রাজনীতি হচ্ছে রক্তপাতহীন এক যুদ্ধ, আর যুদ্ধ হচ্ছে রাজনীতির বিকৃত রূপ। আমরা সুস্থ রাজনীতির পক্ষে, গণতন্ত্রের পক্ষে। একজন সৎ রাজনীতিকের কাছে সমাজকর্ম কিংবা সমাজ সংস্কারের সর্বোচ্চ অবলম্বন হচ্ছে রাজনীতি। রাজনীতির কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো আমাদের দেশের রাজনীতি এখন অনেকটা জনগণের কাঠগড়ায়। এর জন্য কিন্তু রাজনীতি দায়ী নয়, দায়ী নেতৃত্ব। মুষ্টিমেয় কিছু লোকের উচ্চাভিলাষ ও অপ-আকাক্সক্ষার জন্য রাজনীতি বিতর্কের মুখোমুখি হয়েছে। রাজনীতি দিয়ে রাজনীতিকে বিতর্কিত করার হোতাদের সংখ্যা কিন্তু খুব বেশি নয়। এরা রাজনীতির মূলধারাও নয়, রাজনীতিতে মেধা যোগ হলে পিছু হটে যাবে এরা। পিছু হটে যাবে পেশিশক্তি, দুর্বৃত্তায়ন ও কালো টাকার দাপট। রাজনীতিকরা পাবেন মিশনারির মর্যাদা।
বাংলাদেশের বড় দুটি রাজনৈতিক দল এখন ভেতরে ভেতরে দুর্বল। যার জন্য এক দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক সংকট গ্রাস করেছে বাংলাদেশকে। রাজনৈতিক দুর্বলতা থেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল ও ৫ জানুয়ারির একতরফা ও বিতর্কিত নির্বাচনের পথে পা বাড়িয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে বিএনপি করেছে এই নির্বাচন বর্জন। এখানেও একটা রাজনৈতিক দুর্বলতা কাজ করেছে। বিএনপি শক্তিশালী হলে আওয়ামী লীগ একতরফা নির্বাচন করার সাহস পেত না বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন।
কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, জনগণের শক্তি কোনো এক দিকে মোড় নিচ্ছে না; জনগণ আসলে কী চায়, এটা একটা বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য। তবে আর যাই হোক, জনগণ যে বর্তমান সরকারকে রাষ্ট্র ক্ষমতায় দেখতে চায় না এটা অনিবার্য সত্য; এটা শাসকগোষ্ঠীও যে জানে না তা নয়। কিন্তু জনগণ কি বিএনপিকে ক্ষমতায় দেখতে চায়? চাইলে বর্তমান সরকারকে হটাতে বিএনপির ডাকে জনগণ আন্দোলনে নামছে না কেন? আবার বিএনপিকে যে জনগণ চায় না সেটাও তো বোঝার কোনো উপায় নেই। কারণ বাংলাদেশের যে প্রান্তেই সুষ্ঠু নির্বাচন হচ্ছে, জনগণ বিএনপির প্রার্থীকেই বিপুল ভোটে নির্বাচিত করছে। যার জন্য সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ থেকে শাসকগোষ্ঠী সরে এসেছে, সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা শুনলেই এখন তারা ভয় পায়।
কার্যত দেশের চলমান রাজনীতি ও বিএনপির কর্মকা- নিয়ে জনগণের সঙ্গে ব্যাপক পরিসরে কথা বলেছি। জনগণ বিএনপিতে পরিবর্তন দেখতে চায়; জনগণ চায় নির্লোভ, সৎ, আদর্শবান, ত্যাগী ও তারকা নেতাকর্মীদের সমন্বয়ে একটি নতুন বিএনপির যাত্রা শুরু হোক, যে নেতাকর্মীদের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক থাকবে ওতপ্রোত। এটি করার যথেষ্ট সময় বিএনপি পেয়েছে এবং আরও সময় বিএনপির হাতে আছে। ক্ষমতায় না থাকলে দল শক্তিশালী হয়, এটাই বাস্তবতা। বিএনপি প্রায় ৮ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে। এ সময়ের মধ্যে বিএনপি কতটুকু শক্তিশালী হয়েছেÑএ প্রশ্ন রাখতে চাই বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে। আশা করি, বিএনপি নেতৃত্ব ব্যাপরটি অনুধাবন করবেন।
টাকা-পয়সা ও যোগ্যতা থাকলেই একজন রাজনীতিবিদ হওয়া যায় না। রাজনীতিবিদ হতে হলে জনগণের সঙ্গে থাকতে হয় নিবিড় সম্পর্ক। বিএনপি, ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের শীর্ষ পদে বহু নেতাকর্মী আছেন, যাদের সঙ্গে জনগণের কোনো সম্পর্ক নেই; মোটা অংকের টাকা দিয়ে তারা সংগঠনের পদ-পদবি ভাগিয়ে নিয়েছেন। এসব নিয়ে পত্রপত্রিকায় ব্যাপক লেখালেখি হয়েছে কিন্তু বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব এর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। যার কারণে জনবিচ্ছিন্ন নেতাকর্মী নিয়ে এই সংগঠনগুলো এখন মুখ থুবড়ে পড়েছে। জনগণকে সংগঠিত করে একটি গণআন্দোলন গড়ে তোলা এই সংগঠনগুলোর পক্ষে প্রায় অসম্ভব।
আসলে ২০০৮ সালের কাউন্সিলে বিএনপি একটা সুযোগ পেয়েছিল দলকে পুনর্গঠন ও শক্তিশালী করার। কিন্তু করা হয়েছে ঠিক উল্টোটা। বিগত আন্দোলনে বিএনপির হাজার হাজার সহজ-সরল নেতাকর্মীর বাড়িঘর, ব্যবসা-বাণিজ্য ও বেঁচে থাকার শেষ অবলম্বন তছনছ হয়েছে; অনেকে জীবনের তরে পঙ্গু হয়েছেন, অনেকে পরিবারের উপার্জনক্ষম মানুষ হারিয়েছেন; মামলা-মোকদ্দমায় পড়ে বহু নেতাকর্মী এখন পর্যন্ত বাড়িঘর ছাড়া। এসব দেখে মনে হয়, বিএনপি যে কত অসহায় একটি রাজনৈতিক দল। ক্ষমতা ভোগ ছাড়া এই দলের শীর্ষ নেতারা আর কিছু বুঝেন না। কেন্দ্রে দলের সাংগঠনিক বিপর্যয় না কাটিয়ে আন্দোলনে নামলে, আন্দোলন যেমন মুখ থুবড়ে পড়বে, তেমনি তৃণমূলের নেতাকর্মীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে যা বিএনপির অস্তিত্বই বিলীন করে দিতে পারে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন।
তবে বিএনপির সবচেয়ে বড় সম্পদ হচ্ছে দলটির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। যার জন্য বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপি এখনও একটা বড় জায়গা দখল করে আছে। খালেদা জিয়া অত্যন্ত দৃঢ়, স্বতঃস্ফূর্ত, পরিশ্রমী ও অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী। পরিশ্রমের দিক দিয়ে দলের নেতাকর্মীরা তার ধারেকাছেও যেতে পারবে না। এক দিনে ১৫টি বড় বড় জনসভা করার দৃষ্টান্তও খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে আছে। কিন্তু তার দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে সমন্বয় নেই; নেই কোনো ঐক্য। নেতার সঙ্গে নেতার দ্বন্দ্ব, কর্মীর সঙ্গে কর্মীর; একজন আরেক জনকে একেবারে সহ্যই করতে পারেন না। যার কারণে দলটির অগ্রযাত্রা হচ্ছে ব্যাহত।
বিএনপি নেতৃত্বের আত্মসমালোচনা ও আত্মউপলব্ধির যথেষ্ট প্রয়োজন রয়েছে। কেননা বর্তমান সরকারের অবস্থা এতটাই শোচনীয় যে, তাদের সমালোচনা করারও কোনো জায়গা খুঁজে পাওয়া যায় না। তাদের শাসনামল একটি অনিবার্য কলঙ্কজনক অধ্যায়ের শাসনামল। সুশাসন উপহার দিতে তারা শুধু ব্যর্থই নয়, চরমভাবেই ব্যর্থ হয়েছেন। তাদের আমলে শেয়ারমার্কেট লুট হয়েছে, পথে বসেছে লাখো পরিবার; রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক লুট হয়েছে, এমএলএম ব্যবসার নামে লাখ লাখ মানুষ নিঃস্ব ও সর্বস্বান্ত হয়েছে। ৬ বার বৃদ্ধি করা হয়েছে বিদ্যুতের মূল্য যা মানুষকে চরমভাবে বিক্ষুব্ধ করেছে; স্বপ্নের পদ্মা সেতু তুলকমালও কম হয়নি। আর আইনশৃঙ্খলার অবস্থা বলতে গেলে তো সামনে এসে যায় নারায়ণগঞ্জের লোমহর্ষক ও নজিরবিহীন হত্যাকা-, ফেনীর বর্বরতা, মিরপুরের নৃশংসতা ও দেশব্যাপী অব্যাহত গুম-খুন-অপহরণসহ আরও কত কী।
কিন্তু এত কিছুর পরও কি বিএনপি বর্তমান সরকারকে বিন্দু পরিমাণ বেকায়দায় ফেলতে পেরেছে? মাত্র ৫ শতাংশ মানুষের সমর্থন নিয়ে কি আওয়ামী লীগ অত্যন্ত শান্তি ও স্বস্তির সহিত দেশ পরিচালনা করছে না? এটা আওয়ামী রাজনীতির জন্য এক অসাধারণ কৃতিত্ব ও বিএনপির রাজনীতির জন্য এক অনিবার্য ব্যর্থতা ছাড়া আর কিইবা বলার আছে? এ অবস্থায় কি বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে পারত? পারত একতরফা নির্বাচন করে আবার ক্ষমতায় আসতে? কাজেই ব্যর্থতার চুলচেরা বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন না করে এবং সাংগঠনিক ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন না এনে আন্দোলনে নামলে, এ আন্দোলন যে মুখ থুবড়ে পড়বে না এর গ্যারান্টি কোথায়?
অন্যদিকে বিএনপির দুর্বলতার সুযোগ নেয়া সরকারের মোটেও উচিত হবে না, তাতে শুধু রাষ্ট্রই ভয়ানক ক্ষতির শিকার হবে না; ক্ষতির শিকার হবে আওয়ামী লীগও। সুতরাং সরকারের উচিত সব দলের অংশগ্রহণে দেশে দ্রুত একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা। কেননা একটি মন্দ কাজ দশটি ভালো কাজকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বাংলাদেশের জন্য তেমনই একটি মন্দ কাজ। এই নির্বাচন বাতিল করে নতুন নির্বাচনের ব্যবস্থা করলে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ অনেক শক্তিশালী হবে। চূড়ান্তভাবে জনগণ আবার আওয়ামী লীগকেই বেছে নিতে পারে।
জাতির বৃহত্তর স্বার্থে প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো যদি ন্যূনতম ঐকমত্যে আসতে না পারে তাহলে রাজনীতির পরাজয় হবে। বাংলাদেশের ইতিহাস বদলে যাবার উপক্রম হবে। গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাওয়া ব্যাহত হবে। কাজেই রাজনীতিকে ঐক্যের ইতিবাচক ধারায় ফিরে আসতেই হবে। ভেতর থেকে বদলে দিতে হবে রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলগুলোকে। তাহলেই বাংলাদেশ পৌঁছতে পারবে আকাক্সক্ষা পূরণের অভীষ্ট লক্ষ্যে।
জাতিসংঘ, আমেরিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ সবাই চায় বিবদমান রাজনৈতিক পক্ষগুলোর মধ্যে সমঝোতা, এর জন্য সবাই দ্রুত সংলাপের আহ্বান অব্যাহত রেখেছেন; সংলাপ চায় দেশের প্রত্যেকটি মানুষও; কেননা সংলাপ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার পূর্বশর্ত। আমরা চাই বিবদমান রাজনৈতিক পক্ষগুলোর মধ্যে অতি দ্রুত সংলাপ শুরু হোক। সফল হোক জাতিসংঘসহ সবার প্রচেষ্টা। দেশে আসুক রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, কেটে যাক রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা। শক্তিশালী হোক রাজনীতি ও রাজনীতিকরা।
য় লেখক : কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
নবষধুবঃথ১@ুধযড়ড়.পড়স
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন