ড.ইশা মোহাম্মদ : ভারতের রাজনীতি নিয়ে এখন আর মশকারা করার সুযোগ নেই। অতীতে এক সময় বলা হতো ভারতীয়রা রাজনীতি করছে শিখতে শিখতে। কারণটা সবাই জানে। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ বৃটিশদের হাতে গড়া। কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে সাধারণ মানুষ সচেতন হয় এবং বৃটিশ এজেন্টরা সরে পড়তে শুরু করে। হিন্দু মুসলমান শিখ খ্রিস্টান বৌদ্ধরা মিলে কংগ্রেস করলেও এক পর্যায়ে শ্রেণী দ্ব›দ্ব এতই প্রবল হয় যে, যার যার স্বার্থে ভিন্নমত ও দল-উপদল তৈরি হতে থাকে।
সে সময়েই হিন্দু কট্টরবাদীরা স্বতন্ত্র রাজনীতির পতাকা তুলেছিলেন এবং কট্টর পন্থার অনুশীলনও করেছিলেন। সে সময়কার হিন্দু মৌলবাদীরা হিন্দুস্থান বানানোর প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। কংগ্রেস বহুদিন সেক্যুলারিজম করেও ভারত থেকে ধর্মপন্থীদের দূরীভূত করতে পারেনি। ক্ষমতায় থাকার জন্য নেহেরুও এক সময় ধর্মপন্থীদের পিঠ চাপড়েছিলেন। পিঠ চাপড়ানোর ফল কখনই ভালো হয় না। এখন হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকরাই ক্ষমতায় এসেছেন। এমন কি হঠাৎ করেই মমতা আদভানির প্রতি প্রীতিবাক্য উচ্চারণ করেছেন।
হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকরা ক্ষমতায় আসা স্বাভাবিক ব্যাপার, কেননা, কংগ্রেস ‘নেতৃত্ব’ হারিয়েছে। তাদের নেতা নেই। ফলে ‘বড়’ নেতা হিসেবে অনেক টাকা খরচ করে যিনি ক্ষমতায় আসতে পারেন, তিনিই এসেছেন। তবে মানের বিচারে আদভানি মোদির চেয়েও বড় নেতা। যারা আদভানি সম্পর্কে জানেন, তারা স্বীকার করবেন যে, তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা বর্তমান ভারতের যে কোনো রাজনীতিকের চেয়েও উচ্চমানের। সেই তিনিই একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, শেখ হাসিনা ভারত-পাকিস্তান দ্ব›েদ্বর মীমাংসা করতে দূতিয়ালি করতে পারেন। এটি নিঃসন্দেহে তার কথা নয়। এই উসকানিমূলক কথা বলার মতো ফালতু চরিত্র তার নয়। কিন্তু তিনি বলেছেন। কেন?
সম্ভবত এটি তাদেরই শিখিয়ে দেয়া কথা, যারা এক সময় ভারতীয়দেরকে রাজনীতি শেখাত। কোন কারণে পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের প্রয়োজন ভারতের। বরঞ্চ পাকিস্তানেরই প্রয়োজন বেশি। কিন্তু তারা দূতিয়ালি করার জন্য কাউকে ডাকে না। আদভানি কেন ডাকাডাকি করছেন? তার দেশের যেখানে কোনো লাভই নেই? মূলত বাংলাদেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তিনি আন্তর্জাতিক দেশ বৈরীদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের চেষ্টা করছেন। এই খেলায় তিনি ভাড়াটের ভূমিকা পালন করছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ই ভারতের হিন্দুত্ববাদীরা বাংলাদেশের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নিয়ে কংগ্রেসের অবস্থানের বিরুদ্ধে কথা বলেছিল। যুদ্ধের সময় এবং পরেও তারাই ইন্ধিরা গান্ধীকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চেয়েছিল। এমনকি ভারতীয় সংসদেও ইন্ধিরা গান্ধীকে প্রশ্ন করা হয়েছিল। যারা সে সময়েই বাংলাদেশের স্বাধীন অস্তিত্ব মানতে চায়নি, তারাই এখন আবার কথা বলছেন। তারা বৃটিশ আমলেও অখন্ড ভারতের জন্য আন্দোলন করেছিল। এখনও মনে করে অখন্ড ভারত তৈরি করা সম্ভব। এ মুহূর্তে পাকিস্তান দখল করা না গেলেও বাংলাদেশকে অধীনতামূলক মিত্রতার চুক্তিতে আবদ্ধ করা যায়। পরে সময়মতো একীভূত করা যাবে। মনে রাখতে হবে যে, এরাই মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করেছিল।
বাংলাদেশের স্বাধীন অস্তিত্বের বিরুদ্ধে যারা দাঁড়িয়েছে, তারা মূলত ইহুদি ষড়যন্ত্রীদের ক্রীড়নক। তারা নিজেদের বুদ্ধিতে ও প্রজ্ঞতায় চলে না। আদভানির মতো উচ্চমানের প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদ কি বোঝেন না যে, পাক-ভারত দ্ব›দ্ব কখনই শেষ হবে না? পাক-ভারত দ্ব›দ্ব ভারত ও পাকিস্তানের নেতারা তৈরি করেনি। এটি আন্তর্জাতিক রাজনীতির কুফলে সৃষ্ট। ইহুদিবাদ সরাসরি জড়িত। এই দ্ব›দ্ব বিলীন হলে কার লাভ হবে? পাকিস্তান এবং ভারত উভয়ই লাভবান হবে। তবে ক্ষতি হবে কার? যারা দ্ব›দ্বকে পুঁজি করে মুনাফা কামায় তাদের মারাত্মক ক্ষতি হবে।
যুদ্ধবাজরা হিসাব কষে, কবে কোথায় ও কি জাতীয় যুদ্ধ হবে। তাদের যুদ্ধাস্ত্র তৈরির হিসাবও ওইভাবে ঠিক করা হয়। যেসব অস্ত্রশস্ত্র অপাঙ্ক্তেয় হয়ে যায়, এমন কি প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রেও সেগুলোকে বাজারজাত করতে না পারলে ওই ক্ষেত্রে যে মূলধন বিনিয়োগ করা হয়েছে, তা ফিরিয়ে আনা যাবে না। এ কারণে বড় বড় কোম্পানি পরিকল্পিত যুদ্ধের আয়োজন করে এবং ওই কারণে তারা বিভিন্ন সময়ে উসকানিও দেয়। যেমন কিছু দিন আগে ভারতের এক বড় জেনারেল মন্তব্য করেছিলেন এই মর্মে যে, ভারতের অস্ত্রশস্ত্র অতি পুরাতন, সেকেলে এবং আধুনিক যুদ্ধের উপযোগী নয়। ভারতব্যাপী শোরগোল উঠেছিল। যে কারণে ভারত রাষ্ট্র নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হয়। তারা অনেক টাকা খরচ করে নতুন মডেলের অস্ত্রশস্ত্র কিনতে উদ্যোগী হয়। ইতোমধ্যেই অনেক টাকা খরচও করেছে। কদিন আগেই ফ্রান্স থেকে বিমান কিনেছে। ইসরাইল থেকেও আধুনিক যুদ্ধের সাজসরঞ্জাম ও পারমাণবিক অস্ত্র মোকাবেলা করার জন্য বিশেষ জাতীয় অস্ত্র কিনেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার কাছ থেকেও অস্ত্রপাতি কিনেছে। এর বিপরীতে পাকিস্তানও তাদের বন্ধু রাষ্ট্রের কাছ থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করেছে। ইসরাইল উভয় দেশকেই অস্ত্রপাতি দিয়েছে। এই যে অস্ত্রবাজার, তা বন্ধ করবে কে? কার ঘাড়ে কটা মাথা? আদভানি প্রবীণ ও প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদ। তিনি সবই জানেন ও বোঝেন। কিন্তু তারপরেও কেন শেখ হাসিনাকেই মধ্যস্থতা করতে বললেন?
সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ আছে যে, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকুক, তা বাংলাদেশের অনেকেই চায় না। যেমনÑ তেমনি বিদেশেরও অনেকেই চায় না। যেমন যুদ্ধকালীন কিংবা তারও আগে ভারতের অনেক নেতাই চায়নি যে, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হোক। শেখ হাসিনার ব্যাপারেও তেমন ধরনের ভিন্নমত বর্তমান। পাকিস্তান তো চায়ই না। ইহুদিরাও চায় না। যে কোনো জাতীয় নেতাই তাদের অপছন্দ। কেননা, তাদের হিসাব মতে, জাতীয় নেতা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রাখে এবং উন্নয়ন করে। জাতীয়তাবাদ ক্যারিশম্যাটিক নেতা ছাড়া সংহত হয় না। সংহতির যারা শত্রæ, তারা জাতীয় নেতাকে বাঁচিয়ে রাখে না। যেমনÑ আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে বঙ্গবন্ধুকে প্রাণ দিতে হয়েছে। যে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের বিষয়ে কিউবার ফিদেল ক্যাস্ট্রো তাকে সাবধান করেছিলেন। ইন্দিরা গান্ধীর সময়ে মার্কিন এবং ইহুদি প্রভাব ভারতীয় রাজনীতিতে প্রাধান্য পায়নি। ইন্দিরা গান্ধী নিহত হওয়ার পর ভারতে মার্কিনি এবং ইহুদিবাদের প্রভাব বেড়েছে।
বাংলাদেশ তাদের টার্গেট। প্রায়ই শোনা যায়, ভারতের বিশেষ করে পশ্চিমবাংলায় বুদ্ধিজীবীরা চায়ের কাপে ঝড় তুলে বাংলাদেশ স্বাধীন থাকবে কিনা? সে ব্যাপারে মূর্খ ছেলের মতো তর্কাতর্কি করে। অবশ্য যারা জ্ঞানী তারা এ রকম কদর্য তর্কে অংশ নেন না। বাংলাদেশেও বেশ কয়েকজন যথাযথ পন্ডিত বাক্যালাপে বলেছেন, ‘অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব থাকবে না। কিন্তু যারা টকশোতে বাজে কথা বলে তাদের জন্য সাবধানতার প্রয়োজন আছে। কেননা, সারা দেশ একই সময়ে জেনে যায়। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানতে না পারলে সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে থাকে। এর ফল হয় খারাপ। টকশো বন্ধ করা সমাধান নয়। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানাতে হবে। যেমন আদভানির কথারও প্রতিক্রিয়া জানানো প্রয়োজন।
অসংখ্য অপমৃত্যুর ঘটনা আছে বিশ্বময়। স্টালিনের সময়ে ‘ওদেসা সিঁড়ি’ খ্যাত বিশ্ব নন্দিত চলচ্চিত্রকার আইজেনস্টাইন একবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন অনেকগুলো কাজ নিয়ে। প্রকাশ্য কাজ ছিল ক্যাপিটালিজমের ওপর ডকুমেন্টারি বানানো। গোপন মিশন ছিল সোভিয়েতের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক উন্নয়ন এবং দ্ব›দ্ব নিরসন। সে সময়ে স্টালিন উপলব্ধি করেছিলেন অস্ত্র প্রতিযোগিতায় যদি দেশের সব সম্পদ ব্যয় হয়ে যায় তবে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের বাজেট থাকবে না। কিন্তু মার্কিনিদের সাথে দূতিয়ালির গুরুদায়িত্ব কাকে দেয়া যায়? কেউই তো গ্রহণযোগ্য নয়। স্টালিন নিজেই এই দায়িত্ব নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জীবন হারানোর ভয়ে ওই কাজে ব্রতী হননি। ব্যাটেলশিপ পটেমকিমের কারুকার হিসেবে সাংস্কৃতিক মহলে আইজেনস্টাইনের গ্রহণযোগ্যতা ছিল। স্টালিন তাকেই পাঠিয়েছিলেন। পরিণতি কী হয়েছিল আপনারা তা মনে হয় জানেন। স্টালিন তার ডকুমেন্টারি গায়েব করে দিয়েছিলেন এবং তার অপমৃত্যু হয়েছিল, সাথে অন্য আর একটি তথ্য জুড়ে দেয়া যায়। ট্রটস্কি ছিলেন বড় কমিউনিস্ট। তিনি লালবাহিনীর নেতা ছিলেন। মরার আগে তিনি স্টালিনের ভয়ে আমেরিকায় পালিয়ে গিয়েছিলেন এবং সেখানেই খুন হয়েছিলেন। উল্লেখ করার মতো নয়, তবুও বলি ট্রটস্কি ইহুদি ছিলেন। ট্রটস্কির খুনের জন্য মার্কিনিরা স্টালিনকে দায়ী করে এবং সোভিয়েতের সাথে সুসম্পর্ক তৈরির সুযোগে ‘কালো হাত’ পড়ে। ওই সময়ে আন্তর্জাতিক মহলে অনেক ঘটনা ঘটে। ফলে সোভিয়েতকে নীতিবিরুদ্ধ অস্ত্র প্রতিযোগিতায় নামতে হয়। দেশের মানুষের কষ্ট বাড়তে থাকে। রুটির জন্য লাইন লম্বা হতে থাকে। তারা বাঁচার উপায় হিসেবে বিষে বিষক্ষয় নীতি গ্রহণ করে। মার্কসবাদের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে অস্ত্র বাণিজ্য করে দেশ বাঁচাতে চেষ্টা করে। তাদের অস্ত্র বাণিজ্যের মাধ্যম হয় ইহুদি-ঘনিষ্ঠ কোম্পানিগুলো। তারা সরাসরি যে অস্ত্র বিক্রি করেছে, সেখান থেকেও ইহুদিরা মুনাফা তুলে নিয়েছে। ইউরোপের বড় বড় কোম্পানি ইহুদি পুঁজি দ্বারা প্রভাবিত। যে কারণে অস্ত্র বাণিজ্য বন্ধ করে ইউরোপ একদিনও চলতে পারে না।
বহুদিন যাবৎ ইসলামী বিশ্ব উন্নয়নের জন্য আহাজারি করছে। তাদের সম্পদ উন্নয়নে ব্যয় করার চেষ্টা করছে। কিন্তু যুদ্ধ উন্মাদনা তাদের উন্নয়নকে থামিয়ে দিয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী ৫০-৬০ বছরের মধ্যে তারা পুরোপুরি নিঃস্ব হয়ে যাবে। কিন্তু অব্যাহত অস্ত্র বাণিজ্যের কারণে দ্ব›দ্ব নিরসন করা সম্ভব হবে না। যেমন পাকিস্তান কখনই উন্নত দেশ হবে না। কারণ কী! কারণ হচ্ছে তারা ভারতের সাথে অসম অস্ত্র প্রতিযোগিতায় নেমেছে। পাকিস্তানের বর্তমান দৃষ্টিভঙ্গি যদি অক্ষুণœ থাকে তবে তারা বহু নিরীহ মানুষের কষ্টের কারণ হবে। বাংলাদেশকেও এখান থেকে শিক্ষা নিয়ে এগুতে হবে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন