অবশেষে সিরিয়ায় দীর্ঘ প্রতীক্ষিত যুদ্ধ বিরতি শুরু হয়েছে। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যকর হওয়া এই য্দ্ধু বিরতির মাধ্যমে সাময়িক সময়ের জন্য হলেও সিরিয়ায় বিদ্যমান গৃহযুদ্ধের অবসান এবং সিরিয়া সঙ্কটের একটি শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া যাবে বলেই বিশ^াস করি। তাই সিরিয়ায় কার্যকর হওয়া এই সাময়িক যুদ্ধ বিরতিকে আমরা স্বাগত জানাই। দীর্ঘ গৃহযুদ্ধে ক্লান্ত এবং বিপর্যস্ত সিরিয়ার জনগণ এই যুদ্ধ বিরতিতে আশার আলো দেখছে। যুদ্ধ বিরতির সুবাধে দীর্ঘ পাঁচ বছরের মধ্যে এই প্রথম সিরিয়ার জনগণ বোমার আওয়াজ, বিমানের গর্জন আর গোলাগুলির শব্দ ছাড়া দিন অতিবাহিত করল। একইভাবে তারা মৃত্যু আতঙ্ক ছাড়া শান্তিতে রাত কাটালো। আমরা আশা করব, সিরিয়ায় যুদ্ধরত শক্তিসমূহের মাঝে শুভ বুদ্ধির উদয় হবে। বিলম্বে হলেও তারা যে শান্তির পথে এগিয়ে এসেছে সে জন্য ধন্যবাদ। সাময়িক যুদ্ধ বিরতিকে স্থায়ী যুদ্ধ বিরতিতে রূপ দিতে হবে। আত্মঘাতী এবং সর্বনাশা এই যুদ্ধ চিরতরে বন্ধ করতে হবে। তার জন্য যুদ্ধরত সকল পক্ষকে ছাড় দিতে হবে। অস্ত্র পরিত্যাগ করে আলোচনার টেবিলে বসে সমঝোতায় আসতে হবে। তা হলেই সিরিয়া বাঁচবে, সিরিয়ার জনগণ বাঁচবে। তা না হলে সিরিয়া কেবল ধ্বংস হবে, সিরিয়ার জনগণ কেবল নিঃস্ব হবে।
সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাসার আল আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করতে দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে বিদ্রোহীরা যুদ্ধ করছে। বিদ্রোহীদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিকভাবে সাহায্য করছে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্ব, সাথে রয়েছে তুরস্ক, সৌদি আরব এবং কাতারসহ বেশ কয়েকটি মুসলিম দেশ। পেছন থেকে ইসরাইল কলকাঠি নাড়ছে। অপরদিকে আসাদের পক্ষে আছে ইরান, রাশিয়া, চীন ও লেবাননের হিজবুল্লাহ। আসাদের পক্ষে রাশিয়া বিমান হামলা চালাচ্ছে। এ যুদ্ধে ইতোমধ্যেই পঁাঁচ লক্ষ মানুষ নিহত হয়েছে এবং চল্লিশ লক্ষ মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছে। এরা এখন মানবেতর জীবনযাপন করছে। ধ্বংস হয়েছে হাজার হাজার ঘর-বাড়ি, মসজিদ-মাদরাসা, স্কুল-কলেজসহ অসংখ্য স্থাপনা। প্রতিদিনই প্রাণ হারাচ্ছে অসংখ্য নিরাপরাধ আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা। নিজ ঘর-বাড়ি ছেড়ে প্রতিদিনই অসহায় মানুষেরা বাঁচার তাগিদে বিদেশের উদ্বাস্তু শিবিরে আশ্রয় নিচ্ছে। ইরাক এবং লিবিয়ার মতো সিরিয়ায় সামরিক আগ্রাসন চালানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্ব জাতিসংঘে একাধিকবার প্রস্তাব তুলেছে। কিন্তু রাশিয়া এবং চীন প্রতিবারই তাতে ভেটো দিয়েছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন জোট আসাদকে উৎখাতে সরাসরি সামরিক অভিযান চালাতে পারছে না। আসাদবিরোধী বিদ্রোহীদের সকল তৎপরতার হেড কোয়ার্টার তুরস্কে অবস্থিত। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগানের প্রত্যক্ষ তত্বাবধানে তুরস্কের মাটি থেকে আসাদবিরোধী কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। বিদ্রোহীদের অফিস, সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং রাজনৈতিক তৎপরতা সবই তুরস্কের মাটিতে। তুরস্কের সাথে সিরিয়ার দীর্ঘ সীমান্তের সুযোগে বিরোধীরা অবাধেই তুরস্ক হয়ে অস্ত্র পাচ্ছে। আসাদ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে সৌদি আরব এবং কাতার অকাতরে অর্থব্যয় করছে। নিজ দেশে গণতন্ত্র না থাকলেও সৌদি আরব এবং কাতার সিরিয়ার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করতে মরিয়া। কিন্তু পাঁচ বছর ধরে পশ্চিমাদের সকল তৎপরতা এবং বিদ্রোহীদের যুদ্ধকে মোকাবেলা করে আসাদ এখনো শক্ত হাতে ক্ষমতাকে ধরে রেখেছে। প্রাথমিকভাবে বিদ্রোহীরা যুদ্ধে সফলতা দেখালেও এখন আস্তে আস্তে পিছু হটছে। দখলকৃত এলাকাগুলো সরকারি বাহিনী পুনরুদ্ধার করছে।
পশ্চিমাদের প্রত্যক্ষ উদ্যোগে এবং জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে মুসলিম ভূখ-ে ১৯৪৭ সালে ইসরাইলের প্রতিষ্ঠা। এ ইস্যুতে ইসরাইলের সাথে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর এশাধিকবার যুদ্ধ হয়েছে, যাতে ইসরাইল বিজয়ী হয়েছে। যুদ্ধে সিরিয়ার গোলান মালভূমি, মিসরের সিনাই উপত্যকা, ফিলিস্তিনের অধিকাংশ ভূখ- ইসরাইল দখল করে। সিরিয়া হচ্ছে একমাত্র মুসলিম দেশ যে কখনো ইসরাইলের সঙ্গে আপস করেনি। শুরু থেকেই ছিল ইসরাইল-সিরিয়ার বৈরিতা, যা এখনো বিদ্যমান। সিরিয়া ছিল বরাবরই সাবেক সোভিয়েত ব্লকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এশারণেই সিরিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্সসহ পশ্চিমাদের দীর্ঘকালের শত্রুতা। সিরিয়ার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অবরোধ এবং নিষেধাজ্ঞা দীর্ঘদিন ধরেই বিদ্যমান। ইসরাইলের শত্রু হামাস এবং হিজবুল্লাহকে সাহায্য সহযোগিতা করার কারণে সিরিয়া হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলের শত্রু। ১৯৭৯ সালে মিশরের সাথে ইসরাইলের শান্তি চুক্তির পর থেকে মিশর হয়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু এবং ইসরাইলের স্বার্থরক্ষাকারী। অপরদিকে ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামী বিপ্লবের পর থেকে ইরানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুত্ব ছিন্ন হয়ে যায় এবং ইরান যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান শত্রুতে পরিণত হয়। এ অবস্থায় ইরানের সাথে সিরিয়ার গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে, যা এখনো অটুট আছে। ইরান এবং সিরিয়া ফিলিস্তিনের হামাস এবং লেবাননের হিজবুল্লাহকে সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা করে। ইরান, সিরিয়া, হামাস এবং হিজবুল্লার সমন্বয়ে একটি জোট গড়ে ওঠেছে, যারা সরাসরি যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলের স্বার্থের বিরোধিতা করে। ২০১১ সালে জনতার আন্দোলন তিউনিসিয়া এবং মিশরে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলের বন্ধু সরকারের পতন এবং নির্বাচনের মাধ্যমে দেশ দু’টিতে ইসলামপন্থীদের ক্ষমতায় আরোহণ ছিল যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলের জন্য বিরাট বিপর্যয়। মিশর এবং তিউনিসিয়ায় ইসলামপন্থীদের ক্ষমতায় আরোহণে সারা বিশ্বজুড়ে ইসলামপন্থীরা অনুপ্রাণিত এবং চাঙ্গা হয়ে ওঠে। ইরানের সাথে মিশরের ৩০ বছর কূটনৈতিক সম্পর্ক না থাকলেও মোবারক পরবর্তী ব্রাদারহুডের সময়ে ইরানের সাথে সম্পর্ক পুনপ্রতিষ্ঠিত হয়। এ অবস্থায় ইরানের নেতৃত্বাধীন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলবিরোধী জোট শক্তিশালী হতে শুরু করে। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রকে পেয়ে বসে সাম্রাজ্য হারানোর ভয় আর ইসরাইলকে পেয়ে বসে অস্তিত্ব হারানোর ভয়। এ সঙ্কট উত্তরণে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্ব এবং ইসরাইল দুটি পরিকল্পনা গ্রহণ করে। তাদের পরিকল্পনার একটি অংশ হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোতে ক্ষমতাসীন তাদের অনুগত শাসকদেরকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখা। এ জন্য তারা সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, আরব আমিরাত, জর্ডান, মরক্কো, ফিলিস্তিন এবং বাহরাইনসহ আরো অনেক দেশের ক্ষমতাসীন সরকারদের নিঃশর্ত সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। এসব দেশে সরকারবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে কঠোরভাবে দমন করা হচ্ছে। পশ্চিমারা এসবের নীরব সমর্থক। তাদের দ্বিতীয় পরিকল্পনা, মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশে ক্ষমতাসীন তাদের বিরোধী সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা। এ জন্য পশ্চিমারা এসব দেশে গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে সমর্থন এবং সহযোগিতা করছে। প্রয়োজনে গণতন্ত্র এবং জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার শ্লোগান দিয়ে সেখানে সামরিক আগ্রাসন চালাবে এবং তাদের বিরোধীদের ক্ষমতাচ্যুত করবে। এরই অংশ হিসেবে প্রথমেই তারা দীর্ঘ দিনের শত্রু লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট মোয়াম্মার গাদ্দাফিকে ক্ষমতাচ্যুত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। গণতন্ত্র এবং জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার শ্লোগান দিয়ে তারা লিবিয়ায় হামলার জন্য জাতিসংঘে প্রস্তাব পাস করে। এরপর পশ্চিমা বিশ্ব লিবিয়ায় সামরিক হামলা শুরু করে। লিবিয়ার অবিসংবাদিত নেতা গাদ্দাফি তার বাহিনী নিয়ে পশ্চিমাদের সামরিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে যুদ্ধ করেন। তিনি তার তিন সন্তানসহ জীবন দেন। এভাবে পশ্চিমারা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে লিবিয়ার শাসক গাদ্দাফিকে ক্ষমতাচ্যুত করে এবং নির্মমভাবে হত্যা করে। আর দেশটিকে ধ্বংস করে। গাদ্দাফি পরবর্তী লিবিয়া আজ এক ধ্বংসের জনপদ। লিবিয়ার জনগণ আজ গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার কিছুই পায়নি। লিবিয়াকে ধ্বংস করার পর যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইল মিশরের ইসলামপন্থী প্রেসিডেন্ট ড. মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। পশ্চিমারা পাশ্চাত্যবিরোধী ড. মুরসিকে কৌশলে আরেক পাশ্চাত্যবিরোধী আসাদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়। এক্ষেত্রেও পশ্চিমাদের পক্ষে প্রধান ত্রাণকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন এরদোগান। তিনি আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করতে আসাদবিরোধী পদক্ষেপ নিতে মুরসিকে উদ্ধুদ্ধ করেন যা ছিল মূলত পশ্চিমাদেরই পরিকল্পনা। একপর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলবিরোধী মিশরের প্রেসিডেন্ট ড. মুরসি, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলের আরেক শত্রু আসাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্নের ঘোষণা দেন। এটা ছিল মুরসির ঐতিহাসিক ভুল। পশ্চিমা বিশ্ব এটাই চেয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলের দুই শত্রু ড. মুরসি এবং আসাদ যখন নিজেরাই নিজেদের শত্রু হয়ে যায় তখনই পশ্চিমারা ড. মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করার কাজটি সম্পন্ন করে। পশ্চিমারা মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করার কাজ তাড়াতাড়িই শুরু করে এবং আসাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্নের দুই মাসের মধ্যেই ড. মুরসি ক্ষমতাচ্যুত হন। গণতন্ত্র হত্যাকারী মিশরের সেনাবাহিনীকে নীরবে সমর্থন করে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্ব। মিশরের সেনাবাহিনী গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামরত কয়েক হাজার মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করলেও গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের সোল এজেন্ট যুক্তরাষ্ট্র সেনাবাহিনীর পক্ষেই অবস্থান নিয়েছে। লিবিয়ার গাদ্দাফি এবং মিশরের ড. মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইল তাদের আরেক শত্রু সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য কাজ করছে। কিন্তু তুরস্কের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা না পেলে লিবিয়ার ক্ষমতা থেকে গাদ্দাফিকে উৎখাত করতে পশ্চিমা বিশ্ব কখনোই সফল হতো না। একইভাবে তুরস্কের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা না পেলে সিরিয়ার আসাদবিরোধী যুদ্ধও এতটা অগ্রসর হতো না।
মুসলিম বিশ^কে ধ্বংস করার জন্য পশ্চিমাদের এই যে মহাপরিকল্পনা, তার অংশ হিসেবে পশ্চিমারা ইরাকে আগ্রাসন চালিয়ে সাদ্দাম হোসেনকে ক্ষমতাচ্যুত এবং হত্যা করেছে। তারা ইরাককে ধ্বংস করেছে। একইভাবে আফগানিস্তানে সামরিক আগ্রাসন চালিয়ে তালেবানদের ক্ষমতাচ্যুত করেছে এবং কয়েক লক্ষ আফগান মুসলমানকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। ইরাক, আফগানিস্তান এবং লিবিয়াকে ধ্বংস করার পর এখন তারা সিরিয়াকে ধ্বংস করার মহোৎসবে মেতে উঠেছে। এক্ষেত্রে গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা মোটেই তাদের আসল উদ্দেশ্য নয়। গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার রক্ষার শ্লোগান হচ্ছে পাশ্চাত্যের আগ্রাসনের হাতিয়ার মাত্র। এজন্যই ১৯৯১ সালে আলজেরিয়ার নির্বাচনে ইসলামপন্থীরা বিজয়ী হলেও পশ্চিমারা তাদের ক্ষমতায় আসতে দেয়নি। ২০০৬ সালে ফিলিস্তিনের নির্বাচনে ইসলামপন্থী হামাস বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় এলেও তাদের ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে। আর মিশরের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ড. মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করা তারই ধারাবাহিকতা।
শত্রুর শত্রু বন্ধু ,শত্রুর বন্ধু শত্রু। বন্ধুর বন্ধু বন্ধু আর বন্ধুর শত্রু শত্রু। এটাই আর্ন্তজাতিক সম্পর্কের ভিত্তি। যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু বলেই চীন, রাশিয়া, উত্তর কোরিয়ার সাথে ইরানের ভালো সম্পর্ক। যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু বলেই সিরিয়ার সাথে চীন, রাশিয়া এবং ইরানের ভালো সম্পর্ক। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলে শত্রু বলেই হামাস এবং হিজবুল্লাহর সাথে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদের ভালো সম্পর্ক। এই সমীকরণ রাজনীতিবিদদের বুঝতে হবে এবং এ সমীকরণে ভুল করলে বিপর্যয় অনিবার্য। তাই যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্ব চাচ্ছে তাদের শত্রু আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করতে অপরদিকে চীন, রাশিয়া, ইরান চাচ্ছে তাদের মিত্র আসাদকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে। আর আসাদের পতন হলে হামাস, হিজবুল্লাহ, ইরান সবাই দুর্বল হবে। দুর্বল হবে মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়া এবং চীনের শক্তি। বাড়বে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলের শক্তি। তবে আসাদ যেহেতু বরাবরই যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলের কট্টরবিরোধী একজন মানুষ সে ক্ষেত্রে আন্দোলনের মাধ্যমে এবং বিদ্রোহীদের লড়াইয়ে আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করা যাবে না। কারণ মুসলিম দেশগুলোর শাসকদের মধ্যে যারা পশ্চিমাবিরোধী তারা স্বৈরশাসক হলেও তাদের ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে। এই কারণে লিবিয়ার গাদ্দাফিকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পশ্চিমা বিশ্বকে ছয় মাস ধরে সামরিক আগ্রাসন চালাতে হয়েছে। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদের বেলায়ও ব্যাপারটা শত ভাগ সত্য। এ জন্যই আসাদ এখনো ক্ষমতায় টিকে আছে। আর সিরিয়ায় সরাসরি আগ্রাসন চালাতে গেলে জাতিসংঘের অনুমোদন লাঘবে যেটা রাশিয়া এবং চীনের ভেটো প্রদানের ফলে সম্ভব হবে না। তাছাড়া পশ্চিমাদের গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের শ্লোগানের প্রতি মানুষের এখন তেমন আস্থা নেই। তাদের প্রতি মানুষের মোহ কেটে গেছে। ইরাক, আফগানিস্তান এবং লিবিয়ার পরিণতি মানুষ তো দেখতে পাচ্ছে। বিদ্রোহীরা আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য লড়াই করলেও তাদের প্রতি জনগণের তেমন সমর্থন নেই। তারা নিজেরাও নানা মতে বিভক্ত এবং লক্ষ্যহীন। যুদ্ধের ময়দানে ইসলামপ্রিয় কিছু মানুষ যুদ্ধ করলেও তাদের নেতারা সেক্যুলার এবং পশ্চিমাপন্থী, যার নিয়ন্ত্রণ যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের হাতে। তারা যে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলের প্রতি অনুগত। এজন্য তাদের তেমন জনপ্রিয়তা নেই, মূলত পশ্চিমা বিশ্ব এবং তাদের আরব মিত্রদের সাহায্য সহযোগিতার কারণেই তারা টিকে আছে।
পাঁচ বছরের গৃহযুদ্ধে সিরিয়া কেবল ধ্বংস হয়েছে। সিরিয়া হয়ে ওঠেছে আজ সা¤্রাজ্যবাদী শক্তির দাবা খেলার স্থান। তাই আমাদের আকুল আবেদনÑ সিরিয়ায় যে আত্মঘাতী, ভাতৃঘাতী এবং অর্থহীন যুদ্ধ চলছে, তা বন্ধ হোক। ধ্বংসই এ যুদ্ধের একমাত্র অর্জন। সুতরাং যুদ্ধের দামামা বন্ধ করে রাজনৈতিক উপায়েই সিরিয়া সঙ্কটের সমাধান করতে হবে। তাই সিরিয়ার সকল পক্ষের প্রতি আবেদন, আপনারা আলোচনায় বসুন। সিরিয়ার ঐক্য, স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষা করুন। অনুগ্রহ করে সা¤্রাজ্যবাদীদের ক্রীনড়ক হিসেবে ব্যবহৃত হবেন না। যুদ্ধ বন্ধ করে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করুন এবং ধ্বংস হওয়া দেশটিকে পুনর্গঠন করুন। বিদেশে উদ্বাস্তু শিবিরে বসবাসরত সিরিয়ার সকল নাগরিককে দেশে ফিরিয়ে আনুন। এটাই সমাধান। তা না হলে লাখো মানুষের রক্তই ঝরবে, চারদিকে সব কিছু ধ্বংসই হবে। পরিশেষে আমার লেখা একটি গানের চারটি লাইনে সিরিয়ায় বিবদমান সকল পক্ষকে শান্তি স্থাপনে ভূমিকা রাখার আহ্বান জানাচ্ছি-
যুদ্ধ নয়, সংঘাত নয়, নয় তো মারামারি
হিংসা নয়, বিদ্বেষ নয়, নয় তো হানাহানি।
ভালোবাসার বন্ধনে এসো, নতুন জীবন গড়ি
স্নেহ, মায়া, মমতায় এসো নতুন পৃথিবী গড়ি।
লেখক : প্রকৌশলী ও কলামিস্ট
omar_ctg123@yahoo.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন