আল ফাতাহ মামুন : কোটি মানুষে ঠাসা আমাদে এই নগরী ঢাকা। একটু সুন্দর বসবাস ও সর্বোচ্চ নাগরিক সুবিধা পাওয়ার আশায় মফস্বল ছেড়ে আমরা ঢাকায় ঠাঁই খুঁজি। কিন্তু ক’জনই পাচ্ছি সুন্দর জীবনের অনাবিল আনন্দ? হাজারো সমস্যায় জর্জরিত আমরা ঢাকাবাসী। বাসাবাড়িতে পানি ও গ্যাসর সংকট, রাস্তায় যানজট, স্কুল-কলেজে বিপর্যস্ত পরিবেশ, ব্যবসায়-বাণিজ্যে অস্থিরতা, ধোকাবাজি-ঠকবাজি; এক কথায় এমন কোনো হয়রানি নেই যার ছোঁয়া ঢাকাবাসীর জীবনে লাগেনি। গেল কয়েকদিন ধরে যে হয়রানিটি রাজধানীবাসীর জীবনে নতুন নামে যুক্ত হয়েছে তা হলো ‘সিটিংয়ের বদলে চিটিং’ বিপত্তি। এ হয়রানিটি আগেও ছিলো। এখনো আছে। শুধু নাম পাল্টেছে। এই নাম বদলের ধকল সামলানো আমাদের জন্য ‘গোদের ওপর বিষফোঁড়া’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
‘সিটিং সার্ভিস’ নাম দিয়ে নির্ধারিত ভাড়ার কয়েকগুণ বেশি ভাড়া আদায় করে আসছে রাজধানীর বাস-মিনিবাস কতৃপক্ষ। কখনো কখনো যাত্রীরা এর প্রতিবাদ করলে প্রতিকারের বদলে হয়রানির স্বীকারই হতে হয়েছে অধিকাংশকে। কিন্তু এখন চিত্র পাল্টে গেছে। ‘সিটিংয়ের নামে বেশি ভাড়া আদায় চলবে না’- এ ¯েøাগান দিয়ে রোববার থেকে সিটিং সার্ভিস বন্ধের ঘোষণা দিয়েছেন ‘পরিবহন মালিক শ্রমিক সংগঠন’। আশা ছিলো, এবার বুঝি হাফ ছেড়ে বাঁচবে সাধারণ যাত্রীরা। কিন্তু রোববার থেকে রাস্তায় নেমে দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হচ্ছে যাত্রী ও পথচারীদের। অপর দিকে স্বস্তি ও শান্তির ছাপ পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের চোখে মুখে ম্পষ্ট হয়ে ওঠেছে সময়র সঙ্গে পাল্লা দিয়ে।
যাত্রীদের ভোগান্তির কারণ আগে ভাগেই অনুমান করতে পেরেছিল সংশ্লিষ্টরা। ‘সিটিং সার্ভিস’ বন্ধ মানে ‘মুড়ির টিন সেবা(!)’ চালু। আর মুড়ির টিন যাত্রী হয়রানির প্রধান হাতিয়ার। গাদাগাদি, ঠাসাঠাসি, যত্রতত্র বাস থামিয়ে যাত্রীর ওঠা-নামা, ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাস দাঁড় করিয়ে রাখার নাম মুড়ির টিন সার্ভিস। এটা ফিরে এসেছে রোববার থেকেই। পাশাপাশি বিআরটিসির অভিযানের কারণে অবৈধ বাস রাস্তায় নামায়নি চালকরা। তৈরি হয়েছে কৃত্রিম সংকট। এতসব অসুবিধার পর বড় নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছে ভাড়া নিয়ে। ভাড়া কাটা হচ্ছে আগের মতই। কোন কোন বাসে আগের চেয়েও বেশি। এমন অভিযোগই করেছেন যাত্রীসাধারণ। সোম ও মঙ্গলবারের প্রায় সবকটি জাতীয় দৈনিক এ বিষয়ে প্রথম পাতায় খবর ছেপেছে বেশ গুরুত্ব দিয়ে। কাগজের ভাষায় বলতে গেলে ‘লিড নিউজ’ করে।
কথা ছিলো প্রতিটি বাসে যেন ভাড়ার তালিকা থাকে। কিন্তু অল্প বাস-কতৃপক্ষই কথা রেখেছে। ভাড়া বেশি রাখছেন কেন এ প্রশ্নের জবাবে হেলপাররা বলেন, আমাদের এখনো কোন নির্দেশ দেওয়া হয়নি। তাই আগের ভাড়াতেই চলছে। এ নিয়ে কথাকাটাকাটি থেকে শুরু করে মারামারির ঘটনাও ঘটছে বলে জানা যায়। বাস কম থাকায় অনেক যাত্রীকেই রিক্সায় বা সিএনজিতে করে গন্তব্যে পৌঁছতে হয়েছে। ক্লাস পেতে দেরি হয়েছে শিক্ষার্থীদের। অর্থাৎ হঠাৎ সংকটে যে ভোগান্তি হওয়ার কথা তার ষোলআনায় ভুগছে রাজধানীবাসী।
‘সিটিং সার্ভিস’ নামে কোন সার্ভিসের অনুমোদন কোন সময়ই সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া হয়নি। কিন্তু এ সার্ভিস বন্ধের পরপরই ঠাসাঠাসি করে যাত্রী ওঠানো এবং বেশি ভাড়া আদায়ের কারণ হিসেবে ওই সিটিং বন্ধকেই দায়ী করছে চালক-হেল্পাররা। আইন বলছে ভিন্ন কথা। ঠাসাঠাসি করে যাত্রী ওঠানো ও বাসে নির্ধারিত সংখ্যার চেয়ে বেশি সিট রাখা মোটর যান আইনপরিপন্থী। আইনে আছে বাসে ৩৭টি আসন থাকবে বড় বাসে। আর সর্বোচ্চ ১০ জন যাত্রী দাঁড়িয়ে যেতে পারবে। এসব আইনের কোন তোয়াক্কা না করে ৪১ আসনের বাস দাপিয়ে বেড়াচ্ছে রাজধানীজুড়ে। আর এসব বাসে বসতে হচ্ছে পা ও মাঝা বাঁকা করে। মিনিবাসের অবস্থাতো আরো ভয়াবহ। দাঁড়াতে হয় মাথা ঝুঁকে। বসতে হয় প্রায় আরেকজনের কোলে! অথচ মোটর যান আইন এধরনের বাসের অনুমতিও দেয় না। এক কথায় সব ভোগান্তি যেন যাত্রী সাধারণেরই। অনেকটা টাকা গুনে খাঁচাবন্দি হয়ে যাতায়াত করছে রাজধানীবাসী।
বিআরটিসি’র পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে সমস্যা সমাধান না হওয়া পর্যন্ত অভিযান চলবে। এই কথা বলতেই এক হেল্পপার মন্তব্য করেন, ‘সমস্যা সমাধান না ছাই। তাদের পকেট না ভরা পর্যন্ত অভিযান চলবে। পকেট ভরে গেলে অভিযান বন্ধ হয়ে যাবে। আবার কয়েকমাস পর অভিযান শুরু হবে। এভাবেই চক্রকারে চলতে থাকবে অভিযানের আড়ালে পকেট ভর্তির কেরামতি।’ এর আগে ফিটনেসবিহীন গাড়ি বন্ধের ব্যাপারে অভিযান চলেছে। সময় সময় রাস্তায় মোবাইল কোর্ট বসে। অনেকে আইনের জালে ফাঁসে। অনেকে জাল ছিঁড়ে বের হয়ে যায় ক্ষমতার দাপটে। এবারের অভিযানও যে, যাত্রী সাধরণের উপকারের বদলে হয়রানিই বাড়াচ্ছে তা গত সোম ও মঙ্গলবারের প্রথম আলো, বাংলাদেশ প্রতিদিন ও ইনকিলাবসহ জাতীয় দৈনিকগুলোর প্রথম পাতয় চোখ বুলালেই প্রমাণ মিলবে।
যাত্রীদের হয়রানি বিপরীতে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের মুখে তৃপ্তির হাসি। এমনটিই হওয়ার কথা ছিলো। কারণ, সিটিং সার্ভিস বন্ধ, নতুন ভাড়ার তালিকা- এসব যে পরিবহন-মালিক সমিতর পক্ষ থেকেই করা হয়েছে। তাহলে তাদের মুখে হাসি ফুটবে না তো আমাদের মতো অভাগা যাত্রীর মুখে ফুটবে? ‘গোড়ায় গলদ’ প্রবাদের বাস্তব উদাহরণ যেন আমাদের বর্তমান পরিবহন ব্যবস্থা। যাত্রীদের কষ্ট লাঘবে সরকারি বা যাত্রীবান্ধব কমিটি দিয়ে আইন ও নীতি প্রণয়ন করা উচিত ছিলো। উচিত কাজ না করার ফলাফল হাতে হাতে পাচ্ছে সাদারণ জনগণ। তবে আমার মন বলছে, আমাদের এ দেশ আইন ভাঙায় কারখানা। যে আইন এখন করা হয়েছে তা কদ্দিন চলবে আল্লাহই ভালো জানেন। সেই আগের অবস্থা ফিরবেই। নতুন নামে অথবা নতুনভাবে। মাঝ থেকে সাধারণ যাত্রীদের হয়রানি করা হলো, আবার ভাড়াটাও বাড়িয়ে নিলো। তাই ‘যত দোষ নন্দ ঘোষ’ প্রবাদের মতই বলতে হচ্ছে- যত হয়রানি সব যেন যাত্রীর চোখেরই পানি।
আরেকটি কথা না বললেই নয়। আমি একজন শিক্ষার্থী। আগে তো সিটিং সার্ভিসে ‘হাফ-ফাস নেই’ বলেই পুরো ভাড়া আদায় করে নিত। এখন কি হাফ ভাড়া দেওয়ার ব্যবস্থা থাকবে নাকি পরিবহন সংগঠন এ বিষয়টি নিয়ে জল ঘোলা করবেন। আশা করি, বিষয়টি নিয়ে হয়রানি বন্ধ হবে। এটি শুধু আমার একার কথা নয়। রাজধানীর লাখো শিক্ষার্থীর প্রাণের দাবি। কিন্তু ইতিমধ্যে আমার একাধিক ক্লাসমেট জানিয়েছেন, হাফ ভাড়া দিতে গিয়ে তাদের সঙ্গে হেলপারের কথাকাটাকাটি হয়। সমস্যাটা ঠিক এরকম। নতুন আইনে সর্বনি¤œ ভাড়া ৭ টাকা। আমরা এই ৭ টাকার হাফ চার বা পাঁচ টাকা দিতে চাই। তখন হেলপার আমাদের আইন শিখিয়ে বলেন, সাত টাকার নিচে ভাড়া নেওয়া নিষেধ। আমরা তখন বলি, সাত টাকাই তোমাকে দিচ্ছি তবে শিক্ষার্থী হওয়ায় তা চার টাকা হয়েছে। তখন আর সে আমাদের আইনটি বুঝতে চায় না। বিপত্তিটা এখানেই।
আরও অবাক করার বিষয় হলো লোকাল সার্ভিসে পরিবর্তিত হওয়ার এক সপ্তাহ পার হওয়ার আগেই বৃহস্পতিবার থেকে পূর্বের নিয়মে ফিরে পরিবহনগুলো। এ যেন এক ভানুমতির খেল। কিছুই যেন বলার নেই।
আমাদের যাত্রা নিরাপদ ও শান্তিময় হোক। মালিক-শ্রমিক-যাত্রী সবার মুখে হাসি ফুটুক। সিটিংয়ের বদলে চিটিংবাজি বন্ধ হোক। সুন্দর গন্তব্য নিশ্চিত হোক। এটাই প্রত্যাশা।
য় লেখক : শিক্ষার্থী, ডিপ্লোমা ইন অ্যারাবিক ল্যাঙ্গুয়েজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন