিয়ে নির্বাচিত করে। আসলে, আইনের আবরণে এভাবে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক আচরণকে বিলীন করে ফেলা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতই একমাত্র সান্ত¡না ও ভরসার স্থল।
জানা যায়, গত ২ এপ্রিল সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী চেয়ারে বসার দুই ঘণ্টার মধ্যে পুনরায় বরখাস্তের আদেশ পান। আর রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল কাঠখড় পুড়িয়ে মেয়রের চেয়ারে বসলেও তা আট মিনিট স্থায়ী হয়। একই দিনে হবিগঞ্জ পৌরসভার মেয়র জি কে গউছও ১১ দিন দায়িত্ব পালনের পর পদ হারান। এই তিনজন আগেও বরখাস্ত হয়েছিলেন। তাদের বিরুদ্ধে হত্যাসহ নানা মামলা চলমান রয়েছে। এদিকে তিন মেয়রকে বরখাস্ত করার বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ৩ এপ্রিল বলেন, ‘মেয়র বরখাস্তের বিষয়টি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের। এর পেছনে যুক্তি কী, কারণ কী, এটা ওই মন্ত্রণালয় ভালো বলতে পারবে। তবে আমি যতটুকু জানি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি জানেন না।’
সর্বশেষ জানা যায়, সর্বোচ্চ আদালত সবারই বরখাস্তের আদেশ স্থগিত করেছেন। তবে তাদের মধ্যে ৫ এপ্রিল পর্যন্ত শুধু বুলবুল দায়িত্ব নিয়েছেন। আরিফুলের ব্যাপারে সরকার আপিল করেছে। এ ব্যাপারে সরকারের মনোভাব বিশ্লেষণ করেছেন একজন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক। তিনি বলেন, ‘বিএনপি-জামায়াতের মনোনয়ন বা সমর্থনে জয়ী জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে যাঁরা মাথা গুঁজে শুধু নিজের দায়িত্ব পালন করবেন, তাঁদের হয়রানি করবে না সরকার। তবে চেয়ারে বসে দলের কর্মসূচি বাস্তবায়নে তৎপর জনপ্রতিনিধিদের ছাড় দেয়া হবে না। বিশেষ করে, ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে ও পরে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া জনপ্রতিনিধিদের চেয়ার থেকে দূরে রাখতে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও আইনগত সব চেষ্টা করা হবে।’
বিশে^র প্রতিটি দেশের জনসমাজের মানুষ শান্তি ও স্বস্তিতে বসবাসের প্রত্যাশা করে। গণতন্ত্র সেই শান্তি ও স্বস্তির নিশ্চয়তা দিতে পারে। কিন্তু মানবগোষ্ঠির এক বিরাট অংশেরই দুর্ভাগ্য যে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে গণতন্ত্র বিপন্ন এমনকি বিলুপ্ত হয়। শাসকরা নিজেদের স্বার্থে তা করে। যে দেশেই যে শাসকই তা করুক তা যে কাক্সিক্ষত নয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
লেখক : সাংবাদিক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন