শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আদিগন্ত

মানবিক বন্ধনকে জোরালো করা প্রয়োজন

প্রকাশের সময় : ৫ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১২:০৬ এএম, ৫ মার্চ, ২০১৬

মার্জিনা আফসার রোজী
সেদিন পত্রিকায় পড়লাম, ৬ মার্চ নাকি বিশাল এক শিলাখ- পৃথিবীতে আঘাত করবে। তাতে অনেক বড় ক্ষয়-ক্ষতি আর প্রাণনাশের আশঙ্কা করছেন ভূ-বিজ্ঞানীগণ। তথ্যটি বিশ্বস্ততা পেয়েছে এ কারণে যে, পৃথিবীবাসীগণ বড্ড অসহিষ্ণু আর নিরেট হয়ে উঠেছে। স্থায়ীত্বের মাধুর্যতা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। সে সাথে হিমালয় পর্বত, আটলান্টিক মহাসাগর, বায়ুম-ল, সৌরম-লে চলছে আমূল পরিবর্তন। সকল সৃষ্টিই যেন ইশারায় জানান দিচ্ছে, সময় স্বল্পতার কথা। প্রকৃতির এই বিদায়ী সুর যেন ক্ষুদ্র ভূ-খ-টির মানবজাতিকে করেছে অস্থির, উন্মাদ আর আক্রমণাত্মক।
আমাদের এই ছোট্ট দেশের বিশাল জনগোষ্ঠী আজ কম্পিত আতঙ্কিত আর দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। এ দেশে এখন স্বাভাবিক মৃত্যুর প্রত্যাশা যেন অসম্ভব চাওয়া। রূপকথার গল্পের মতো মনে হয়। যেখানে চোর, ডাকাত, ছিনতাইকারী, স্বেচ্ছাচারী, ধর্ষণকারী, হত্যাকারী, ষড়যন্ত্রকারী, কালোবাজারী, হঠকারী ও দুর্নীতিকারীরা মহাআনন্দে জেলের বাইরে থেকে অবাধে সর্বত্র বিচরণ করছে। আনন্দ-উচ্ছ্বাস আর বিপুল বিলাস-বৈভবে জীবনাতিপাত করছে। অপর দিকে সজ্জন, বিদূষী, প্রচার বিমুখ, দেশপ্রেমিক নীতি-আদর্শবান ব্যক্তিরাই জেলের ঘানি টানছেন। অপ্রকাশিত একটি বাণী যেন আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত হয়। শাসক-শোষকের রক্তচক্ষু আর হিংস্র নখের থাবা ল-ভ- করে দিয়ে যাবে দেশ মাতৃকার সকল অঙ্গন। কিন্তু কোনো প্রতিবাদের শব্দ সহ্য করা হবে না, সত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা মাত্রই চোখ হাত বেঁধে আন্ধকার প্রকোষ্টে নিক্ষিপ্ত হবে। ‘গণতন্ত্রের’ মতো অতি প্রচলিত এই শব্দটি ক্রমশ অধরা হয়ে যাচ্ছে এ দেশের জনগণের কাছে। আগে মানুষ বাঁচুক তারপর না মত প্রকাশের স্বাধীনতা। এই সাধারণ জনগণই আজ জীবন-মৃত্যুর অনিশ্চিত দোলাচলে দুলে অতলে হারিয়ে যাচ্ছে। কেউ রাখে না কারো নিঃশ্বেস হয়ে যাওয়ার খবর। মানুষ আজ মানবতা হারিয়ে দানবে পরিণত হচ্ছে। সে কারণেই মানুষের অপমৃত্যু অমানুষকে উচ্ছ্বসিত করে।
’৯০-এর সেই গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে পতিত সামরিক শাসকই বর্তমানে নতজানু হয়ে লেজুড়বৃত্তি করে চলেছে। সাবেক ঐ সামরিক শাসক বিবেকের তাড়নায় মাঝে-মধ্যে সত্যের আলাপ বিস্তার করেন। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ গর্বিত বদনে বলেছেন, তার আমলে গণতন্ত্র এবং উন্নয়ন ছিল, বিচার বিভাগের ওপর কারো হস্তক্ষেপ ছিল না, সুশাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল। কিন্তু বর্তমানে গণতন্ত্র নির্বাসিত। যদিও দেশের এ দুরাবস্থা দুঃশাসনের জন্য তারাও সমান দায়ী। তারাই ক্ষমতা ও অর্থের লোভে শাসকগোষ্ঠীকে রক্ষা করার জন্য খুঁটির রূপ ধারণ করে অপরাধকে দীর্ঘস্থায়ীত্ব প্রদান করছেন। সুতরাং লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত এ স্বাধীন দেশের গণতান্ত্রিক বিপর্যয়ের কারণে দায়ীদের ইতিহাস কখনো ক্ষমা করবে না। গত ৯ ফেব্রুয়ারি, সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতি মিলনায়তনে, সাবেক কয়েকজন প্রধান বিচারপতি মিলে বর্তমান সময়ের বিচার বিভাগের চরম নৈরাজ্যের প্রতি ইঙ্গিত করে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন এবং সকল আইনজীবীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, যেন ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিপর্যস্ত হয়ে যাওয়া থেকে বিচার বিভাগকে রক্ষা করার দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করেন। বিচার বিভাগকে ধ্বংসের কবল থেকে রক্ষা করার জন্য বিবেক তাড়িত বিচারকদের এমন উদ্বিগ্নতা বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরল দৃষ্টান্ত।
বিচার বিভাগ বিরাজমান সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ। মূলত বিচার বিভাগের কার্যকারিতার উপরই জনগণের যথার্থ কল্যাণ নির্ভর করে। শাসন ব্যবস্থা সুষ্ঠুরূপে পরিচালিত হচ্ছে কি-না তার প্রধান নিদর্শক হচ্ছে বিচার বিভাগের দক্ষতা এবং নিরপেক্ষতা। এটাই হচ্ছে ব্যক্তি স্বাধীনতা, ব্যক্তি অধিকার এবং সত্য ও ন্যায়ের প্রতিভূস্বরূপ। গণতন্ত্রে সুবাতাস বড়ই সুমিষ্ট, তাই সকল দেশের সকল জনগণেরই প্রাণের আকাক্সক্ষা একটি গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করা। ভিন্ন মত, ভিন্ন আদর্শ, অন্যের পছন্দ-অপছন্দের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করার রেওয়াজ সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়েছে। নিজস্ব স্বকীয়তা প্রকাশ কোন পাপ কিংবা অভিশাপ নয়। কিন্তু এখন মনে হয় কাঠের পুতুলও বোবা/কালা হয়ে বেঁচে থাকা ছাড়া গত্যন্তর নেই। যে যার মান-ইজ্জত-সম্মান রক্ষা করতে ব্যতিব্যস্ত। বৃহৎ অনিয়মের বিরুদ্ধে কথা বলার ইচ্ছা বা সাহস কোনটাই নেই। চলমান অবস্থা দেখে মনে হয়, মহাজোটের সমস্ত কর্মকা- সমর্থন না করাই যেন যন্ত্রণাপীড়িত হওয়ার জন্য যথেষ্ট কারণ।
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, একটি নয় ১০টি পদ্মা সেতু করার অর্থ সরকারের কাছে গচ্ছিত রয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কার অর্থ কে কারে দেয়। কিছুদিন পরপরই জনগণের ওপর চাপানো হয় বিভিন্ন করের বোঝা। গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ, নিত্য পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি, বাসাভাড়া, বাসাভাড়াসহ সকল নাগরিক সুযোগ-সুবিধার পরিধি সংকুচিত করে শুধু করের বোঝা চাপানো হচ্ছে। সেবার মান নিম্ন হলেও রেলের ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। কোনো ধর্মের ধর্মগুরুরাও আজ নিরাপদ নয়। সামাজিক বন্ধন, পারিবারিক বন্ধন সরকারি নির্দেশেই শিথিল হয়ে উঠেছে। একের পেছন অন্যকে লেলিয়ে দেয়া হয়। প্রতিহিংসাপরায়ণ শাসকগোষ্ঠী দ্বারা কোনো টেশসই কল্যাণই আশা করা যায় না। এ কালে অনেক কিছুই নতুন বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। বিরোধী মতের নেতৃত্বের মহত্ত্বকে ভূ-লুণ্ঠিত করা, অশ্রাব্য ভাষায় দোষারোপ করা, অবলীলায় প্রতিপক্ষের নেতাকর্মী হত্যা করা মামুলি ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রতিশোধের দাবানল নেভাতেই সর্বশক্তি নিয়োগ হচ্ছে। উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার গালভরা বুলি কেবলই রঙিন ফানুস। আজ ৪৫ বছর পূর্বের অপরাধীর বিচার হচ্ছে সগৌরবে নিপুণভাবে। কিন্তু নিত্যদিনের হত্যা, গুম, খুন ও অপহরণের মতো মহাঅপরাধের বিচার হয় না। বাংলার মানুষ আজ নিঃস্ব-রিক্ত-অসহায়। রাস্তার পাশের অবুঝ শিশুটিকে বাস চাপা দিয়ে চলে যায় তার বিচার হয় না। কোনো হত্যা রহস্যের জালই উন্মুক্ত হয় না, বিচারও হয় না। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকারী কোনো ব্যক্তি যদি রাষ্ট্রের মধ্যেই প্রতিপক্ষ সৃষ্টি করে তবে সেখানে জনগণই দুর্ভোগে পতিত হয়।
সম্প্রীতির বন্ধনকে দৃঢ় করার লক্ষ্যে সকলকেই পরমতসহিষ্ণু হয়ে উঠতে হবে। মমতা ও ভালোবাসার মিশ্রণে জগতের সকল বিঘœতা দূর করা যায়। অস্বাভাবিক অস্থির অবস্থা বেশি দিন চলতে পারে না। কখনো অনৈতিকতা প্রসারিত হলে, সেখান থেকে সুস্থ ও সুন্দরের পথে ফিরে আসা কঠিন কিন্তু অসম্ভব নয়। নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা ও অনিরপেক্ষতা, নিজের হাতে আইন তুলে নেয়া, ধর্ম গুরুদের হত্যা করে আইনের বাইরে থাকা, শিশু নির্যাতনের চরম অবস্থা, সম্মানিত ব্যক্তিদের অসম্মানিত করা, বিচার বিভাগকে প্রভাবিত করার চেষ্টা ইত্যাদি অনেক অভূতপূর্ব নেতিবাচক প্রভাব আজ দেশে দৃশ্যমান। এ দুরবস্থা থেকে  আশু পরিত্রাণ প্রয়োজন। প্রয়োজন লোভ আর হিংসা ভুলে মানুষে মানুষে মানবিক বন্ধনকে জোরালো করা।
 লেখক : প্রাবন্ধিক ও সংগঠক

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন