শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আদিগন্ত

মঙ্গল শোভাযাত্রা সার্বজনীন নয়

| প্রকাশের সময় : ১৪ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মো. আবদুল লতিফ নেজামী
ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় মঙ্গল শোভাযাত্রাকে যুক্ত করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক অনৈসলামিকরণ শক্তি ইসলামী শিক্ষা-সংস্কৃতি বিলোপ করে তাদের কর্মসূচি ও কর্মনীতি মুসলিম দেশগুলোর ওপর চাপিয়ে দেয়ার যে অপপ্রয়াস চালাচ্ছে, ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় মঙ্গল শোভাযাত্রকে যুক্ত করা তারই প্রকৃষ্ট প্রমাণ। ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় মঙ্গল শোভাযাত্রাকে যুক্ত করার পর থেকে পহেলা বৈশাখে মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন গ্রামে-গঞ্জেও ছড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করা হয়েছে সম্প্রতি। মঙ্গল শোভাযাত্রা কর্মসূচি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা এব্যাপারে নাকি একটি আদেশও জারি করা হয়েছে অতি সম্প্রতি। এই আদেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে বিভিন্ন মহলের পক্ষ থেকে। যারা নিজস্ব সংস্কৃতি ধারণ, চর্চা ও অনুশীলন করার প্রয়াস চালান, তাঁরা মঙ্গল শোভাযাত্রা সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়ার বিরুদ্ধে সোচ্চার। তাঁরা মনে করেন, এই পরিকল্পনা বা আদেশের মাধ্যমে বিধর্মীদের সংস্কৃতিকে উচ্চকিত করে তোলার প্রয়াস চালানো হচ্ছে। এতে অন্যের ওপর সাংস্কৃতিক নির্ভরশীলতা, আধিপত্য ও সাংস্কৃতিক হীনমন্যতাবোধেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। এসব হচ্ছে চেতনাগত দাসত্বের ফল। এর মাধ্যমে সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আধিপত্যবাদী আকাঙ্খাকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হচ্ছে। অথচ মঙ্গল শোভাযাত্রা কোনোক্রমেই বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জীবনধারার সঙ্গে যুক্ত নয়। এতে ইসলাম এবং মুসলমানদের বোধ-বিশ্বাস ও সংস্কৃতি সম্পর্কে মঙ্গলশোভা সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনাকারীদের উদাসীনতারই নগ্ন বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। এতে মনে হয় তাঁরা (পরিকল্পনাকারীরা) একান্তই পাশ্চাত্যমুখী। তাঁদের বক্তব্য ইসলাকেন্দ্রিক নয়। বরং তাঁদের বক্তব্যে বিধর্মী সংস্কৃতির অন্ধ অনুগামিতারই প্রতিফলন ঘটেছে। তাঁরা এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের স্বতন্ত্র জাতীয় সংস্কৃতির কথা ভাবতে পারেন না। ইসলামী সংস্কৃতির প্রতি তাঁদের বিরূপ মনোভাব লক্ষ করা যায়। তাঁদের চিন্তা-চেতনায় কোনো স্বকীয়তা নেই। তাঁদের চিন্তা-ভাবনা একান্তভাবে আধিপত্যবাদী সংস্কৃতির ওপর নির্ভরশীল। তাদের আধিপত্যলিপ্সা চরিতার্থ করার জন্যে যা কিছু আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয়, তা গ্রহণ করা আমাদের জন্যে আত্মঘাতী।
মঙ্গল শোভাযাত্রা শিরক বা মহান আল্লাহর সাথে অংশীদারিত্বের ধারণা জড়িত। তাই মঙ্গল শোভাযাত্রা সার্বজনীন নয়, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার উৎসবও নয়। কেননা মঙ্গল শোভাযাত্রায় থাকে বিচিত্র রকম পশুপাখীর মুখোশ পরিহিত নর-নারী। এরা বাঘ বিড়ালের মুখে চিংড়ি, মা মাছ, সন্তানতুল্য ছোট মাছ, হাঁস, পাখা মেলা ময়ূর, ল²ী পেঁচা, হরিণ শাবকের মাধ্যমে বাঙালির আবহমান ঐতিহ্যকে তুলে ধরার দাবি করে থাকে। যেসব পশু-পাখি নিয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রা করা হয়, তাও এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ধর্মীয় বিশ্বাস ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের পরিপন্থী। কেননা সংখ্যালঘু একটি জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় বিশ^াস মোতাবেক পেঁচা মঙ্গলের প্রতীক ও ল²ীর বাহন, ইঁদুর গণেশের বাহন, হনুমান রামের বাহন, হাঁস স্বরসতীর বাহন, সিংহ দুর্গার বাহন, গাভী রামের সহযাত্রী, সূর্য দেবতার প্রতীক ও ময়ূর কার্তিকের বাহন। কেউ কেউ শরীরে দেব-দেবীর, জন্তু-জানোয়ারের প্রতিকৃতি, কালির লোহিত বরণ জিহŸা, গণেসের মস্তক ও মনসার উল্কি একে ভাঁড় সেজে এবং মৃদঙ্গ-মন্দিরা, খোল-করতাল বাজিয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করে।
মঙ্গলঘট, মঙ্গল প্রদীপ, মাঙ্গলিক প্রতীক অঙ্কন, চৈত্র সংক্রান্তি, পান্তা ইলিশ, উলুধ্বনী, রাখি বন্ধন, ধুতি পরিধান সিঁদুরের ব্যবহার, হোলি খেলা, অজন্তÍা স্টাইলে নাভিমূল অনাবৃত রেখে শাড়ি পরিধান প্রভৃতি আমদানি করা বিশেষ ধর্মীয় কুসংস্কারাচ্ছন্ন আচার-রীতির আগ্রাসনে পহেলা বৈশাখের চেতনাকে ভিন্নমুখী করা হচ্ছে। এই আগ্রাসন পরিচালিত হচ্ছে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির স্বাভাবিক বিবর্তনকে বাধাগ্রস্ত করে একটি স্বাধীন জাতির স্বাতন্ত্র্যবোধকে ধ্বংস করার জন্যে বিভিন্ন প্রথা পদ্ধতি চালু করার মাধ্যমে। অথচ গণতন্ত্রের দৃষ্টিতে অধিকাংশ মানুষের সংস্কৃতি ও মূল্যবোধকেই সার্বজনীনতার মর্যাদা দেয়া যেতে পারে।
এদেশে একটি সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর ধর্ম হচ্ছে প্রতীকবাদী। প্রতীকের মাধ্যমে তারা পূজা-প্রার্থনা করেন। ইসলামে এটা সম্ভব নয়। তাই মঙ্গল শোভাযাত্রায় যেসব প্রতীক উপস্থিত করা হয়, মুসলমানদের কাছে তা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। কারণ দুই সম্প্রদায়ের জীবন-দৃষ্টির মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে। সংস্কৃতির মানে হচ্ছে আত্মপরিচয়। মানুষের বিশ্বাস, আচরণ ও জ্ঞানের সমন্বিত প্যাটার্নকে বলা হয় সংস্কৃতি। ভাষা, সাহিত্য, ধর্ম ও বিশ্বাস, রীতি-নীতি, সামাজিক মূল্যবোধ, উৎসব, শিল্পকর্ম ও আইন-কানুন প্রভৃতি সবকিছু নিয়েই সংস্কৃতি। তাই মঙ্গল শোভাযাত্রা বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগণের সাংস্কৃতিক কোনো অনুষঙ্গেরই অংশ নয়।
স্থানীয় ও লোকজ ঐতিহ্যের উপাদান মুসলিম সংস্কৃতিতেও আছে, কিন্তু এর অবস্থান ইসলামী ঐতিহ্যের সীমানা অতিক্রম করে নয়। আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য কারো কাছে মঙ্গল প্রার্থনা করা এবং ন্যায়বিচারের প্রতীক মনে করা ইসলামে নিষিদ্ধ। মঙ্গল শোভাযাত্রার মাধ্যমে কল্যাণ চাওয়া মুসলিম সংস্কৃতির অংশ নয়। উৎসব হোক বা স্মৃতি রক্ষা হোক, নিজস্ব প্রথা-পদ্ধতি, নিয়ম-নীতি বা রীতি-রেওয়াজের অনুশীলন কাম্য।
কেননা এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের রয়েছে স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক চেতনা। রয়েছে একটি সমৃদ্ধ সংস্কৃতি। অন্য যেকোনো সংস্কৃতির বিকল্প মডেল। যা অন্য কোনো সংস্কৃতিতে লীন হওয়ার নয়। তাই জাতীয় আদর্শ, ঐতিহ্য রীতি-নীতি ও স্বকীয়তাবিরোধী প্রতীক সম্বলিত অপসংস্কৃতি লালন, চর্চা ও অনুশীলন থেকে বিরত থাকার ক্ষেত্রে সচেষ্ট হওয়া উচিৎ। বাঙালি সংস্কৃতির সার্বজনীনতা তত্তে¡র আড়ালে এসব বিধর্মীয় প্রথা অনুশীলনের জন্যে এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ তৌহিদী জনতাকে বাধ্য করার উদ্যোগ গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা অমুসলিমদের প্রতীক ও উপমা ব্যবহার করে কল্যাণ কামনা করা মুসলিম সমাজে প্রচলিত নয়। মঙ্গল শোভাযাত্রা একটি সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ধর্ম ও সংস্কৃতির অংশ। মূলত, দেব-দেবীকে উদ্দেশ করে এসব আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে একটি সংখ্যালঘু গোষ্ঠী কল্যাণ কামনা করে থাকে।
পশু-পাখিকে সমৃদ্ধি ও কল্যাণের প্রতীক মনে করা একজন তৌহিদবাদী মুসলমানের পক্ষে কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। মুসলমানরা বিশ্বাস করে সমৃদ্ধি ও কল্যাণ কেবলমাত্র আল্লাহর কাছ থেকেই আসতে পারে। এজন্যে তারা তাঁর কাছে মুনাজাত করেন। মুসলমানের সংস্কৃতির উৎস ইসলামী জীবন দর্শন ভিত্তিক মূল্যবোধ। তৌহিদ এর বুনিয়াদ।
আমাদের শৌর্য আছে, সংহতি আছে। জীবন উৎসর্গ করতে পারি। আমাদের ইতিহাস, বীর্যবল, আমাদের শিল্প, স্থাপত্য, সঙ্গীত, আমাদের আইন-কানুন আছে। এসব কথা মর্মস্পর্শীভাবে সাধারণ মানুষের হৃদয় বীণায় অনুরণন তুলতে হবে। তাছাড়া অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে থাকতে হবে আপসহীন, করতে হবে নির্ভীক সংগ্রাম। সত্যের জন্যে সংগ্রাম করতে পশ্চাপদ হওয়া যাবে না। সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে হতাশায় আচ্ছন্নতার মুখে সততা, আন্তরিকতা ও জয়ের অনিবার্যতায় আস্থাবান হতে হবে। হুংকার ছেড়ে দাঁড়াতে হবে লড়াইয়ের ময়দানে যৌবনদীপ্ত কেশরীর তেজে জয়ের নিশ্চিত আশা নিয়ে। দুর্ধর্ষ সংগ্রামে নেমে পড়তে হবে দুর্জয় বিশ^াস নিয়ে। সামগ্রিক চরিত্রে এই মানসিক দৃঢ়তার প্রতিফলন ঘটাতে হবে।
লেখক : ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Md. Joynul Abedin ২৭ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:১৫ পিএম says : 0
Quietly I except his opinion, Only almighty Allah & Rasul Sallallhu alaihi wassallam is Muslim Culture
Total Reply(1)
Quazi Ahmed ২৮ এপ্রিল, ২০১৭, ৫:৩০ এএম says : 4
Should be 'Quite' instead of 'Quiet'.Should be 'Accept' instead of 'Except'.

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন