শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আদিগন্ত

বহুমাত্রিক কবি

প্রকাশের সময় : ৩ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ড. কামাল চৌধুরী : সত্তর দশক। এক ধরনের অস্থিরতা, অস্থিতিশীল সময়। সদ্য স্বাধীন হওয়া একটি রাষ্ট্র; সব কিছুতেই বিশৃঙ্খলা, অরাজকতা। স্বাধীনতার স্বপ্ন নিয়ে যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল; পরবর্তীতে তারাই শুরু করলো নতুন যুদ্ধ ক্ষুধা, নৈরাজ্য ও দারিদ্র্যতার বিরুদ্ধে। ফলে কবিদেরও লেখার টেবিল ছেড়ে রাজ পথে চলে আসতে হলো। সত্তর দশকের কবিতাগুলো হয়ে উঠলো আর্তনাত, চিৎকার ও আহাজারীর কবিতা। যা ক্রমেই মানুষের দাবি আদায়ের লক্ষ্য বস্তু হিসেবে পরিণত হয়েছিল। তখন কবিতার নান্দনিক চেতনা, ছন্দ, মাত্রা, সৌন্দর্যবোধ সবকিছুই বিফলে যাচ্ছিল সামরিক ক্যু, রাজনৈতিক নিপীড়ন ও সাধারণ মানুষের আহাজারীর কাছে। এমন উত্তাল ও ঝড়ো সময়ের মধ্যে দিয়েও সত্তর দশকের যেসব কবি বাংলা কবিতার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছিলেন কবি কামাল চৌধুরী তাদের অন্যতম।
কামাল চৌধুরীর পুরো নাম কামাল আব্দুল নাসের চৌধুরী। ১৯৫৭ সালের ২৮ জানুয়ারি তার জন্ম হয়েছিল কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার বিজয় করা গ্রামে। চাকরি সূত্রে তিনি একজন সরকার কর্মকর্তা এবং ২০১০ সাল থেকে বাংলাদেশ সরকারের একজন সচিব হিসেবে কর্মরত। বর্তমানে তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব। তিনি একজন আধুনিক কবি। তার কবিতার প্রধান বিষয়বস্তু প্রেম ও দ্রোহ। তিনি তার লেখনীর মাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে পুরুস্কৃৃৃত হন- রুদ্র পদক (২০০০), সৌহার্দ্য সম্মাননা (পশ্চিমবঙ্গ) (২০০৩), কবিতালাপ সাহিত্য পুরস্কার (২০০৪), জীবনানন্দ পুরস্কার (২০০৮), সিটি- আনন্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার (২০১০), দরিয়ানগর কবিতা সম্মাননা (২০১০) এবং সর্বশেষ ২০১২ সালে তাকে বাংলা কবিতায় গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রদান করা হয়।
সম্প্রতি বই মেলায় কবি কামাল চৌধুরী তার নির্বাচিত কবিতার বইটি প্রকাশের মাধ্যমে নিজেকে বহুমাত্রিক কবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। তিনি এ কবিতার বইটির মাধ্যমে বিভিন্নভাবে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস, দুর্লভ চিত্র তরুণ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরেন। ফলে তরুণ সমাজ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশ গঠনের পাশাপাশি অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে দাবি আদায়ের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়ে ওঠার প্রেরণা পাবে। তার প্রকাশিত ‘মুক্তিযোদ্ধা’ কবিতাটির মাধ্যমে তরুণদের উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘চিরকাল শোন, চিরদিন এই দেশ’ ‘তোমাদের নামে হবে অবনত শির’ ‘লতা তৃণদল এই মাটি ধূলিকণা’ ‘তোমাদের নামে শ্বাস নেবে মুক্তির’ ‘যতকাল এই আকাশে উঠবে চাঁদ’ ‘পাখিরা গাইবে সাহসের ভাটিয়ালি’ ‘কোজাগরী রাতে যুদ্ধের পালা হবে’ ‘পথে শোনা যাবে আগামীর করতালি’
শুধু মুক্তিযুদ্ধ নয় ৫২’র ভাষা আন্দোলন, মার্চের রক্তঝড়া স্বাধীনতা আন্দোলন, ৭৫’র জাতীয় সঙ্কটের মুহূর্তসহ সব শোকময় অধ্যায়, অগ্নিঝড়া মুহূর্ত কিংবা প্রতিবাদী চিত্র এ প্রজন্মের কাছে কবি তুলে ধরেছেন তার বলিষ্ঠ লেখনীতে। তিনি ‘টুঙ্গীপাড়া গ্রাম থেকে’ শিরোনামের কবিতার মাধ্যমে স্মরণ করেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে এবং অঙ্গীকার করেন প্রতিশোধের।
‘তীব্র প্রতিশোধ আমি ছুড়ে দেই খুনিদের মুখে’ ‘দ্যাখো, আগুন জ্বলছে আজ শুদ্ধ সব বাঙালির বুকে’ ‘এখন স্বদেশে চাই, শুধু চাই’ তোমার সৈনিক কিছু সবল গোলাপ।’ ‘যেখানে ঘুমিয়ে আছ, শুয়ে থাক’ ‘বাঙালির মহান জনক’ ‘তোমার সৌরভ দাও, দাও শুধু প্রিয়কণ্ঠ।’
ড. কামাল চৌধুরীকে শুধু মুক্তিযুদ্ধ কিংবা প্রতিবাদী কবি মনে করে নির্দিষ্ট গ-িতে সীমাবদ্ধ করা যাবে না। তার নির্বাচিত কবিতার বইটির মাধ্যমে তিনি নিজেকে প্রকাশ করেন, কখনো প্রেমময় কবি, কখনো স্মৃতি কাতরময় কবি হিসেবে। প্রকৃতির অনাবিল সৌন্দর্য কিংবা প্রাকৃতিক বিপর্যয় কোনো কিছুই বাদ পরেনি তার কবিতা থেকে।
‘বন্যা ১৯৯৮’ কবিতাটির মাধ্যমে, তিনি ফুটিয়ে তুলেছিলেন প্রকৃতির বিপর্যয়ের করুণ কাহিনী, ‘রক্ষা বাঁধ ভেঙে পড়েছে, আজ আমার দুর্ভোগের পঁয়ষট্টি দিবস পার হলো। রাত্রি ঘোর কৃষ্ণবর্ণ বৃষ্টি ভয়াবহ বর্ষার ফলা, আরসব বানভাসি মৃত্যুকূপ ফুলে উঠেছে, ফুঁসে উঠছে, বাঘের থাবায় ছিন্ন-ভিন্ন স্বপ্নসৌধ।’
তিনি বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র কবি নজরুল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শামসুর রাহমান- কে বাংলা কবিতা সাহিত্যের মাস্তুল স্বীকৃতি দিতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেননি। নজরুল-এর উদ্দেশ্যে কবিতায় তিনি বলেন, ‘শুধু কবি নয়, চাই এক বিশাল হৃদয়’ ‘চাই এক জ্বল জ্বলে অগ্নিকু- কবিতার’ ‘এ রকম স্বপ্ন দেখে দেখে অসহায় মানুষের’ ‘মনে পড়ে, আপনাকে বড় বেশি মনে পড়ে।’
সাবেক শিক্ষা সচিব বর্তমান জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী রচিত ‘সাহসী জননী বাংলা’ কবিতাটি নবম-দশম শ্রেণির বাংলা পাঠ্যবইয়ে স্থান পেয়েছে। ২০১৩ শিক্ষাবর্ষ থেকে নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী রচিত মাধ্যমিক বাংলা সাহিত্য বইয়ের ২৫১ নম্বর পৃষ্ঠায় কবিতাটি সংযোজন করা হয়েছে। নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী রচিত বইটির ২৫১ নম্বর পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে কবি পরিচিতি। কবি পরিচিতিতে কামাল চৌধুরীর জন্মস্থান, বাবা-মা, শিক্ষাজীবন এবং কর্মজীবন নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। উল্লেখ্য, কামাল চৌধুরী ২০১০ সালের শেষ দিকে তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে বদলি হয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে নিযুক্ত হন।
পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. মোস্তফা কামাল উদ্দিন বইটির প্রসঙ্গ-কথা লিখেছেন। পুরানো শিক্ষাক্রমের বাংলা বই থেকে অনেক প্রতিষ্ঠিত কবির কবিতা বাদ দিয়ে নতুন কয়েকজন কবির কবিতা সংযোজন করা হয়েছে। এর মধ্যে আবদুল হাকিমের ‘বঙ্গবাণী’ ও আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর ‘মাগো ওরা বলে’ কবিতা দুটি বাদ দেওয়া হয়েছে।
য় আরাফাত হোসাইন শান্ত

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন