মুহাম্মদ রেজাউর রহমান
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চার দিনব্যাপী ভারত সফর শেষ হয়েছে ১০ এপ্রিল। এই সফরে ভারতের সঙ্গে ৩৫ দলিল, ২৪টি সমঝোতা স্মারক এবং ১১টি চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে। আর এ কারণেই বাংলাদেশ ও ভারতের গণমাধ্যম, রাজনৈতিক দল ও সচেতন নাগরিকদের মধ্যে সৃষ্টি হয় মিশ্র প্রতিক্রিয়া। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ৪৬ বছর পরেও যে অনেক ক্ষেত্রেই সহযোগিতা ও সমঝোতার প্রয়োজন ছিল, সহযোগিতামূলক প্রকল্প কর্মসূচি ও সম্ভাবনাকে আনুষ্ঠানিক রূপদান করার প্রয়োজন ছিলÑ এই বাস্তব সত্যের মুখোমুখি হয়ে সকল মহলই কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছে। তাই শুধু বিএনপি নয়, কমিউনিস্ট পার্টি, বাসদ, জামায়াতে ইসলামী এবং আরো রাজনৈতিক দল দাবি করেছে দেশের স্বার্থবিরোধী কোনো চুক্তি যেন না করা হয়। বিশিষ্ট নাগরিকদের ১১জনও এ বিষয়ে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এসব সমালোচনা ও মতামতের জবাবে সফরে যাওয়ার আগে প্রধানমন্ত্রী নিজে আশ্বস্ত করেছেন যে, দেশের স্বার্থবিরোধী কোনো চুক্তি করা হবে না। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও এ সম্বন্ধে বলেছেন, বাংলাদেশ-ভারত সম্পাদিত চুক্তির কোনোটাই দেশের স্বার্থবিরোধী নয় এবং চুক্তিগুলো গোপন রাখা হবে না। প্রধানমন্ত্রীর সাথে ভারত সফররত পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলীও গণমাধ্যমকে দেয়া বক্তব্যে বলেছেন, সমঝোতা স্মারক ও চুক্তিগুলোতে বাংলাদেশ ভারত দুই দেশেরই স্বার্থ রক্ষা হবে এবং দুই দেশই এসবের ফলে উপকৃত হবে।
প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের দ্বিতীয় দিনে দুই দেশের মধ্যে যে ২২টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়, সেগুলো হচ্ছে : (১) প্রতিরক্ষা সহযোগিতা কাঠামো, (২) প্রতিরক্ষা খাতে বাংলাদেশকে ভারত কর্তৃক ৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ প্রদান, (৩) বাংলাদেশের মিরপুরের ডিফেন্স সার্ভিসেস স্টাফ কলেজ ও ভারতের তামিলনাড়–র ওয়েলিংটন ডিফেন্স সার্ভিসেস স্টাফ কলেজের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা, (৪) নতুন ঋণ চুক্তির আওতায় বাংলাদেশকে আরো ৪ বিলিয়ন ডলার বা ছত্রিশ হাজার কোটি টাকা ঋণ প্রদান, (৫) ঢাকার ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ ও নয়াদিল্লির ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজের মধ্যে সহযোগিতার পরিধি বৃদ্ধি করা, (৬) মহাকাশের শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের ক্ষেত্রসমূহ চিহ্নিত করা ও পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করা, (৭) তথ্য প্রযুক্তি ও এ সংক্রান্ত সকল ক্ষেত্রে সহযোগিতা করা, (৮) সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ে সহযোগিতা করা, (৯) সীমান্ত এলাকায় হাট স্থাপন, (১০) দুই দেশের বিচার বিভাগের মধ্যে সহযোগিতা স্থাপন, (১১) বিচারক বিভাগীয় কর্মকর্তাদের ভারতে প্রশিক্ষণ, (১২) বাংলাদেশের নৌপথ ব্যবহারের সুবিধা (১৩) ভূমি সংক্রান্ত যৌথ গবেষণা ও উন্নয়ন, (১৪) উপক‚লীয় অঞ্চলে জাহাজ চলাচল, (১৫) সিরাজগঞ্জ ও আশুগঞ্জ থেকে বাংলাদেশ-ভারত রুটে চলাচলের সুযোগ, (১৬) গণমাধ্যমের ক্ষেত্রে সহযোগিতা বৃদ্ধি। ১৬টি সমঝোতা স্মারক ছাড়াও একই দিন যে ছয়টি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় সেগুলো হচ্ছেÑ (১) পরমাণু শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার, (২) পারমাণবিক নিরাপত্তা ও তেজস্ক্রিয়তা রোধে কারিগরি তথ্য বিনিময়, (৩) বাংলাদেশের পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে সহযোগিতা, (৪) যৌথ চলচ্চিত্র প্রযোজনা চুক্তি, (৫) সড়ক পথে খুলনা-কলকাতা পরিবহন ও (৬) বাংলাদেশে ৩৬টি কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণে অর্থায়ন।
সমঝোতা স্মারক ও চুক্তিগুলো স্বাক্ষরের পরে অনুষ্ঠিত যৌথ সংবাদ সম্মেলনে দুই প্রধানমন্ত্রী সকল ক্ষেত্রে বাস্তব পদক্ষেপ নেয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানান। বাংলাদেশের উন্নতিতে পাশে থাকার ঘোষণা দেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্কে আরো উচ্চমাত্রা যোগ করার ব্যাপারে দুই দেশ রাজি হয়েছে। যেসব ক্ষেত্রে এসব সমঝোতা স্মারক ও চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে সেগুলো সম্পর্কে বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, গণমাধ্যম ও রাজনীতি-সচেতন জনগণ ইতিবাচক কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারেনি শুধু একটি নির্মম বাস্তবতার কারণে। আর তা হলো, ভারত থেকে প্রবাহিত নদীসমূহের পানির ন্যায্য হিস্যা ৪৬ বছরেও না পাওয়ার কারণে। যে ২২টি সমঝোতা স্মারক ও চুক্তি গত ৮ এপ্রিল নয়াদিল্লির হায়দরাবাদ হাউসে স্বাক্ষরিত হয়েছে এগুলো সম্পর্কে চিন্তাভাবনা ও খসড়া প্রণয়নের কাজ শুরু হওয়ারও অনেক বছর আগে থেকে বাংলাদেশের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ সে চুক্তিটি চূড়ান্ত হওয়ারও ছয় বছর পরে অদ্যাবধি ভারত স্বাক্ষর করতে পারেনিÑ তা হলো তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি। তিস্তায় পানিশূন্যতার কারণে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় কৃষিকাজ মারাত্মকভাবে ব্যাহত। শুষ্ক মৌসুমে পানি না থাকাটা হচ্ছে সমস্যার একটি দিক। অন্য দিকটি হচ্ছে বর্ষায় অতিরিক্ত পানি প্রবাহে বন্যা হচ্ছে কয়েকটি জেলায়। তিস্তা নদীর তীরবর্তী জেলাসমূহের কৃষক ও জনগণের অভিযোগ হচ্ছে : বর্ষার সময় ভারত গজলডোবা নামক বাঁধের পানি এক সাথে ছেড়ে দেয়ায় গ্রামের পর গ্রাম তলিয়ে সর্বস্বান্ত হয় মানুষ। আবার শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রবাহ আটকে রাখায় প্রায় মরুভূমিতে পরিণত হয় তিস্তা পাড়ের জনপদ। পরিস্থিতি মোকাবেলায় বাংলাদেশ ১৯৯৮ সালে এক হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে তিস্তা সেচ প্রকল্প চালু করে। প্রকল্পের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯১ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেয়ার ব্যবস্থা করা।
নীলফামারী, রংপুর ও দিনাজপুর জেলার ১২টি উপজেলায় সেচ সুবিধা দেয়া সম্ভব হয় ৭৯ হাজার হেক্টর জমিতে। পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, উজান থেকে পানি ক্রমাগত কম আসায় প্রতি বছর সেচ কর্মসূচি ছোট করে আনতে হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড আরও জানায়, ২০১৩ সালে ৭০ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেয়া সম্ভব হলেও পরের বছর অর্থাৎ ২০১৪ সালে ২৫ হাজার হেক্টর জমিতেও সেচ দেয়া সম্ভব হয়নি। ২০১৫ সালে ৯ হাজার ৮৬০ হেক্টরে, ২০১৬ সালে ১১ হাজার ৪৫০ হেক্টরে এবং চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত সময়ে ২০ হাজার ২০০ হেক্টরে সেচ দেয়া সম্ভব হয়েছে। এক হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে করা তিস্তা সেচ প্রকল্পে প্রয়োজন ছিল কমপক্ষে দশ হাজার কিউসেক পানি। একমাত্র তা হলেই সম্ভব হতো ৯০/৯১ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা প্রদান। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যানুযায়ী ২০১২ সালের শুষ্ক মৌসুমে তিস্তায় ছিল সর্বোচ্চ তিন হাজার কিউসেক পানি। ২০১৩ সালের শুষ্ক মৌসুমেও পাওয়া গিয়েছিল সর্বোচ্চ তিন হাজার কিউসেক পানি। ২০১৫ ও ২০১৬ সালের শুষ্ক মৌসুমে এক হাজার কিউসেক পর্যন্ত পানি। এ বছরের এপ্রিলের শুরু থেকে পানি প্রবাহ বেড়ে দাঁড়ায় ৩০ হাজার কিউসেক পানি। ফলে বিস্তীর্ণ এলাকা হয় বন্যা প্লাবিত। তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি না থাকায় শুষ্ক মৌসুমে তিস্তা বালুচরে পরিণত হয় আর বর্ষা মৌসুমে পানিতে বন্যা প্লাবিত হয়ে পড়ে কয়েক জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা। বর্ষা মৌসুমে হঠাৎ করে অতিরিক্ত পানিতে নদী তীরবর্তী জনপদে ভাঙনের ফলে বাড়িঘর, স্কুল-কলেজ, হাট-বাজার নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়।
২০ বছর যাবৎ আলোচনার পরে প্রায় সাত বছর যাবৎ চ‚ড়ান্তভাবে তৈরি করা চুক্তি দুই প্রধানমন্ত্রী বা উভয় দেশের পানিসম্পদ মন্ত্রীর স্বাক্ষরের অপেক্ষায় রেখে দিয়ে আনুমানিক কয়েক মাসের আলোচনার ফলশ্রæতিতে নয়াদিল্লিতে সই করা হয়ে গেল ৩৫ দলিল, ২৪টি সমঝোতা স্মারক এবং ১১টি চুক্তি। আমাদের নিকটতম বন্ধুপ্রতিম দেশ বাংলাদেশের পানি স্বল্পতা ও অতিরিক্ত পানি ছেড়ে দেয়ার সমস্যার ভয়াবহতার প্রতি চরম অবজ্ঞা প্রদর্শন করে শুধু আশ্বাস ও প্রতিশ্রæতির বন্যায় ভাসিয়ে নিয়ে গেল বাংলাদেশের নেতৃত্বকেÑ ভারতের সাথে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুই দেশের স্বার্থরক্ষায় করা চুক্তি ও সমঝোতার সমালোচনা করা হচ্ছে এই একটি মাত্র কারণে। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বকে গণমানুষের এই আবেগের স্থানটিকে উপলব্ধি করতে হবে এবং স্বাধীন ও সার্বভৌম আমাদের রাষ্ট্রের পক্ষে ধৈর্য ধরার কোনো পরীক্ষা দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরের আগে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ৪৯টি চুক্তি স্বাক্ষরিত হতে পারে বলে খবর জানার পরে বাংলাদেশের বিরোধী রাজনৈতিক দল, গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজ ক্ষোভে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। এমন কি ভারতের গণমাধ্যমেও এ নিয়ে অস্বস্তি ও অসম্মতির সুর পরিলক্ষিত হয়। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রস্তাব তিস্তায় পানি নেই, তাই অন্য ছোট ছোট নদী থেকে বাংলাদেশকে পানি দেয়া যেতে পারেÑ এটি নিয়েও ভারতের নদী-বিশেষজ্ঞ ও গণমাধ্যম সমালোচনা-মুখর হয়ে ওঠে।
বহুল প্রচারিত দি হিন্দুস্তান টাইমসে প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়, ‘নয়াদিল্লি যদি ঢাকার সাথে তিস্তার পানি বন্টন চুক্তি করে ফেলে, তা অসাংবিধানিক হবে না।’ নরেন্দ্র মোদির সরকার ২০১১ সাল থেকে স্বাক্ষরের জন্য অপেক্ষমাণ তিস্তা পানি বণ্টন চুক্তি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তি উপেক্ষা করে স্বাক্ষর করবে না অনুমান করে অন্য বহুল প্রচারিত দৈনিক দি টাইমস অব ইন্ডিয়ায় লেখা হয়Ñ ‘২০১১ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময়েই তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তিতে শেষ মুহূর্তে তা বাতিল হয়ে যায়। এবারও হয়তো মমতাকে উপেক্ষা করে চুক্তির পথে হাঁটবে না কেন্দ্রীয় সরকার।’ দি হিন্দু বিজনেস লাইন-এ প্রকাশিত এক নিবন্ধে লেখা হয়Ñ ‘শেখ হাসিনার এবারের ভারত সফরে প্রতিরক্ষা, শিক্ষা, অবকাঠামো, চলচ্চিত্র, প্রযুক্তিসহ ৩০টি চুক্তি হতে পারে। তবে সবচেয়ে বড় ইস্যু তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি। এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেই কেবল শেখ হাসিনার সফরকে ঐতিহাসিক বলার সুযোগ তৈরি হতে পারে।’ ভারতের গণমাধ্যম তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার উদ্যোগ নেবে বলে আশা প্রকাশ করলেও বাস্তবে তা ঘটেনি। একমাত্র আশার সঞ্চার হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির এই ঘোষণায় যে, তারা তাদের সরকারের বর্তমান মেয়াদের মধ্যেই (আরো দুই বছর) তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষর করার চিন্তা করেছেন। অর্থাৎ তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরের কাজ অনধিক দুই বছর পিছিয়ে দেয়া হলো। তারপরেও নির্দিষ্টভাবে কোনো সময়-সীমা উল্লেখ না করে দুই প্রধানমন্ত্রীর বর্তমান মেয়াদের মধ্যে তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরের কথা বলা হয়েছে, যা বাস্তবিক পক্ষেই একটা অনিশ্চিত অবস্থার সৃষ্টি করেছে। অথচ চ‚ড়ান্তভাবে প্রস্তুত একটা চুক্তি স্বাক্ষর না করে নতুন নতুন ক্ষেত্রে আরো অনেক চুক্তি ও সমঝোতা স্বাক্ষর করা হলো।
দেশে বিরোধী রাজনৈতিক দল বিশেষ করে বামপন্থি দলগুলো এই পরিস্থিতির যেমন সমালোচনা করেছেÑ তেমনি সমালোচনা করেছে ইসলামী দলগুলো। এ ছাড়া কোনো রাজনৈতিক দলেরই সদস্য ননÑ এমন কয়েকজন শিক্ষাবিদ ও বিশিষ্ট নাগরিকও তিস্তা চুক্তিকে হিমঘরে রেখে অন্যান্য ক্ষেত্রে সমঝোতা স্মারক ও চুক্তি স্বাক্ষরকে অকুণ্ঠ সমর্থন দিতে পারেননি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল দৈনিক প্রথম আলোতে লিখেছেন : ‘তিস্তার ক্ষেত্রে চুক্তি হলেও তা হবে সিকিম এবং পশ্চিমবঙ্গের উচ্চ অববাহিকা থেকে প্রত্যাহারের পর গজলডোবায় প্রাপ্ত অবশিষ্ট পানি ভাগাভাগির। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে যে, এই অবশিষ্ট পানি ভাগাভাগির মিনতিই বাংলাদেশ জানিয়ে যাচ্ছে কয়েক দশক ধরে। বাংলাদেশ থেকে বহু কিছু পাওয়ার পরেও এটুকু দেয়ার চুক্তি ভারত করছে না পশ্চিমবঙ্গের আপত্তির কথা বলে।’ বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)-এর সহ-সভাপতি এবং তত্ত¡াবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সুলতানা কামাল ৭ এপ্রিল বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময়েই তিস্তার পানি ব্যবহারের চুক্তি নিশ্চিত করতে হবে। আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবহার সম্পর্কিত জাতিসংঘের আইনে ভাটির দেশেরও পানি পাওয়ার অধিকারের কথা রয়েছে। সে জন্যই তিস্তার পানি বাংলাদেশ কর্তৃক পাওয়ার ব্যবস্থা নিতে হবে। তিস্তা চুক্তির সাথে ফারাক্কা বাঁধও খুলে দিয়ে মুক্ত পানি প্রবাহের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।’ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. আলী রিয়াজ একটি জাতীয় দৈনিকের সাথে সাক্ষাৎকারেও এটা উল্লেখ করেছেন যে, ‘গঙ্গা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি রয়েছেÑ অথচ চুক্তির শর্তসমূহ যথার্থভাবে প্রতিপালিত হচ্ছে না।’ এ ছাড়া ড. আলী রিয়াজ শুধু তিস্তা চুক্তি নয়, ভারতের সাথে অভিন্ন ৫৪টি নদীর পানি বণ্টন নিয়েও আলোচনা হওয়ার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
বাংলাদেশের জন্য গঙ্গা, তিস্তা অন্যান্য নদী যেগুলো ভারত থেকে এসেছে সে নদীসমূহের পানি উজানে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বাঁধ নির্মাণে ও সেচ কাজে ভারতেরই বিভিন্ন রাজ্যে প্রবাহিত করার কারণে বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকা শুষ্ক মৌসুমে মরুভূমি ও বর্ষায় অতিরিক্ত পানিতে বন্যা প্লাবিত হওয়ায় উভয় সংকট হিসেবে দেখা দিচ্ছে। তাই অন্যান্য ক্ষেত্রে সম্পাদিত অনেক চুক্তির চেয়ে জরুরি ও জনগুরুত্বপূর্ণ ছিল অভিন্ন নদীসমূহের পানি বণ্টন চুক্তি। আর শেষ পর্যন্ত এই সফরের সময় সেটি না হওয়ায় অন্য সকল কিছুকেই তা ¤øান করে দিয়েছে।
লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন