শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আদিগন্ত

কথা রাখেনি সরকার

প্রকাশের সময় : ৪ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মীর আব্দুল আলীম
কথা রাখেনি সরকার। জ্বালানি তেলের দাম কমানোর ইঙ্গিত দিয়ে ছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। কিন্তু তেলের দাম কমেনি। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমতে কমতে তলানিতে নেমে এসেছে। অথচ, আমাদের কিনতে হচ্ছে আগের দামেই। অপরিশোধিত জ্বালানি তেল প্রতি ব্যারেলের দাম উঠেছিল ১২২ ডলার পর্যন্ত। তখন দেশে দফায় দফায় তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। এরপর বিশ^বাজারে তেলের দাম কমতে কমতে ৩০ ডলারে নেমে আসে। সরকারের পক্ষ থেকে জ্বালানি তেলের দাম আর সমন্বয় করা হয়নি। আপাতত হবেও না। সম্প্রতি জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রীর জন্য নির্ধারিত প্রশ্নোত্তর পর্বে জ্বালানি তেলের দাম না কমানোর সিদ্ধান্তে সরকারের অনড় অবস্থানের কথা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘যখন বিশ্ববাজারে ডিজেলের দাম অতিরিক্ত ছিল, তখন আমরা সাবসিডি (ভর্তুকি) দিয়ে ডিজেল বিক্রি করেছি। যার ফলে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) হাজার হাজার কোটি টাকা লোন হয়ে গেছে। ব্যাংক থেকে লোন নেয়া হয়েছে। এখন লোনের ১৫ থেকে ১৬ হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করতে হবে। ধার-দেনা পরিশোধ করার পর তখন হয়তো তেলের দাম কমানোর কথা বিবেচনা করা যাবে।’
২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসে আমাদের দেশে যখন তেলের দাম বাড়ানো হয়, তখন আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম ছিল প্রতি ব্যারেল ১২২ ডলার। ওই সময়ে সরকার তেলের মূল্য বৃদ্ধির ঘোষণা দেয়। পেট্রোল ও অকটেনের দাম বাড়ে প্রতি লিটারে পাঁচ টাকা এবং ডিজেল ও কেরোসিন প্রতি লিটারে সাত টাকা। আন্তর্জাতিক বাজারে এখন জ্বালানি তেলের দাম গত পাঁচ বছরের হিসাবে সর্বনিম্ন। কিন্তু আমাদের দেশে জ্বালানি তেলের মূল্যের হিসাব-নিকাশ করলে পরিস্থিতির ভিন্ন চিত্র ফুটে উঠে। বর্তমানে দেশে পেট্রোল, অকটেন, ডিজেল, কেরোসিনের দাম পূর্ববৎ রাখা হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে ধারাবাহিকভাবে দাম কমে যাওয়ায় তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো হিমশিম খেলেও বাংলাদেশ প্রতি লিটার ডিজেল ও কেরোসিন ২০ টাকা, পেট্রোল ৩৫ টাকা আর অকটেনে ৪০ টাকা মুনাফা করছে। বিপিসির তথ্য অনুযায়ী ২০১৪-১৫ অর্থ বছরে অভ্যন্তরীণ বাজারে তেল বিক্রি করে মুনাফা হয়েছে ৫ হাজার ২শ’ ৬৮ কোটি টাকা।
বিশ^বাজারে তেলের দাম কমায় প্রতিবেশী দেশ ভারত এ পর্যন্ত ৪ বার তাদের অভ্যন্তরীণ বাজারে তেলের দাম কমিয়েছে। সেই সাথে আরো অনেক দেশ তেলের দাম কমিয়েছে। বাংলাদেশে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা, সিপিডি দেশের অর্থনীতিবিদ, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ব্যবসায়ীরা জ্বালানি তেলের দাম কমানোর কথা বললে সরকার তা নাকচ করে দিলেও বর্তমানে কমানোর আশ্বাস দিচ্ছে। কিন্তু কবে নাগাদ তা বাস্তবায়ন হবে তা দেখার বিষয়। গ্লোবাল পেট্রোল প্রাইসেস এর হিসাব অনুযায়ী সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে তেলের সবচেয়ে বেশি দাম বাংলাদেশে এবং সবচেয়ে কম দাম মালদ্বীপে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলসহ নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য হ্রাস পেলেও সুফল পায়নি এদেশের মানুষ। এর সাথে গ্যাস, বিদ্যুতের দাম অযৌক্তিকভাবে মূল্যবৃদ্ধিতো রয়েছেই। ফলে বেড়েই চলছে জীবনযাত্রার ব্যয়। আর এতে হিমশিম খাচ্ছেন নিম্নমধ্যবিত্তরা।
সম্প্রতি সিপিডি এক তথ্য দেয় যে, জ্বালানি তেলের দাম যদি ১০ শতাংশ কমানো হয় তাহলে জাতীয় প্রবৃদ্ধি বাড়বে দশমিক ৩ শতাংশ। তৈরি পোশাক খাতে রফতানি বাড়বে দশমিক ৪ শতাংশ। ভোক্তার চাহিদা বাড়বে দশমিক ৬ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি কমবে দশমিক ২ শতাংশ, সরকারের সঞ্চয় কমবে দশমিক ৪ শতাংশ। সরকার যদি তেলের দাম কমায় তবে ভোক্তার চাহিদা বাড়বে। ফলে উৎপাদন বাড়বে, উৎপাদন বাড়ায় জাতীয় প্রবৃদ্ধি বাড়বে, আবার মুদ্রাস্ফীতির হার কমবে, আর মুদ্রাস্ফীতি কমায় বিনিয়োগ বাড়বে। ফার্নেশ অয়েলের দাম কমানো হলে বিদ্যুতের দাম কমবে। অকটেন ও পেট্রোলের দাম কমানো হলে সিএনজির ওপর চাপ কমবে। ডিজেলের দাম কমানো হলে বাস ভাড়া কমবে। কৃষকের সেচ খরচ কমবে ফলে কৃষিজ পণ্যের দাম কমবে। তবে এসব ভোক্তা পর্যায়ে কার্যকর হচ্ছে কিনা তা সরকারকেও মনিটরিং করতে হবে। তাই বলা যায়, সরকারের কিছু রাজস্ব কমলেও সার্বিক দিক বিবেচনা করে দাম কমানোর পদক্ষেপ নেয়া এখন সময়ের দাবি।
আমার জানা মতে, বাংলাদেশ ছাড়া পৃথিবীর সব দেশের মানুষ কম মূল্যের জ্বালানির সুবিধা পাচ্ছে। আমরা আছি বড় বেকায়দায়। তেলের দামতো কমছেই না বরং গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ায় আমাদের নাভিশ্বাস উঠেছে। গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানোয় পণ্য উৎপাদনে খরচ বেড়েছে। ফলে সর্বত্র বিরাজ করছে ক্ষোভ-অসন্তোষ। এ কথা স্পস্ট যে, জ্বালানি তেলের সাথে মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা বিশেষ সম্পর্কযুক্ত। উৎপাদন, উন্নয়ন, বাজার ব্যবস্থা সবই জ্বালানি তেলের সাথে সম্পর্কিত। বিশ্ব বাজারের সাথে সমন্বয় রেখে দেশীয় বাজারে তেলের মূল্য নির্ধারণে সাধারণ মানুষ সুফল ভোগী হবেÑএমনটিই স্বাভাবিক। তাই ভুক্তভোগীরা দেশে অবিলম্বে জ্বালানি তেলের দাম কমানোর জোর দাবি তুলেছেন।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমলেও মূলত লোকসানের কারণে স্থানীয় বাজারে দাম সমন্বয় করা হচ্ছে না। যদিও সরকারকে ট্যারিফ দিতে গিয়েই এ লোকসানের শিকার হচ্ছে বিপিসি। গত অর্থবছর বিপিসির ঘাটতি ছিল ২ হাজার ৪৭৮ কোটি টাকা। একই সময়ে সরকারকে ৪ হাজার ৫২৫ কোটি টাকা রাজস্ব প্রদান করেছে বিপিসি। এ হিসাবে জ্বালানি তেল কেনা-বেচায় প্রকৃতপক্ষে ২ হাজার ৪৭ কোটি টাকা মুনাফা করেছে প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু রাজস্ব পরিশোধের চাপ থাকায় তেলের দাম কমাতে পারছে না তারা। ২০০৯ সাল থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে আমাদের দেশে জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে চারবার। তেলের এই মূল্য বৃদ্ধি নিয়ে দেশে তীব্র বিরূপ সমালোচনা ছিল। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে যুক্তি দেখানো হয়েছে যে, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় রাষ্ট্রীয় সংস্থা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) লোকসান বেড়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে প্রত্যেক পেট্রোল পাম্পে একটি করে তালিকা ঝুলিয়ে রাখা হতো। এতে কোন কোন খাতে কত টাকা ভর্তুকি দেয়া হতো, তার বিবরণ লিপিবদ্ধ থাকতো। কিন্তু বিশ্ববাজারে তেলের দাম বৃদ্ধি বন্ধ হয়েছে বেশ আগে থেকেই। কিন্তু দেশে তেলের মূল্য হ্রাসের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এ নিয়ে ভোক্তা মহলে অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ ঘটতে দেখা যাচ্ছে।
গত ২৯ বছরে সরকার জ্বালানি তেলে ভর্তুকি দিয়েছে মাত্র ১১ শত কোটি টাকা আর ভ্যাট-ট্যাক্স বাবদ পেয়েছে ৬৯,৬০২ কোটি ২৪ লাখ টাকা। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমে যাওয়ায় সরকার এখাতে অস্বাভাবিক মুনাফা করছে। গত অর্থবছরে জ্বালানি তেলে ব্যবসা থেকে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) নিট মুনাফা করেছে ৫,২৬৮ কোটি ৮ লাখ টাকা। তার আগের অর্থবছরে নিট লোকসান ছিল ২,৪৭৭ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। আন্তর্জাতিক বাজারে দফায় দফায় জ্বালানি তেলের দাম কমায় এখাত থেকে সরকারের মুনাফা বেড়েই চলছে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম এক বছরে অর্ধেকেরও বেশি কমে গেছে। কিন্তু সরকার দেশে তেল বিক্রি করছে আগের দরেই।
এদেশে সব কিছুরই যেন দাম বাড়ে; কমে না। রীতিমতো মূল্য বৃদ্ধির এক গোলকধাঁধাঁয় পড়েছে দেশের আমজনতা। একবার কোনো কিছুর দাম বেড়েছে তো, তা কমেনি কখনো। ব্যবসায়ীরা কথায়-কথায়, দফায়-দফায় জিনিসপত্রের দাম বাড়ান; এ প্রতিযোগিতায় এখন পিছিয়ে নেই খোদ সরকারও। সমস্যা হলো কোনো ছুঁতোয় দাম বাড়লে আর কমার নাম থাকে না। যখন কমানো উচিৎ ছিলো তখন জ্বালানি তেলের দাম না কমিয়ে বরং গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কোনো যৌক্তিকতা নেই। দেশের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান বাড়াতে সরকারের কাজ করার কথা থাকলেও সরকার হাঁটছে উল্টোপথে। দেশের জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কোনো যুক্তিই নেই। তাছাড়া, জ্বালানি তেলের দাম না কমানো এবং উল্টো গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি এটা ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’-এর মতো নিষ্ঠুর ও অমানবিক। আমরা বিষয়টি নিয়ে ভাববার জন্য সরকারে কাছে বিনীত প্রত্যাশা করছি।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
newsstore13@gmail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন