রেজা হাসান
(গতকাল প্রকাশিতের পর)
উৎসর্গ শব্দের খোঁজে : ‘উৎসর্গ’ সংস্কৃত ভাষার একটি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ, স্বত্ব ত্যাগ করে দেবতাকে অর্পণ। সংস্কৃত ভাষায় এমন কিছু শব্দ আছে যেগুলো শুধু ধর্মীয় কারণে ব্যবহার হয়, উৎসর্গ তার মধ্যে একটি। অনেক ইসলামী চিন্তাবিদ অসচেতনতাবশত তাদের লেখা বই স্ব স্ব স্নেহভাজন বা শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিকে ‘উৎসর্গ’ করে থাকেন। স্নেহ বা শ্রদ্ধা যদি প্রদর্শন করতেই হয়, তবে ‘উৎসর্গ’ ব্যবহার করে কেন? দেবতাদের জন্য যে শব্দ নির্ধারিত সে শব্দ মুসলমানরা কীভাবে ব্যবহার করতে পারে? দেবতাপন্থী বা হিন্দুরা তো মুসলমানদের কাছ থেকে কোনো শব্দ আহরণ করেন না!
এ প্রসঙ্গে আক্ষেপ করে জহুরী তার ‘শব্দ সংস্কৃতির ছোবল’ গ্রন্থে বলেন, ‘বাংলাদেশের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইসলামের অর্থনীতির উপর এক পুস্তক লিখে ‘উৎসর্গ’ করেছেন নবী মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে। স্বীকার করি, অধ্যাপক সাহেবের নবীপ্রেম অত্যন্ত প্রগাঢ়। কিন্তু আবেগ তার এতো বেশি যে, দেবতার জন্য যে শব্দ অন্য ধর্মাবলম্বীরা ব্যবহার করে থাকেন, তিনি সেই শব্দ ব্যবহার করেছেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বেলায়। এ ক্ষেত্রে তিনি স্বকীয় সংস্কৃতির বিধিবিধান লংঘন করেছেন’(জহুরী কর্তৃক প্রণীত ‘শব্দ সংস্কৃতির ছোবল’, পৃষ্ঠা: ২৩, প্রকাশকাল: মে ২০০০)।
আরবীয় বণিক ও ধর্মপ্রচারকদের পদচারণায় মুখরিত আমাদের এ বাংলাদেশ। তাদের আগমনের সাথে সাথে আমাদের দেশে প্রবেশ করে এক সমৃদ্ধ মুসলিম সংস্কৃতি। আমরা পরিচিত হই আরবী, ফারসী, তুর্কী, উর্দু প্রভৃতি শব্দের সাথে। এ দেশের কবি-সাহিত্যিকরা তাদের রচনায় ব্যবহার করেন এসব ভাষার শব্দাবলী। কবি-সাহিত্যিকদের ব্যবহৃত শব্দাবলী নিয়ে রচিত হয়েছে অভিধান। বাংলা ভাষার শব্দ-ভান্ডার হয়েছে সমৃদ্ধ। তাহলে আমরা বলতে পারি, আমাদের শব্দ-ভান্ডারে ‘উৎসর্গ’ শব্দ ছাড়াও অসংখ্য শব্দ রয়েছে। আমরা ‘উৎসর্গ’ শব্দের পরিবর্তে ব্যবহার করতে পারি, ‘নজরানা’ ‘হাদিয়া’ ‘তোহফা’ প্রভৃতি শব্দ।
মুসলামানদের জন্য ‘উৎসর্গ’ শব্দটি অপসংস্কৃতিমূলক শব্দ। সাধারণ অর্থে এর ব্যবহার চরম আপত্তিকর। নজরানা, তোহফা, হাদিয়া এসব শব্দ যদি ভালো না লাগে বা এসব শব্দে যদি মৌলবাদী গন্ধ পাওয়া যায়, তাহলে আমরা ‘উৎসর্জন’ ব্যবহার করতে পারি। তাছাড়া আমরা ‘উৎসর্গ’ পৃষ্ঠায় লিখতে পারি, ‘শ্রদ্ধা বা স্নেহের নিদর্শনস্বরূপ’ বা ‘অমুকের দস্ত মুবারকে’ বা ‘অমুকের স্মৃতির স্মরণে’ ইত্যাদি। মনে রাখতে হবে, দেবতার উদ্দেশ্যে জীবন উৎসর্গ করা মানে ‘বলি’ হওয়া, আর আল্লাহর রাহে জীবন কোরবান করা মানে ‘শহীদ’ হওয়া। সুতরাং, ‘উৎসর্গ’ শব্দ ব্যবহারে আমাদের সতর্ক হতে হবে।
কালিমা মানে কী? ইসলাম ধর্মের ভিত্তি পাঁচটি বিষয়ের উপর। তার মধ্যে প্রথমটি হলো কালিমাতে বিশ্বাস। ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও রাসূল’Ñ এই কালিমা বা বাক্যে রয়েছে একত্ববাদ ও রিসালাতের মেলবন্ধন। এই বাক্যের উপর বিশ্বাস স্থাপন করা, মুখে স্বীকার করা ও আমলে পরিণত করা প্রত্যেক মুসলিমের কর্তব্য। এই কালিমাকে মূল ভেবে প্রত্যেক মুসলিম বা মুমিন আল্লাহ ও তার রাসূলের অনুগত থাকে এবং জীবনের প্রত্যেক ক্ষেত্রে আল্লাহ ও তাঁর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশিত পথে জীবন পরিচালনায় সচেষ্ট থাকে।
‘কালিমা’ শব্দের বাংলা অর্থ, ‘কালিমাÑমলিনত্ব, কলঙ্ক’। (রাজশেখর বসু কর্তৃক প্রণীত চলন্তিকা আধুনিক বঙ্গ ভাষার অভিধান, পৃষ্ঠা : ১১১)। সংসদ বাঙ্গালা অভিধানের চতুর্থ সংস্করণে রয়েছে, ‘কালিমাÑবি. মলিনতা, কৃষ্ণতা, কলঙ্ক। [সং. কাল+ইমন (ভা)]’ (সংসদ বাঙ্গালা অভিধান, পৃষ্ঠা: ১৫০, চতুর্থ সংস্করণ, ফেব্রæয়ারি ১৯৮৪)। এই দুই অভিধানের দিকে লক্ষ করলে আমরা কালিমার অর্থ পাই, দাগ, কলঙ্ক, মলিনতা ইত্যাদি।
কালিমার এই বাংলা অর্থ করে হিন্দুবাবুরা বোঝাতে চেয়েছেন যে, মুসলমানদের ঈমানের মূল বাক্যেও দাগ বা কলঙ্ক রয়েছে। আমরা যারা ‘দাগ’ বা ‘কলঙ্ক’ অর্থে ‘কালিমা’ ব্যবহার করি, তারা কতটা নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দেই তা বোধ হয় নিজেরাও জানি না। সম্প্রতি অনেক মুসলিম লেখক তাদের লেখ্য রীতিতে এই অর্থে ‘কালিমা’ ব্যবহার করে থাকেন। কোনো ভাষাবিদ হয়তো এ কথা বলতে পারেন যে, ‘কালিমা’ শব্দটি ‘কালো’ বা ‘কালি’ থেকে নির্গত হয়ে এর সাথে প্রত্যয় যোগে ‘কালিমা’ হয়ে অর্থ হয়েছে কলঙ্ক বা মলিনতা; এর সাথে আরবী ‘কালিমা’র কোনো মিল নেই। আমাদের বক্তব্য হলো যে, প্রত্যেক মুসলমান মাত্রই কালিমাতে বিশ্বাসী। আর যে মুসলমান কালিমাতে বিশ্বাসী সে কখনো ‘কলঙ্ক’ অর্থে ‘কালিমা’ শব্দ ব্যবহার করতে পারে না।
গলদ কি বিসমিল্লাহতে? বাংলা ভাষাভাষী পাঠক ও পাঠিকারা নিশ্চয় ‘বিসমিল্লায় গলদ’ বাগধারাটির সাথে পরিচিত আছেন? যার অর্থ হচ্ছে, শুরুতেই ভুল, সূচনাতে গন্ডগোল। বাগধারাটির অর্থ যাই হোক, পাঠক বা পাঠিকা একটু ভাবুনতো, আপনি কী বলছেন? আপনি বলছেন ‘বিসমিল্লায় গলদ’।
আমাদের জানতে হবে যে, এই শব্দটির আবিষ্কারক মুসলিমবিদ্বেষী লেখক। তারা বিসমিল্লায় গলদ দেখিয়ে বিসমিল্লাহভিত্তিক ইসলামের যাবতীয় কর্মকান্ডকে গলদ প্রমাণ করতে চান। যেসব মুসলিম লেখক এ বাগধারাটি ব্যবহার করেন, তারা শব্দটির ভাবার্থ এবং ঈমান-আকীদার বিষয়টি চিন্তা করে ব্যবহার করেন কিনা জানি না। ভেবে-চিন্তে কোনো মুসলমান এ শব্দটি ব্যবহার করতে পারেন না। যারা জেনে বুঝে ব্যবহার করেন তারা নিজেদের ঈমানের গলায় ছুরি চালান বলেই আমাদের বিশ্বাস।
ইসলামে বিসমিল্লাহর গুরুত্ব কতো গভীর অর্থবহ ও বরকতময় তা প্রত্যেক মুমিন জানেন। পবিত্র কোরআনে একটি মাত্র সূরা ছাড়া প্রত্যেক সূরার শুরুতে স্বয়ং আল্লাহপাক বিসমিল্লাহ ব্যবহার করেছেন। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর জীবনে যতো কাজ করেছেন, সব কাজের শুরুতে বিসমিল্লাহ ব্যবহার করেছেন। বিসমিল্লাহ বলে কাজ শুরু করলে আল্লাহ সে কাজে বরকত দেন। কাজের জটিলতা দূর করে দেন। এই বরকতময় বিসমিল্লাহতে কেমন করে গলদ থাকতে পারে তা আমাদের বোধগম্য নয়। বিসমিল্লাহতে যদি গলদ থাকে তাহলে শুদ্ধ কোথায় পাওয়া যাবে?
‘বিসমিল্লায় গলদ’ বাগধারাটির বিকল্প বাগধারা হলো ‘গোড়ায় গলদ’। (দ্রষ্টব্য: জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক প্রণীত ‘বাংলা ভাষার ব্যাকরণ, নবম-দশম শ্রেণি’) এই বিকল্প বাগধারা ব্যবহার করে বা ‘সূচনায় গলদ’, ‘গোড়ায় ভুল’, ‘মূলে ভুল’ এসব শব্দ দ্বারা সুন্দরভাবে ভাব প্রকাশ করা যায়। বড়ো দুঃখ লাগে যখন ইসলামী বই-পুস্তকে বা মাদরাসার সিলেবাসেও এই বাগধারাটির ব্যবহার পাওয়া যায়। গত কয়েক বছর আগে কওমী মাদরাসার শিক্ষাবোর্ড ‘বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া’ এর একটি ব্যাকরণ গ্রন্থে এ বাগধারাটির ব্যবহার পাই। যখন এই নিবন্ধ লিখছি তখনও ঐ ব্যাকরণগ্রন্থের পরবর্তী সংস্করণে (২০১৫ ঈসায়ী) বাগধারাটি দেখতে পেয়ে যার পর নেই বিস্মিত হলাম। যারা গ্রন্থটির সংকলক বা রচয়িতা তারা শব্দটির মূল কী, একবারের জন্য ভেবে দেখেছেন? সর্বোপরি কথা হলো, যারা এ শব্দটির মূল ভাবার্থ জানেন তাদের লেখায় বা কথায় ‘বিসমিল্লায় গলদ’ আসতে পারে না। আমরা যেন এ ভুল আর না করি।
ভেস্ত বা হদিসের উৎপত্তি : ভেস্ত আর হদিস এই দুটি শব্দ বেহেশত এবং হাদীস বানানের বিকৃত রূপভেদ। শব্দ দুটির অর্থ সন্ধানে আমরা কলকাতা থেকে প্রকাশিত সংসদ বাঙ্গালা অভিধানের দ্বারস্থ হলাম। অভিধানের চতুর্থ সংস্করণের ৫৪৯ নং পৃষ্ঠায় লেখা রয়েছে, ‘ভেস্ত-বেহেশত এর রূপভেদ’। ‘হাদীস’ শব্দ খুঁজতে গিয়ে ৭১৮ নং পৃষ্ঠায় পেলাম, ‘হাদিস, হাদীসÑহদিস এর রূপভেদ’। ৭১১ নং পৃষ্ঠায় হদিস-এর অর্থ রয়েছে, তত্ত¡, সন্ধান, খোঁজ।
এ প্রসঙ্গে মরহুম জহুরী সাহেবের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, ‘শব্দ দুটির বিকৃত রূপ ও বিকৃত বানানের জনমদাতা এক শ্রেণির হিন্দু লেখক। মুসলমানদের বেহেশত নসীব হওয়াকে ও বেহেশতে যাওয়ার আশাকে গোল্লায় যাওয়ার অর্থে ব্যঙ্গ করে ব্যবহার করেন। এ কারণে তারা বেহেশতের শুদ্ধ বানানকে উপহাস করে ভুল বানানে লেখেন। তারা পত্রপত্রিকায় লেখেন, ‘প্রকল্পটি ভেস্তে গেছে।’ কোরআনের পর যে হাদীসের স্থান সে হাদীসকে হদিস বানিয়ে যেমন ইচ্ছা তেমন ব্যবহার করা হচ্ছে। পুলিশ আসামি খুঁজে পাচ্ছে না এ ক্ষেত্রেও ‘হদিস’ প্রয়োগ হচ্ছে; অর্থাৎ ‘পুলিশ আসামির কোনো হদিস পাচ্ছে না।’ হিন্দু লেখকেরা এই দুই শব্দকে বানানে ও অর্থে বিকৃত করে এবং প্রয়োগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে শব্দ দুটিকে মুসলামানদের বিকৃত ব্যবহারের জন্য ছেড়ে দিয়েছেন। মুসলমানরা বাবুদেরই অনুসরণ করছেন বোকার অনুসরণের মতো’ (শব্দ সংস্কৃতির ছোবল, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা: ৫৮-৫৯)।
হিন্দু বাবুরা হাদীসকে লেখেন ‘হদিস’। এক পর্যায়ে ‘হদিস’ থেকে ()ি ই-কার ফেলে দিয়ে হয়তো বলতে পারেন ‘হদস’Ñ যার অর্থ নাপাকী, অপবিত্রতা। একবার ভেবে দেখুন, ‘হাদীস’ কে তারা কী জঘন্য অর্থে ব্যবহার করতে পারেন? মুসলিম লেখকরা ‘হদিস’ থেকে দূরত্ব বজায় রাখুন।
মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা! জন্ম ও মৃত্যু আল্লাহর হাতে। কার, কখন, কোথায় জন্ম হবে যেমনিভাবে আল্লাহ জানেন, তেমনিভাবে কখন, কোথায়, কীভাবে কার মৃত্যু হবে তাও আল্লাহ জানেন। আমরা দেখি, সামান্য অসুখ হলেই মানুষ মারা যায়। আবার কঠিন রোগে ভোগে একজন মানুষ আরোগ্য লাভ করেছে, যার বেঁচে থাকার আশা চিকিৎসক ও আত্মীয়স্বজন করেননিÑ এমন লোকও আছেন।
এখন প্রশ্ন হলো, মানুষ যখন রোগে ভোগে তখন কি তার মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ার বা যুদ্ধ করার শক্তি থাকে? রোগী তো দুর্বল। বিছানায় পড়ে থাকা আর কিছুই সে করতে পারে না। যারা বলে থাকেন, ‘অমুক মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে’ তাদেরকে বলি, রোগী যখন সুস্থ ছিলো তখন তাকে লড়াইতে নামাননি কেন? তাহলেই তো মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ার ধৃষ্টতা দেখাতো না। বিশ্বের এমন কোনো শক্তিশালী লোকের নাম কি আমরা জানি, যিনি মৃত্যুর সাথে লড়ে বিজয়ী হয়েছেন? যদি এমন কোনো দৃষ্টান্ত না থাকে তাহলে ঈমানের সাথে সাংঘর্ষিক এমন শব্দ দিয়ে বাক্য গঠনেও আমাদের সতর্ক হতে হবে।
কেউ হয়তো বলবেন, ‘মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা’ কথা দ্বারা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর সাথে লড়াই করার কথা বোঝানো হচ্ছে না। রোগীর অবস্থা যে খারাপ তাই বোঝানো হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের বক্তব্য হচ্ছে, এ কথা ছাড়া ‘রোগীর অবস্থা শোচনীয় বা মুমূর্ষু’ এ শব্দমালা আমরা ব্যবহার করতে পারি। ‘মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা’ লড়ার কথা মূলত শয়তান আমাদের মুখ দিয়ে নিঃসৃত করে। সে আমাদের প্ররোচিত করে এমন কুফরী বক্তব্যের দিকে। এ ব্যাপারে সবার সজাগ হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
মুসলিম সংস্কৃতিবাদী লেখক, কবি, সাহিত্যিক ও সাংবাদিকদের কাছে কয়েকটি শব্দের ছায়াপাত করলাম মাত্র। এছাড়া ঈমানবিধ্বংসী ও মুসলিম সংস্কৃতিবিরোধী এমন অনেক শব্দ রয়েছে যা থেকে প্রত্যেককেই সতর্ক হওয়া উচিত। যেমন: ‘অপ্সরা’, ‘আলিঙ্গন’, ‘উপাস্য’, ‘ঐশীবাণী/ ঐশীশক্তি’, ‘জীবন রক্ষাকারী ওষুধ’, ‘তীর্থযাত্রা’, ‘ধোয়া তুলসী পাতা’, ‘দৈববাণী’, ‘প্রয়াত’, ‘বিশ্বব্রহ্মাÐ’, ‘ভাবমূর্তি’, ‘মধ্যযুগীয় বর্বরতা’, ‘মহাভারত কি অশুদ্ধ?’, ‘ল²ী’, ‘লীলা’, ‘সতী সাধ্বী’, ‘সতীর্থ’, ইত্যাদি।
পূর্বেই উল্লেখ করেছি, সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মাধ্যমে মুসলমানদের স্বাধীনতার স্পৃহা দমিয়ে দেয়া যায়, জিহাদী প্রাণশক্তি নিস্তেজ করে দেয়া যায়। আর ‘এর বাহন বা মূল অস্ত্র হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছে প্রচার মিডিয়া ও সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তিগুলোকে; যেমন- সঙ্গীত, নাটক, সিনেমা, থিয়েটার, সাহিত্য, কবিতা প্রভৃতিকে। এগুলোকে এমনভাবে ব্যবহার করার কৌশল উদ্ভাবন করা হয়েছে, যাতে করে এগুলোর মাধ্যমে শত্রæদেশের মানুষকে এমনভাবে গড়ে তোলা যায় যেন তাদের মধ্যে সংস্কারবদ্ধতা, ধর্মের প্রতি অনাস্থা, স্বদেশের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা প্রভৃতি হীনমন্য বৃত্তিগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠে’(সাহিত্য সংস্কৃতি: উলামায়ে কেরামের ভূমিকা, রকীবুল ইসলাম- প্রবন্ধ)। আর এর মাধ্যমেই সাংস্কৃতিক জাতিসত্তার মূলোৎপাটন করা সম্ভব হয়। সাংস্কৃতিক জাতিসত্তা বিধ্বস্ত হলে রাজননৈতিক স্বাধীনতা থাকে না। এজন্য বলা হয়, সাংস্কৃতিক পরাজয় ঘটলে দেশের স্বাধীনতা উদ্ধার করা সম্ভব হয় না।
দেশের এই সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ের দিকে আলোকপাত করেই বিশিষ্ট নাট্যকার ও অভিনেতা আরিফুল হক তার ‘সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও প্রতিরোধ’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধে বলেছেন, ‘সাংস্কৃতিক যুদ্ধের শত শত মিসাইল এসে আমাদের বর্তমান বংশধরদের ইসলামী চেতনা-বিশ্বাসকে চুরমার করে দিচ্ছে। প্রচার মিডিয়ার সবকটি সেক্টর আজ অরক্ষিত। অথচ স্যাটেলাইট মিডিয়ার প্রযুক্তিকে আলেমসমাজ শয়তানের আস্তানা বলে দূরে ঠেলে রেখেছেন। ঘর পুড়েছে বলে দিয়াশলাই উৎপাদন নিষিদ্ধ করা কোনো সুচিন্তার ল²ণ নয়। আজকের অনৈসলামিক দুনিয়া মুসলমানদের আবেগকে বশীভূত করার জন্য সংস্কৃতির যে দিকগুলো বেছে নিয়েছে সেগুলোকে উপেক্ষা করে নয়; বরং সেগুলোকে পুরোপুরি আয়ত্ত করে সেখান থেকে ইসলামবিরোধীদের হটিয়ে দিয়ে ইসলামের এবং মানবকল্যাণের কাজে লাগানোই হবে মুসলমানদের জন্য বুদ্ধিমানের কাজ। ইসলামের সৌন্দর্যকে বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে বাস্তবে প্রতিষ্ঠা করে দেখাতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন একটা সর্বাত্মক যুদ্ধ। যুদ্ধকে যুদ্ধ দিয়েই জয় করতে হয়।’
২৪ মার্চ ২০১১ বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামে বইমেলায় কবি ও সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘২৭ কোটি মানুষের দুই বাংলা যদি এক হতো তবে বাংলা সাহিত্য অনেক শক্তিশালী হতো’ (দৈনিক যুগান্তর, ২৫ মার্চ, ২০১১ শুক্রবার)। কথা সত্য, তবে মতলব খারাপ। যদি এমনটি হতো, বাংলা সাহিত্য শক্তিশালী হতো কিনা জানি না, তবে বোদ্ধামহলের বিশ্বাস; পশ্চিম বাংলার সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে চরমভাবে পর্যুদস্ত হতো পূর্ব বাংলার মুসলিম সাংস্কৃতিক ব্যক্তিবর্গ। (শেষ)
লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন