শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

কোনো নিবর্তনমূলক আইন নয়

| প্রকাশের সময় : ৫ মে, ২০১৭, ১২:০০ এএম

আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা থাকবেনা বলে আশ্বাস দেয়ার পর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গত বুধবার সচিবালয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাটের সঙ্গে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের বলেছেন, এই আইনের বিভ্রান্তি ও দুর্বলতা দূর করা হবে। তার এ বক্তব্যের প্রেক্ষিতে প্রশ্ন উঠতে পারে, আইসিটি আইন থেকে ৫৭ ধারা বাদ দেয়া হবে নাকি তার বিভ্রান্তি ও দুর্বলতা দূর করে রেখে দেয়া হবে? আইসিটি আইন প্রনয়ণ ও তার মধ্যে ৫৭ ধারার মতো মত প্রকাশের স্বাধীনতার প্রতি হুমকি স্বরূপ ধারা নিয়ে শুরু থেকেই প্রশ্ন রয়েছে বিভিন্ন মহলে। এই আইন এবং বিশেষভাবে এই ধারাটির ব্যাপারে সমালোচকদের অভিযোগ হলো, মত প্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত করার জন্য এই ধারাসম্বলিত আইনটি করা হয়েছে। বাস্তবেও দেখা গেছে, এই আইনের আওতায় সাংবাদিক এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীদের অনেকে হয়রানি, গ্রেফতার ও জেল-জুলুমের শিকার হয়েছেন। ৫৭ ধারা মতে, যদি কোনো ব্যক্তি উদ্দেশ্যমূলকভাবে ইলেকট্রনিক ফর্মে এমন কিছু প্রকাশ করে যার কারণে আইনশৃংখলার অবনমন ঘটে, রাষ্ট্র অথবা ব্যক্তির ভাবমর্যাদা ক্ষুন্ন হয়, কিংবা কারো ধর্মানুভূতি আহত হয় সেক্ষেত্রে ওই ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ ১৪ বছর কারাদÐ ভোগ করতে হবে। আপাতদৃষ্টিতে এই ধারাটি ইতিবাচক বলে মনে হলেও আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, ধারাটি মত প্রকাশের স্বাধীনতার পরিপন্থি এবং এতে যে অস্পষ্টতা রয়েছে তাতে সহজেই সাংবাদিক ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীদের এর আওতায় আনা সম্ভব। আইসিটি আইন পুলিশকে বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতারের অধিকার দিয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা এবং খুবই উদ্বেগের বিষয় যে, একজন সাংবাদিক, লেখক কিংবা যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীর লেখা বা তথ্যে আইনের লংঘন হয়েছে কিনা তা নির্ধারণ করার অধিকার পুলিশের একজন পরিদর্শকের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। ফলে এ যাবৎ যেমন এই আইনের অপব্যবহারের বহু নজির সৃষ্টি হয়েছে তেমনি ভবিষ্যতে অপব্যবহারের আশঙ্কাও রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেও আইনটি ব্যবহৃত হয়েছে।
আইনমন্ত্রী যখন বলছেন, আইসিটি আইন থেকে ৫৭ ধারা বাদ দেয়া হবে কিংবা এর বিভ্রান্তি ও দুর্বলতা দূর করা হবে তখনও যথেষ্ট আস্বস্থ হওয়া সম্ভব হচ্ছে না। কারণ, শোনা যাচ্ছে, আইসিটি আইনের ৫৭ ধারার অনুরূপ একটি ধারা রেখে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন প্রণীত হতে যাচ্ছে যার খসড়া বা প্রস্তাবনা মন্ত্রীসভায় অনুমোদিত হয়েছে গত আগস্টে। বলা বাহুল্য, আইসিটি আইনে ৫৭ ধারা সংশোধিত আকারে থাকুক অথবা না থাকুক, তাতে কিছু আসবে যাবে না। ডিজিটাল সিউরিটি আইনে যদি ওইরকম ধারা থাকে তবে ফলাফল ভিন্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই। আইসিটি আইনে পুলিশকে যে ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে, সেটা ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের অনুরূপ ধারা যুক্ত থাকলে সাংবাদিক, লেখক, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীদের ওপর একই হুমকি ঝুলে থাকবে এবং এই আইনের অপব্যবহার হওয়ায় আশঙ্কাও বিদ্যমান থাকবে। একথা ওয়াকিবহাল মহলের অজানা নেই, আইসিটি আইনের সমালোচনা শুধু দেশের বিভিন্ন মহলেই নয়, আন্তর্জাতিক মহল ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোতেও রয়েছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল আইসিটি আইন বাতিলের পক্ষে মত দিয়েছে। শুধু তাই নয়, ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের ব্যাপারেও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে স্মরণ করা যেতে পারে, ভারতের আইসিটি আইনে ৫৭ ধারার মতো একটি ধারা ছিল যাকে ২০১৫ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা করেছে।
যে আইন বা আইনের ধারা ব্যক্তির বাক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করে, যে আইন সংবাদপত্র ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ন্ত্রণে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত হয়, যে আইন আইন লংঘনের বিষয় নির্ধারনের ক্ষমতা পুলিশ কর্মকর্তার ওপর ন্যস্ত করে সে আইনকে হিতৈষী ও কল্যাণকর আইন বলে গণ্য করা যায় না। এমন কোনো আইন বা আইনের ধারা থাকা উচিত নয়, যা নিবর্তনমূলক ও সাংবিধানের পরিপন্থী। আইসিটি আইন কিংবা ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন, যাই বলা হোক না কেন, এটা তথ্য মন্ত্রণালয়ের বিষয় নয়, রাষ্ট্রের বিষয় ও জন-অধিকারের বিষয়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও বিষয়টি এড়িয়ে যেতে পারেনা। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার সঙ্গে এমন আইন বা ৫৭ ধারার মতো ধারা সাংঘর্ষিক। এরকম আইন ও ধারা মানবাধিকারের সঙ্গেও যায় না। আইসিটি আইন ও ৫৭ ধারা নিয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর যে প্রতিক্রিয়া ও অভিমত, সেটা রাষ্ট্র ও সরকারের ভাবমর্যাদার সহায়ক নয়। এমতাবস্থায়, জাতীয় বৃহত্তর স্বার্থে আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা বাতিল বা সংশোধনই শুধু নয়, এ ধরনের নিবর্তনমূলক ধারা যাতে অন্য কোনো আইনে সংযোজিত না হয় সেটা নিশ্চিত করতে হবে এবং আমরা সেটাই চাই।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন